সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: পাঁচ
অয়নের ডায়েরি
বৃহস্পতিবার
১০ই মে ১৯৮৪।
পিজি হাসপাতালের এগারোতলার কেবিন নম্বর এগারোশো তিন। ওটাই এখন আমার অস্থায়ী নিবাস। বিশ ফিট বাই পনেরো ফিটের ছোট্ট একটি রুম। ওই রুমে সাত ফিট বাই তিন ফিটের দুটো বিছানা। দুটো বিছানাতেই সাদা চাদর, সাদা বালিশ। রুমে আছে বড় একটি জানালা। জানালায় সাদা পর্দা। সকালে আর বিকেলে ডাক্তাররা রাউন্ডে আসেন। ওদের গায়ে জড়ানো থাকে সাদা অ্যাপ্রন। দুই শিফটে দুজন নার্স আসেন। ওদেরও পরনে থাকে সাদা পোশাক। হাসপাতালে সাদার ছড়াছড়ি!
আচ্ছা, সাদা তো পবিত্রতার প্রতীক। তাহলে, হাসপাতাল কি পবিত্র জায়গা?
আমি জানি না!

নদীকে জিজ্ঞেস করতে হবে। নদী নিশ্চয়ই এর উত্তর জানে। আমি যেসব প্রশ্নের উত্তর জানি না, নদী ঠিক ঠিক তার উত্তর জানে!
তবে আমার মনে হয়, হাসপাতাল হচ্ছে বিশাল এক যুদ্ধক্ষেত্র। ওই যুদ্ধের মিত্রপক্ষ হচ্ছেন ডাক্তার, নার্স আর স্বয়ং রোগীরা।
শত্রুপক্ষে আছে জানা-অজানা কতশত রোগ!
কতশত শোক!
নিজের অজান্তেই আমি এক যুদ্ধে জড়িয়ে গেলাম।
কী কঠিন এই যুদ্ধ!
আমি কি হতে পারব সংশপ্তক?

মা আমার সাথে আছেন সারাক্ষণ। বাবা সকালে আসেন। সাড়ে আটটায় অফিসে চলে যান। আবার আসেন সন্ধ্যের পর। থাকেন রাত দশটা অবধি। ভিজিটিং আওয়ারে অনেকেই দেখতে আসেন আমাকে। বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন। এটা-সেটা গল্প করেন।
সব গল্পই একসময় গিয়ে থামে আমার অনাহূত মৃত্যুতে!
আমি মুখে কিছু বলি না!
বলতে পারি না!
কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ে কেঁপে উঠি। বুকে বেজে ওঠে অবিরাম বজ্রপাতের অমঙ্গল শব্দ, নদীর পাড় ভাঙার অমঙ্গল শব্দ!

আমার বিছানার পাশেই ছোট্ট আরেকটি বিছানা। দুপুরে ওই বিছানাতেই আমার ক্লান্ত মা হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি, আকাশের নীল দেখি। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ দেখি। মেঘেদের ওড়াউড়ি দেখি। আরো দেখি মেঘের ওপর চক্রাকারে ঘুরে বেড়ায় চিল! আমার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। মনে পড়ে যায় আমার দাদির কথা। ছোটবেলায় আমি প্রায়ই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম মেঘের ওপর ঘূর্ণায়মান ওই সব চিলের দিকে!
দাদি বলতেন, ‘বুঝলি অয়ন, খুব যখন গরম পড়ে, রোদের তেজে ছোটখাটো নদী-নালা, পুকুর-ঘাট আর বিলগুলো যখন শুকিয়ে যায়, চিলেরা তখন আকাশে উড়ে উড়ে পুকুর কাটে। ওই পুকুরের জলই বৃষ্টি হয়ে ফিরে আসে আমাদের কাছে!’
আমি দাদির সব কথা বিশ্বাস করতাম। ভান মন্দ সব!
বিশ্বাস না করে উপায়ও ছিল না।
ভীষণ গল্প-পটুয়া ছিলেন দাদি। আমি তো তার কাছেই ঘুমাতাম। ছোটবেলায় কতবার তার সাথে গেছি গ্রামের বাড়িতে।
আমার এখনো মনে পড়ে শীতের সেই সব রাতের কথা।

