বাবু সাহা, বৈরুত, লেবানন : লেবাননে মন্দা অর্থনীতি ও মহামারি কারোনাকালে বাংলাদেশিরা যে কতটা অসহায়, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন দেশটির দেড় লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি। কেউ জীবন বাঁচার জন্য ঘরবন্দী, আর কেউবা জীবন–জীবিকা নির্বাহে ঘর থেকে বাইরে। জীবন বাঁচার যুদ্ধ চলছে সর্বত্র। জীবিকার কাছে পরাস্ত করোনাভীতি। কর্মহীন প্রবাসীরা পেশা পাল্টাচ্ছেন অজানা শঙ্কায়।
এমনই পেশা পাল্টানো কয়েকজন প্রবাসীর দেখা মিলল সাবরা বাজারের অদূরে। সবাই রাস্তার পাশে পুরোনো জিনিসের পসরা সাজিয়ে প্রখর রোদে বসে তা বিক্রি করছেন। প্রথমে দেখলে যে কারও কাছে গুলিস্তান মনে হবে। পুরোনো কাপড়, হাঁড়ি–পাতিল, ব্যাগ, জুতা সবই আছে এখানে। আগে বাংলাদেশিরা এ পেশায় লজ্জা অনুভব করলেও এখন অভাবের তাড়নায় কেউ আর লজ্জাবোধ করেন না।
তাঁদের মধ্যে একজনের নাম হানিফ। আলাপে জানালেন যে তাঁর বাড়ি কুমিল্লা। বছর দশেক আগে লেবানন এসেছেন। কাজ নিয়েছিলেন একটি রেস্টুরেন্টে। মাসিক বেতন ভালোই ছিল। বাংলাদেশে পরিবারে সদস্যসংখ্যা ৫। প্রতি মাসের পাঠানো অর্থে সবাই খুব সুখেই দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু সুখ নামের পাখিটি জীবন থেকে তখনই উড়াল দিল, যখন থেকে লেবাননে শুরু হলো ডলার–সংকট।
গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে দেশটিতে অর্থনৈতিক মন্দা ও ডলার–সংকট দেখা দেওয়ায় লেবাননের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একের পর এক বন্ধ হতে লাগল। হানিফের রেস্টুরেন্টটিও বন্ধ হয়ে গেল। বেকার হয়ে পড়লেন হানিফ। বন্ধ হয়ে গেল দেশে টাকা পাঠানো। তারপর শুরু হলো করোনা প্রকোপের কারণে চার মাসের লম্বা লকডাউন। ৯ মাসের বেকারত্বে দেখা দিল অর্থ ও খাদ্যসংকট। তাই বাধ্য হয়ে অভাবের তাড়নায় পুরোনো জিনিস বিক্রি করছেন রাস্তার পাশে।
দীর্ঘ ৪ মাসের লকডাউনের চেয়েও বাংলাদেশিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দেশটিতে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা ও স্থানীয় বাজারে ডলার–সংকটের কারণে। ৯ মাস আগে যেখানে দেড় হাজার লিরায় ১ ডলার পাওয়া যেত, সেখানে এখন ১ ডলার কিনতে প্রবাসীদের খরচ হচ্ছে ৭ হাজার লিরা বা তার থেকেও বেশি। স্থানীয় ব্যাংকগুলোতে ডলারের ঘাটতির কারণে কালোবাজারে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডলারের মূল্য। দেশটির সরকার শত চেষ্টা করেও ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অসন্তোষ দেখা দিয়েছে জনজীবনে।
মূলত ডলারের লাগামহীন দামের কারণে হুমকির মুখে দেশটিতে থাকা প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশির জীবন-জীবিকা। ডলারের ঊর্ধ্বগতিতে আকাশচুম্বী সব খাদ্যদ্রব্যের দাম। অর্থ ও কর্মসংকটে থাকা বাংলাদেশিরা হিমশিম খাচ্ছেন বর্ধিত দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার সামগ্রী কিনতে।
আগে একজন প্রবাসীর মাসিক বেতন যেখানে ৫০০ ডলার ছিল, বর্তমানে স্থানীয় মুদ্রার মূল্যহ্রাসের কারণে তা ১ শত ডলারে নেমে এসেছে। নিজের খাওয়াদাওয়া, ঘরভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে প্রত্যেক প্রবাসীকে আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। তা ছাড়া দীর্ঘ ১০ মাসব্যাপী তাঁরা দেশে পরিবারের নিকটও অর্থ পাঠাতে পারছেন না। ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার প্রবাসী চাকরি হারিয়ে বৈধ থেকে অবৈধ হয়ে মানবেতর দিন পার করছেন। শিগগিরই যদি ডলার–সংকট না কাটে, তাহলে দেশটিতে থাকা প্রবাসীদের দেশে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
