সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: পনের
অয়নের ডায়েরি
শনিবার
১১ই আগস্ট ১৯৮৪।
নদী, রনি আর শামিমের সাথে আড্ডা মারতে মারতে সময় হলো দুপুর বারোটা চলি¬শ। একটার সময় একটা ক্লাস আছে।
রনি আর শামিম বলল, ‘অয়ন, ক্লাসে যাবি?’
আমি বললাম, ‘না, আজ মানসিক প্রস্তুতি নেই। আজ আর ক্লাসে যাব না।’
নদী বলল, ‘অয়ন, আমি ভুল করে আমার হ্যান্ড ব্যাগটা লাইব্রেরিতে রেখে এসেছি। তুমি কি আমার সাথে আসবে লাইব্রেরি পর্যন্ত? ওখান থেকেই আমি ক্লাসে চলে যাব।’

শামিম আর রনিকে ক্যাফেটেরিয়ায় রেখে আমি নদীকে নিয়ে এগোলাম লাইব্রেরির দিকে। লাইব্রেরির বারান্দায় এসে নদী বলল, ‘অয়ন, ব্যাগের ভেতরে তোমার জন্য একটা গিফট আছে। তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি চট করে ব্যাগটা নিয়ে আসি।’
কথাটা বলেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল নদী। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বারান্দায়। ঠিক তখনই আমার মনে পড়ল গত রাতের স্বপ্নটার কথা। স্বপ্নেও নদী গিফট আনার কথা বলে চলে গিয়েছিল লাইব্রেরির ভেতরে।
আর ফেরেনি।
আজ কি ফিরবে!
স্বপ্নের নদী ফেরেনি!
বাস্তবের নদী কি ফিরবে?
নাকি এটাও স্বপ্নের অংশ?

আমি নিজেই নিজেকে চিমটি কাটলাম। বুঝলাম, এটা স্বপ্ন নয়!
ঠিক তখনই নদীকে দেখলাম বারান্দায়। নদী আমার হাতে ছোট্ট একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, ‘অয়ন, প্যাকেটটা বাসায় গিয়ে খুলবে, এখন না।’
আমি বললাম, ‘না, এখনই খুলব।’
বলেই আমি প্যাকেটটা খুলে ফেললাম। ওখানে হালকা নীল রঙের একটা বাহারি ক্যাপ।
নদী বলল, ‘অয়ন, কেমোথেরাপির পরপরই তোমার চুল হালকা হয়ে গেছে। সেজন্যই ক্যাপটা কিনেছি তোমার জন্য। তোমার পছন্দ হয়েছে?’
লাইব্রেরির বারান্দায় কেউ নেই।
কেউ নেই আশপাশেও।
আমি আলতো করে হাত রাখলাম নদীর ঘাড়ে।
চিবুক ছুঁয়ে বললাম, ‘নদী, ক্যাপটা খুবই সুন্দর! তুমি আমার কথা এত ভাবো?’
নদী বলল, ‘অয়ন, আমি তোমাকে অনেক, অনেক ভালোবাসি। তুমি নিজের প্রতি খেয়াল রেখো। আবার দেখা হবে।’
নদীর চোখের কোণে কি হালকা জল চিকচিক করছিল!
নাকি আমারই দেখার ভুল।

নদী চলে গেল ক্লাসের দিকে। আমি তাকিয়ে রইলাম ওর চলে যাওয়া পথের দিকে। দেখতে দেখতে নদী অদৃশ্য হয়ে গেল!
লাইব্রেরির বারান্দা থেকে আমি নেমে এলাম ক্যাম্পাসের মূল রাস্তায়। ওটা ছিল ফাগুনের মধ্যদুপুর। আকাশের দিকে তাকালাম। হালকা নীল আকাশ। ওই আকাশে পেঁজা তুলোর মতো ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। ফাগুনের ওই মেঘে কখনো বৃষ্টি হয় না।
মেঘগুলোর কোনো তাড়া নেই। ধীর লয়ে ওরা যাচ্ছে এপাশ থেকে ওপাশে।
তাড়া নেই আমারও!
ড্রাইভার চাচা আসবেন তিনটার দিকে। হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে। হাঁটতে হাঁটতেই চলে এলাম ক্যাম্পাসের মূল গেটে। রাস্তার ওপাশে এস এম হল। এস এম হলের ডান দিকে ফুলার রোড।
ওই রাস্তাটা আমার খুব প্রিয়। নদী আর আমি অনেক হেঁটেছি ওই রাস্তায়।আমার মনে হলো, কত দিন ওই রাস্তায় হাঁটি না।
কত দিন রোদে ভিজি না!
আজ রাস্তায় হাঁটব!
আজ রোদে ভিজব!