প্রথম রাতেই চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে যেত। আমরা সবাই খাবারদাবার সেরে ফেলতাম সন্ধে রাতেই। তারপর একসময় নিভে যেত হেঁসেলের কুপি, খাবার ঘরের কুপি। টিমটিম করে জ্বলত শুধু শোবার ঘরের হারিকেনটা। বাইরে হাড়কাঁপানো শীত। নিকষ কালো অন্ধকার। ওই অন্ধকারেই বাড়ির পাশের ছোট্ট বনটাতে ডেকে উঠত দু-একটা বাজকুড়ুল পাখি। আমি ভয়ে মুখ লুকোতাম দাদির বুকে!
দাদিও আমায় জড়িয়ে ধরতেন পরম মমতায়।
মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে দাদি বলতেন, ‘পাগল ছেলে, ভয় কিসের? আমি আছি না!’
প্রশ্রয় পেয়ে আমি গল্পের বায়না ধরতাম। দাদি ছিলেন বিক্রমপুরের পদ্মাপারের মেয়ে। তার গল্পের সিংহভাগজুড়েই থাকত পদ্মাপারের গল্প।
জোয়ার-ভাটার গল্প!
খরার দিনের গল্প!
বৃষ্টি দিনের গল্প আর দাদির পূর্বপুরুষদের গল্প! ওই পূর্বপুরুষদের একজন ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর!

অপুর বাড়িও পদ্মাপারের বিক্রমপুরে। অপুকে নিয়ে গিয়েছিলাম একবার আমার দাদির পূর্বপুরুষদের ভিটায়। সেকথা আরেক দিন বলব।
দাদির গল্পে আরো আসত জিন ও ভূত। ভয়জাগানিয়া সেই সব গল্প।

দাদি বলতেন, ‘জানিস অয়ন, আমার যখন বিয়ে হয়, তখন আমার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর। বিয়ের পরপর তোর দাদা আমাকে নিয়ে এলেন পাহাড়তলীর এই বাড়িতে। তখন এই বাড়ির পুবদিকে একটা দালানঘর ছিল। ওই দালানে পেছনের দিকে বড় একটা ঘর ছিল। ওখানেই থাকতাম তোর দাদু আর আমি। প্রায়ই রাতে বিচিত্র শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। কখনো শুনতাম কারা যেন কথা বলছে, ভাষা বুঝতাম না। কখনো শুনতাম ছাদে কারা যেন হাঁটছে। সাদা সাদা আলখেল¬লার মতো ওদের পোশাক। কখনো কখনো খড়ম পায়ে হাঁটাহাঁটির শব্দ শুনতাম করিডরে। খড়মের শব্দ শুনে তোর দাদু একদিন বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। করিডরে হাঁটছিল দুজন। একজন নারী, একজন পুরুষ। তোর দাদুকে দেখে ওরা হেঁটে হেঁটেই দেয়াল ভেদ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওই দিনের পর আমরা আর থাকিনি ওই দালানে। ওই ঘরে।’

আমি দাদিকে জিজ্ঞেস করি, ‘দাদি, ওই দালানটা কোথায়?’
দাদি বলেন, ‘তোর দাদু ওই দালানটা ভেঙে ওখানে একটা প্যাগোডা বানিয়েছে। প্যাগোডা বানানোর পর আর কোনো দিন কোনো শব্দ শুনিনি। আর কোনো দিন কোনো কথা শুনিনি। আর কোনো দিন ওদের দেখিওনি।’
এই সব স্মৃতি, এই সব ভয়জাগানিয়া ঘটনা, সে তো যুগ যুগ আগের কথা।
হঠাৎ আজ এই সব মনে পড়ল কেন?
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, এই সব ঘটনা, এই সব স্মৃতি কি আমার এই জীবনের, না অন্য কোনো জীবনের?
তা কি এই ভুবনের, না অন্য কোনো ভুবনের?
মাঝে মাঝেই ভাবি, নদীকে এই কথাগুলো জিজ্ঞেস করব, কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি, নদী নিজেই তো তখন ছিল না আমার জীবনে।

আমার জীবনে নদী তো এল আরো অনেক পরে।
নদীকে আমি প্রথম দেখেছিলাম চৈত্রের এক পড়ন্ত বিকেলে।
বুয়েট ক্যাম্পাসে সেদিন ছিল আমাদের নবীন-বরণ। আর্কিটেকচার বিভাগের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো লম্বা লম্বা দেবদারু গাছ। ওই গাছের নিচে দাঁড়িয়েই গল্প করছিল নদী।ওর সাথে নবাগতা আরো কয়েকজন। আমরাও নবাগত। আমার সাথে অমি আর শামিম। আমরাও এসেছি নবীন-বরণ অনুষ্ঠানে।
নদীকে দেখে আমার মনে হলো, ঠিক যেন এক পশলা বৃষ্টি।
ওই বৃষ্টির আগমন প্রচণ্ড দাবদাহের পর।
প্রচণ্ড খরার পর!
উর্বর জমি ফেটে চৌচির হবার পর!
ওই বৃষ্টি বহু কাংখিত বৃষ্টি!
ওই বৃষ্টির জন্য দুহাত তুলে প্রার্থনা করেন কৃষক!
দুহাত তুলে প্রার্থনা করেন দাবদাহে পুড়ে যাওয়া নগরবাসী!

নদীকে দেখে আমার কী যে ভালো লাগল তা বলে বোঝাতে পারব না। আমার মনটা জুড়িয়ে গেল। আমার চোখের সামনে যেন খুলে গেল একটি বন্ধ দরজা!
সাথে সাথে অনেকগুলো বন্ধ জানালাও!
বহুযুগ ধরে, বহুকাল ধরে বন্ধ ছিল ওই দরজা বা ওই জানালাগুলো।
ওই দরজা বা ওই জানালাগুলো কেন বন্ধ ছিল এতকাল?
কেন এত ভালো লাগল নদীকে!
আমি তো মনে মনে কোনো বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করিনি!
আমার জীবনে তো কোনো খরা ছিল না! আমার জীবনে তো কোনো দাবদাহ ছিল না!
তবে কেন আমার মনে হলো নদী এক পশলা বৃষ্টি!
নাকি খরা ছিল? দাবদাহ ছিল? আমিই দেখিনি। অথবা দেখার সময় পাইনি।
আসলে কিছু কিছু জিনিস আছে, যা দেখলেই দৃষ্টি জুড়িয়ে যায়। কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের সান্নিধ্যে এলে মন ভালো হয়ে যায়।
নদীকে দেখে মনে হয়েছিল নদী সেরকম একজন মানুষ!
নবীন-বরণ হয়ে গেল।

যথারীতি ক্লাসও শুরু হয়ে গেল। দেখতে দেখতে আমরা ঢুকে পড়লাম স্থাপত্যের জগতে!
অদ্ভুত ওই জগৎ। কখনো কঠিন, কখনো জটিল, কখনো-বা উত্তেজনাকর। স্থাপত্যের ওই জগতের বাইরেও আমার একটা জগৎ গড়ে উঠল।
কল্পনার!

কল্পনার ওই জগতের বাসিন্দা নদী। শুধুই নদী। সেই সমস্ত দিনে নদীকে দেখলেই আমার মনে হতো এইমাত্র আকাশে উড়ে গেল একঝাঁক শ্বেত পায়রা। নদীকে দেখলেই আমার মনে হতো, আমি যেন তাকিয়ে আছি সদ্য দলমেলা একটা গোলাপের দিকে। অথবা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত ছেলেবেলায় পুকুরের ঠিক মাঝখানে দেখা সেই নীল পদ্মটি!
শ্বেত পায়রা, গোলাপ, নীল পদ্ম আর নদীর কথা ভেবে ভেবেই কেটে গেল বুয়েটের প্রথম ছয় মাস।

এরই মধ্যে নদীর সাথে আমার কথা হয়েছে, সখ্য হয়েছে। হয়েছে বন্ধুত্বও।
দ্বিতীয় সেমিস্টারের শুরুতেই নদী, রনি আর আমি- আমরা তিনজন প্রজেক্ট পার্টনার হয়ে গেলাম। রনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছেলে। খেলাধুলায় খুব ভালো। এইতো কিছুদিন আগে ইন্ডোর গেমসে চ্যাম্পিয়ন হলো। তিতুমীর হলের বিতর্ক টিমে আমি আছি।
আর নদী?
নদীর আলোচনা বিভাগের সর্বত্র। ভালো ছাত্রী হিসেবে!
ভালো মেয়ে হিসেবে!
আমরা তিনজনে একসাথে আড্ডা মারি। একসাথে পড়াশোনা করি। একসাথে ঘুরে বেড়াই। একসাথে প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করি। আর মাঝে মাঝেই রাত জেগে প্রজেক্ট করি। আমাদের অন্য বন্ধুবান্ধবেরা আমাদের খুব পছন্দ করত।
আমাদের এত মিল, এত এত সখ্য দেখে অন্য বন্ধুরা আমাদের নাম দিল, ‘আমি, সে ও সখা’।

কী অদ্ভুত সুন্দর নাম!
অয়নের ডায়েরি
রোববার
২০শে মে ১৯৮৪।
আজ বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে গেল। আগামীকাল থেকে আমার কেমোথেরাপি শুরু হবে। কেমোথেরাপি চলবে এক মাস। এই এক মাসে আমাকে চারটা থেরাপি নিতে হবে। চার থেরাপির এই সাইকেল চলবে মোট ছয়টা।
এই থেরাপিগুলো আমার শরীরের ক্যানসার কোষগুলোকে ধ্বংস করবে। সাথে সাথে ধ্বংস করবে কিছু কিছু স্বাভাবিক কোষকেও। আমার প্রচণ্ড বমি-বমি ভাব হতে পারে। বমি হতে পারে। ক্ষুধামন্দা হতে পারে। মাথার চুলগুলোও পড়ে যেতে পারে! দুদিন আগে বিকেলের রাউন্ডে প্রফেসর এম এন হুদা আমাকে এগুলো জানালেন।
তিনি আরো জানালেন, এই সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাবে। সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যাবে অনেক। কাজেই ভিজিটরের সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে হবে।
বিষয়গুলো অপুকে জানিয়ে বললাম, ‘অপু, এই সময়টা হয়তো আমাকে একা একা কাটাতে হবে। তুই আমাকে ভালো কিছু বই দিয়ে যাস। হাসপাতালে শুয়ে-বসে পড়ব।’
গতকাল সন্ধ্যায় অপু আমাকে দুটো বই দিয়ে বলল, ‘অয়ন, এই বই দুটো-খুব ভালো। নীলক্ষেত থেকে জোগার করেছি। তোর ভালো লাগবে’!
অপুর সাথে গল্প করছি, তখনই এল নদী। সাথে রনি। আমরা ডুবে গেলাম ক্যাম্পাসের গল্পে।

গল্পের এক পর্যায়ে অপু বলল, ‘অয়ন, আমাকে যেতে হবে। মায়ের শরীরটা ভালো নেই।’
রনি বলল, ‘চল অপু, তোর সাথে নিচে যাই।’
রনি আর অপু নিচে গেল।
রুমে আমি আর নদী।
নদী বসে ছিল অন্য বিছানায়।

ও উঠে এসে আমার পাশে বসল। আমি বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া।
নদী ওর হাত রাখল আমার কপালে। আমি যেন একটু কেঁপে উঠলাম। নদী সরাসরি তাকাল আমার চোখের দিকে। নদীর এই হাত, নদীর এই চোখ আমার চেনা।
নদীর এই হাত নির্ভরতার!
নদীর এই চোখ ভালোবাসার!
এই হাত ধরে আমি কাটিয়ে দিতে পারি তিন-তিনটি জীবন।
এই চোখের ভালোবাসায় আরো তিন-তিনটি পুনর্জন্ম।
তিন জীবন! তিন পুনর্জন্ম!
কিন্তু আমি তো এক জন্মই কাটাতে পারব না ওর সাথে!
ওই প্রথম আমার মনে হলো-
হায়!
জীবন এত ছোট কেন?
নিজের অজান্তেই ভিজে গেল আমার চোখ দুটো!
চোখ ভিজল নদীরও!
ওই ভেজা চোখেই ও বলল, ‘অয়ন, ধৈর্য ধরো। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
বাইরে দমকা হাওয়া। রুমের পর্দাটা বাতাসে ফুলেফেঁপে উঠছে বারবার। দমকা হাওয়ায় উড়ছে নদীর সিল্কের মতো চুলগুলোও।
আমি মনে মনে বললাম, নদী, কোনো কিছুই ঠিক হবার নয়। আমার জীবনটা কক্ষচ্যুত হয়ে গেছে। কক্ষচ্যুত নক্ষত্র কক্ষে ফেরে না। ওরা হারিয়ে যায়, মরে যায়!
রনি ফিরে এসেছে। নদী আর রনি চলে গেল। আমি তাকিয়ে রইলাম ওদের পথের দিকে।
ওই পথ দিয়েই ঘুরে ঢুকল মা। অনেক দিন পর মা আমাকে নিজ হাতে ভাত খাওয়াল। আমি খুব সহজেই ফিরে গেলাম আমার শৈশবে। খাওয়ার পর মায়ের সাথে এটা-সেটা অনেক আলাপ হলো। রাত তখন দশটা।
মা বলল, ‘অয়ন, ঘুমিয়ে পড়।’

আমি বললাম, ‘মা, আমার ঘুম আসছে না। তুমি ঘুমাও। আমি কিছুক্ষণ বই পড়ব।’
অপুর বই দুটো নিয়ে আমি বিছানায় গেলাম। একটা বইয়ের নাম ‘অব্যক্ত’। লেখক জগদীশচন্দ্র বসু। আরেকটি বইয়ের নাম ‘A brief history of time: From big bang to black holes.’ লেখক এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংস।
আমি ‘অব্যক্ত’ বইটা পড়া শুরু করলাম।

স্যার জগদীশচন্দ্র বসু একজন বড় মাপের বিজ্ঞানী, এটা আমি জানতাম। কিন্তু তিনি যে একজন বড় মাপের লেখকও, এটা আমি জানতাম না। জানলাম বইটি পড়ার পর। বিশেষ একটি অধ্যায়ের বিশেষ কিছু অংশের কথা উল্লেখ না করলেই নয়।
এখানে স্যার জগদীশচন্দ্র বসু লিখেছেন:
‘গাছেরা কি কিছু বলে?
অনেকে বলিবেন, এ আবার কেমন প্রশ্ন?
গাছ কি কোনো দিন কথা কহিয়া থাকে?
মানুষেই কি সব কথা ফুটিয়া বলে?
আর যাহা ফুটিয়া বলে না, তাহা কি কথা নয়?

আমাদের একটি খোকা আছে, সে সব কথা ফুটিয়া বলিতে পারে না; আবার ফুটিয়া যে দুই-চারিটি কথা বলে, তাহাও এমন আধ-আধ ও ভাঙ্গা-ভাঙ্গা যে, অপরের সাধ্য নাই তাহার অর্থ বুঝিতে পারে। কিন্তু আমরা আমাদের খোকার সকল কথার অর্থ বুঝিতে পারি।

কেবল তাহা নয়। আমাদের খোকা অনেক কথা ফুটিয়া বলে না; চক্ষু, মুখ ও হাত নাড়া, মাথা নাড়া প্রভৃতির দ্বারা আকার-ইঙ্গিতে অনেক কথা বলে, আমরা তাহাও বুঝিতে পারি, অন্যে বুঝিতে পারে না। একদিন পার্শ্বের বাড়ি হইতে একটি পায়রা উড়িয়া আসিয়া আমাদের বাড়িতে বসিল; বসিয়া গলা ফুলাইয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিল। পায়রার সঙ্গে খোকার নতুন পরিচয়; খোকা তাহার অনুকরণে ডাকিতে আরম্ভ করিল। পায়রা কি-রকমভাবে ডাকে? বলিলেই ডাকিয়া দেখায়; তদ্ভিন্ন সুখে দুঃখে, চলিতে বসিতে, আপনার মনেও ডাকে। নতুন বিদ্যাটা শিখিয়া তাহার আনন্দের সীমা নাই।

একদিন বাড়ি আসিয়া দেখি, খোকার বড় জ্বর হইয়াছে; মাথার বেদনায় চক্ষু মুদিয়া বিছানায় পড়িয়া আছে। যে দুরন্ত শিশু সমস্ত দিন বাড়ি অস্থির করিয়া তুলিত, সে আজ একবার চক্ষু খুলিয়াও চাহিতেছে না। আমি তাহার বিছানার পাশে বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলাম। আমার হাতের স্পর্শে খোকা আমাকে চিনিল এবং অতি কষ্টে চক্ষু খুলিয়া আমার দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিল। তারপর পায়রার ডাক ডাকিল। ওই ডাকের ভিতর আমি অনেক কথা শুনিলাম।

আমি বুঝিতে পারিলাম, খোকা বলিতেছে, ‘খোকাকে দেখিতে আসিয়াছ? খোকা তোমাকে বড় ভালোবাসে।’
আরও অনেক কথা বুঝিলাম, যাহা আমিও কোনো কথার দ্বারা বুঝাইতে পারি না।
যদি বল, পায়রার ডাকের ভিতর এত কথা কি করিয়া শুনিলে?
তাহার উত্তর এই- খোকাকে ভালোবাসি বলিয়া।
তোমরা দেখিয়াছ, ছেলের মুখ দেখিয়া মা বুঝিতে পারেন, ছেলে কী চায়। অনেক সময় কথারও আবশ্যক হয় না। ভালোবাসিয়া দেখিলেই অনেক গুণ দেখিতে পাওয়া যায়, অনেক কথা শুনিতে পাওয়া যায়।’
বইয়ের এই পাতাগুলো পড়ে আমি মুগ্ধ, আমি বিমোহিত!

আমার মনে হলো, ভালোবাসি বলেই হয়তো বাবা-মায়ের সব কথা বুঝি। ভালোবাসি বলেই হয়তো নদীর না বলা কথাগুলোও অনুভবে মিলিয়ে নিতে পারি। ভালোবাসি বলেই হয়তো বুঝতে পারি অপুর না বলা কথাগুলোও। এই ভুবনে ভালোবাসাই যে সব!
আমি বইটা বন্ধ করলাম।
আর মনে মনে ভাবলাম:
আচ্ছা, এই যে জগৎ, এই যে মহাবিশ্ব, এই যে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, এগুলো সৃষ্টির মূলেও কি ভালোবাসা ছিল?
আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশাল এক বিস্ফোরণ থেকে এই মহাবিশ্বের শুরু। ওই বিস্ফোরণের নাম ‘বিগ ব্যাং’। কিন্তু বলতে পারছেন না বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল?
বিগ ব্যাংয়ের আগে কি ভালোবাসা ছিল?
আমি জানি না!
তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে!
আমার মনে হয় কেউ একজন ছিল।
তার অনন্ত ভালোবাসা ছিল।
প্রচণ্ড ভালোবেসে তিনিই ঘটিয়েছিলেন প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।

আচ্ছা, আমি কি গড, ভগবান বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছি!
করেছি হয়তো-বা!
ক্ষতি কী!
চলবে……
সিনহা মনসুর।