হানিফের মতো আরও প্রায় ২০–২৫ জন বাংলাদেশি লেবাননের বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরোনো সামগ্রী ক্রয় করে রাস্তার পাশে পসরা সাজিয়ে বিক্রি করছেন। সারা মাসে যে আয় হয় তা দিয়ে কোনোভাবে ঘরভাড়া ও খাবার খরচ চলে তাঁদের। এর মধ্যে কয়েকজন দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য দূতাবাসে নাম নিবন্ধন করে রাখলেও বিমান বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তাই এমন ক্রান্তিকালে সব ভুক্তভোগী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।
এদিকে লেবানন সরকার ১ জুলাই দেশটির একমাত্র বিমানবন্দরটি চালুর ঘোষণা দেওয়ায় বাংলাদেশিদের মাঝে স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। বিমানবন্দর সচল হলেও বৈরুত থেকে ঢাকা রুটে কবে থেকে বিমান চলাচল শুরু হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সঠিক ধারণা পাওয়া যায়নি।
লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাস আশা করছে, বিমানবন্দর চালুর পর যদি বৈরুত-ঢাকা রুটে বিমান চলাচল স্বাভাবিক ও এয়ার টিকিট কেনার সামর্থ্য থাকে তাহলে দূতাবাসে নিবন্ধিত হওয়া প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বাংলাদেশি ও জেলে বন্দী শতাধিক প্রবাসীকে দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে। এ জন্য দূতাবাস ঢাকা রুটের বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে ৩ শতাধিক লেবাননপ্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী লকডাউনের আগে ছুটিতে দেশে গিয়ে আটকে পড়েছেন। ফ্লাইট বন্ধ থাকার কারণে তাঁরাও কর্মস্থলে ফিরে আসতে পারছেন না। এমন কয়েকজন ভুক্তভোগী বাংলাদেশ থেকে জানিয়েছেন, তাঁদের ইকামা (রেসিডেন্ট পারমিট) কারও অবস্থাকালীন ৬ মাস পেরিয়ে গেছে, কারও আবার ইকামার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কারও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পথে।
এই বিষয়ে দূতাবাসের শ্রম বিভাগ উইং জানিয়েছে, এ নিয়ে আটকে পড়া প্রবাসীদের দুশ্চিন্তার কিছুই নেই। এ দেশের নিয়োগকর্তা বা স্পনসর চাইলে অবশ্যই তাঁরা আবার লেবাননে প্রবেশ করতে পারবেন। তাঁদের নিয়োগকর্তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দিয়েছে দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর।
লেবাননে ক্লিনিং কোম্পানিসহ যেসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানে অধিকাংশ শ্রমিকই বাংলাদেশি। দেশটির এমন ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিমান চলাচল শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন কোম্পানির মালিকেরা কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটি বড় অংশকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তা ছাড়া গত বছরে লেবানন সরকার ইকামা নবায়ন ফি বাড়িয়ে দেয়। তার সঙ্গে গত ৯ মাসে স্থানীয় মুদ্রার মূল্যহ্রাসের কারণে অনেক কোম্পানি প্রবাসীদের ইকামার খরচ বহন করতে অনীহা প্রকাশ করছে। এমন বাস্তবতায় কর্মরত বাংলাদেশিরা অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন।