সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: আট
অয়নের ডায়েরি
বুধবার
৬ জুন ১৯৮৪
ক্লাস সিক্সে ওঠার পরপরই আমাদের নারায়ণগঞ্জের জীবনের ইতি ঘটল। আমরা ঢাকা চলে এলাম। অপু আর আমি ভর্তি হলাম গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে। খুবই কড়াকড়ি ওই স্কুলের নিয়মকানুন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিজয় কুমার রায়। আমার এই জীবনে যে কয়েকজন ভালো শিক্ষক পেয়েছিলাম, বিজয় স্যার তাদের মধ্যে অন্যতম।
সুন্দর কান্তিময় তার অবয়ব, মুক্তোর মতো হাতের লেখা, সুন্দরতর তার বাচনভঙ্গি! খুব যতœ সহকারে আমাদের ইংরেজি পড়াতেন।

বিজয় স্যারের মুখেই প্রথম শুনেছি শেকসপিয়ার, মিল্টন, শেলি, কিটস আর বায়রনের কথা। শুনেছি ম্যাক্সিম গোর্কি, তলস্তয় আর নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির কথা!
ফাঁকে ফাঁকে তিনি আলাপ করেছেন রবীন্দ্র-নজরুল আর সুকান্তের কথা।
মিশন স্কুলে একটি লাইব্রেরি ছিল। ওখানে রাজ্যের সব বই। বিজয় স্যারই আমাদের বই পড়ার অভ্যেস করিয়েছিলেন। সপ্তাহে একদিন বিজয় স্যার নিজ হাতে আমাদের লাইব্রেরির বই ইস্যু করতেন। আমরা বুভুক্ষু পাঠকের মতো পড়তে শুরু করলাম। আমরা পড়ি সত্যজিৎ রায়, বিভূতিভুষণ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।
‘ফেলুদা’ পড়তে পড়তে আমরা নিজেকে মনে করতাম তোপসে। বিভূতিভুষণ পড়তে পড়তে আমরা কখনো কখনো হারিয়ে যেতাম অপু আর দুর্গার জগতে।
আহা, কী নির্মল ছিল সেই জগৎ!
কি অবারিত ছিল সেই আবাহন!
স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী হতো। নজরুলজয়ন্তী হতো। আরো হতো সুকান্তজয়ন্তী। আমরা কেউ গান করতাম, কেউ আবৃত্তি করতাম। কেউ-বা একাঙ্কিকায় অভিনয় করতাম। বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীর বিশাল অনুষ্ঠান হতো। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে আসতেন স্বামী অক্ষরানন্দ। আমরা সবাই ওনাকে বলতাম ‘মহারাজ’!

‘মহারাজ’ হলেন রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধ্যক্ষ। সব সময় গেরুয়া পোশাক পরে থাকতেন। অবশ্য মহারাজের দেখা সারা বছর মিলত না। আমরা ওনাকে দেখতাম সারা বছরে দুবার কি তিনবার!
পূজার দেবী বাসন্তীর মতো মহারাজের দর্শনও দুর্লভ ছিল!
স্কুলের সীমানা যেখানে শেষ, সেখানে বিশাল দেয়াল। দেয়ালের মাঝে লোহার গেট। গেটের ওপাশে সবুজ মাঠ। মাঠের এক পাশে বিরাট মন্দির। মন্দিরের চারপাশে বিশাল বিশাল গাছ। ওই গাছগুলোর মধ্যে চার-পাঁচটি আমলকীর গাছ। গাছের তলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত আমলকী। আমলকী গাছের পাশেই একটা বাংলো। মহারাজ থাকতেন ওই বাংলোয়।
হিন্দু স¤প্রদায়ের অনেক নামিদামি লোক আসতেন মহারাজের সাথে দেখা করতে। অভ্যাগতদের মধ্যে থাকতেন বিচারপতি, সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। মাঝেই মাঝেই আসতেন চলচ্চিত্র ও টিভির তারকারা। ওই তারকাদের দেখার লোভে ও আমলকীর সন্ধানে আমি আর অপু সময় পেলেই ঢুঁ মারতাম মহারাজের বাংলোর আশপাশে!
সেদিন ছিল রামকৃষ্ণের জন্মবার্ষিকী। স্কুল বন্ধ। দুপুরের পর অপু আর আমি গেলাম স্কুল লাইব্রেরিতে। কিছু বই সংগ্রহ করতে। রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের ওপর দুটো বই সংগ্রহ করে আমরা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলাম।

অপু বলল, ‘অয়ন, চল মন্দিরের ওদিকে যাই। আমলকী নিয়ে আসি’!
আমি বললাম, ‘চল’।
আমরা কেবল আমলকীতলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি, ঠিক তখুনি বাংলো থেকে বের হলেন মহারাজ অক্ষরানন্দ। মহারাজের সাথে পাঞ্জাবি আর ধুতি পরিহিত আরেকজন।
অপু আমাকে বলল, ‘অয়ন, ওনাকে চিনেছিস’?
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, চিনেছি। স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে উনি প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন। বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। উনি হচ্ছেন বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য’!
অপু বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।’
দুই মহারথী একসাথে হেঁটে হেঁটে আমাদের দিকেই আসছেন।
আমরা একটু জড়সড় হয়ে গেলাম। ওনারা আমাদের কাছাকাছি আসতেই আমরা মিনমিন করে বললাম, ‘নমস্কার।’
ওনারা দুজনেই উত্তরে বললেন, ‘নমস্কার।’
মহারাজ, বিচারপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এরা আমাদের স্কুলের ছাত্র। দুজনই খুব ভালো আবৃত্তি করে’!
বিচারপতি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি চিনতে পেরেছি। ওদের আবৃত্তি আমিও শুনেছি’!
মহারাজ আর বিচারপতির কথা শুনে আমি আর অপু বিস্ময়ে হতবাক। মনে মনে ভাবি, বড় বড় মানুষদের স্মৃতিশক্তি কতো বড়! উনারা আমাদের মতো পুঁচকেদের সযতেœ মনে রেখেছেন!
বিচারপতি বিদায় নিলেন।
মহারাজ বললেন, ‘তোমরা প্রসাদ খাবে’?
অপু আর আমি বরাবরই প্রসাদের ভক্ত। তাই মহারাজের কথায় সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। সেই প্রথম মহারাজের বাংলোয় ঢোকার সুযোগ হলো। মহারাজের বাংলোয় প্রচুর বই। বেশির ভাগই ধর্মীয় বই। কিছু বিজ্ঞানের বইও দেখলাম। বইয়ের গন্ধ আমার খুবই প্রিয়। তাই বাংলোয় ঢুকে আমার খুবই ভালো লাগল। মহারাজের খাস দপ্তরি বিনোদ আমাদের দুটো করে সন্দেশ গিয়ে গেল।
সন্দেশ খেতে খেতে আমি ভয়ে ভয়ে মহারাজকে মিন মিন করে বললাম:
‘মহারাজ, আমরা কারণ-অকারণে মন্দিরের আশপাশে ঘুরঘুর করি। আপনি কি আমাদের ওপর বিরক্ত?’
মহারাজ বললেন, ‘একথা কেন বলছ, বলো তো? আমি কি তোমাদের কখনো কিছু বলেছি?’
আমি বললাম, ‘না, মানে আমরা তো হিন্দু নই। অপু মুসলমান, আমি বৌদ্ধ। আমরা তো অন্য ধর্মের’!
মহারাজ বললেন, ‘শোনো, তোমাদের বলি, এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের মতবাদের ওপর ভিত্তি করে। তোমরা হয়তো জানো না যে, শ্রী রামকৃষ্ণ ইসলাম, খ্রিষ্টধর্মসহ বিভিন্ন ধর্মমত অভ্যাস করেছিলেন। ওই অভ্যাস থেকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে সকল মত একই ঈশ্বরের পথে মানুষকে চালিত করে।
তিনি বলেছেন, ‘যত্র জীব তত্র শিব’ অর্থাৎ ‘যেখানেই জীবন, সেখানেই শিবের অধিষ্ঠান! কাজেই শিব ভেবেই জীবের সেবা করো’!
তিনি আরো বলেছিলেন, আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল- এ মত ভালো না। ঈশ্বর এক বই দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম।
যেমন পুকুরে জল- এক ঘাটের লোক বলছে জল, আরেক ঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আরেক ঘাটের লোক বলছে পানি- হিন্দু বলছে জল, খ্রিষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, কিন্তু বস্তু এক!
মত-পথ!
একেকটি ধর্মের মত একেকটি পথ, ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানা দিক থেকে এসে সাগরসংগমে মিলিত হয়!
শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, কাম ও অর্থই মানুষকে ঈশ্বরের পথ হতে বিচ্যুত করে। তাই ‘কাম-কাঞ্চন’ ত্যাগের পথই তাঁর কাছে ছিল ঈশ্বরের পথ! জগৎকে তিনি ‘মায়া’ বলেছেন।
তাঁর মতে, জগতে মূলত দুটো শক্তি। অন্ধকার শক্তি বা অবিদ্যা মায়া! আলোকিত শক্তি বা বিদ্যা মায়া!
অন্ধকার শক্তি বা অবিদ্যা মায়ার মধ্যে আছে কামনা, বাসনা, লোভ, মোহ, আর নিষ্ঠুরতা। এগুলো মানুষকে চেতনার সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে আনে। এই মায়া মানুষকে কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করে।
অন্য দিকে আলোকিত শক্তি বা বিদ্যা মায়ার মধ্যে আছে আধ্যাত্মিক গুণাবলি, জ্ঞান, দয়া, শুদ্ধতা, প্রেম ও ভক্তি। এগুলো মানুষকে চৈতন্যের সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যায়’!
এ পর্যন্ত বলে মহারাজ থামলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।
তারপর বললেন, ‘আমি দুঃখিত। কথাগুলো তোমাদের মতো কোমলমতি কিশোরদের জন্য খুব ভারী হয়ে গেল। তবে তোমরা একদিন বড় হবে। এই জগৎ-সংসারের যাবতীয় দায়ভার তোমাদের স্কন্ধে পড়বে। সেদিন তোমরা সব জানবে, সব বুঝবে’!

আমরা যখন মহারাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মন্দিরের সামনে সবুজ ঘাসের ওপর এসে দাঁড়ালাম, তখন সূর্যটা হেলেছে পড়েছে পশ্চিমে।
আমলকীর পাতায় পাতায় বাতাস ঝিরঝির করছে। বাগানের ফুলগুলোর ওপর ঘোরাঘুরি করছে শত শত রঙিন প্রজাপতি। দূরে কোথাও থেমে থেমে কোকিল ডাকছে!
মনটা অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে উঠল। মন্দিরের সামনে পূজারিদের ভিড়। ওই ভিড় এড়িয়ে আমরা নেমে এলাম রাস্তায়!
আজ এত বছর পর, আমার খুব ইচ্ছে হয়, মহারাজের সাথে দেখা করি।
দেখা করে মহারাজকে বলি, মহারাজ, আমরা বড় হয়েছি! আমাদের ঘাড়ে জগৎ-সংসারের অনেক বোঝা এসে পড়েছে, কিন্তু আমরা এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি!
আমরা এখনো রয়ে গেছি আলো-আঁধারিতে।
আমাদের জীবনটা এই আলো!
এই আঁধার!
জীবন এমন কেন?
চলবে….
সিনহা মনসুর।