সন্তর্পণে রাস্তা পার হয়ে চলে এলাম এপাশটায়। এস এম হলকে বাম দিকে রেখে ঢুকে পড়লাম ফুলার রোডে। রোদটা খুব ভালো লাগছে। রাস্তায় কোনো গাড়িঘোড়া নেই। মাঝে মাঝে দুয়েকটা রিকশা যাচ্ছে। রাস্তার দুপাশে বিশাল বিশাল গাছ। বিশাল বিশাল তার ছায়াও। ওই গাছের পাতায় হাওয়া ঝিরঝির করছে।
ওই গাছগুলোর বয়স কত!
একশো, দুশো, নাকি আরো বেশি!
গাছেরা কত বছর বাঁচে!
কোথাও কোকিল ডাকছে। থেমে থেমে। কোনো গাছেই কোকিল দেখতে পাচ্ছি না। অথচ ওদের ডাক শুনছি। মনটা উদাস হলো। এই নির্জন রাস্তায় এক ভরদুপুরে আমি নদীকে শুনিয়েছিলাম জীবনানন্দ দাশের কবিতার কয়েকটি পঙক্তি:
‘আমাকে তুমি দেখিয়েছিলে একদিন;
মস্ত বড় ময়দান-দেবদারু পামের নিবিড় মাথা-মাইলের পর মাইল
দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়;
জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;
জানালায় জানালায় অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে:
পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়’!

হাঁটতে হাঁটতেই আমি ভাবি, মায়াবী নদীপারের ওই পৃথিবীটা এখন আমার বড় অচেনা, বড় দূরের।
মনে হয় ওই পৃথিবীর সাথে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই!
লেনদেন নেই!
নেই কোনো বোঝাপড়া!
অথবা নেই কোনো দায়।
জীবন এমন কেন!
আমি হাঁটছি। আমার বাম পাশে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দেখে আবারও মনে পড়ল নদীর কথা। এইতো বছর দুয়েক আগের কথা। নদীর সাথে আমার তখন নতুন পরিচয়, নতুন সখ্য, নতুন প্রেম!
আমরা তখন প্রায়ই ছবি দেখি। কখনো ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টারে। কখনো রাশান কালচারাল সেন্টারে। আবার কখনো-বা এই ব্রিটিশ কাউন্সিলে!
এক বিকেলে নদীকে নিয়ে এই লাইব্রেরিতে এলাম। হামফ্রে বোগার্ট ও ইনগ্রিড বার্গম্যান অভিনীত অস্কারজয়ী ছবি ‘কাসাবøাঙ্কা’ দেখতে।

ছবিটি পৃথিবীর সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের একটি। ‘কাসাবøাঙ্কা’ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার ঘটনা। সারা ইউরোপে তখন জার্মান-ভীতি। কিন্তু আমেরিকা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেকটা নিরাপদ। ফলে ইউরোপিয়ানদের মধ্যে পালিয়ে আমেরিকায় যাবার হিড়িক পড়ে যায়।আমেরিকা যাবার জন্য এ সময় ইউরোপিয়ানরা ভিড় জমাত মরক্কোর একটি শহর কাসাবøাঙ্কায়। ওই সময়ে কাসাব্লাঙ্কায় জমজমাট ব্যবসা চালাচ্ছিলেন ছবির নায়ক রিক বেøইন। তিনি জন্মসূত্রে আমেরিকান।

কাসাবøাঙ্কা ছবির নায়ক রিক ব্লেইনের সাথে দেখা হয় ছবির নায়িকা এলিসা লিন্ডের। কিন্তু এটাই ওদের প্রথম দেখা নয়। প্রথম দেখা প্যারিসে! ওখানেই ওদের সখ্য আর গভীর প্রেম। বহু বছর পর আবার দেখা কাসাব্লাঙ্কায়। দেখা হওয়ার পর দুজনেরই মনে পড়ে যায় প্যারিসে ওদের মধুর সময়গুলোর কথা।
আহা! কী সব দিন ছিল!
ভালোবাসার ওই দিনগুলোতেই প্যারিস আক্রমণ করে জার্মান বাহিনী। একদিকে মৃত্যুর হাতছানি আর অন্যদিকে প্রেম। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওরা দুজনে সিদ্ধান্ত নেয়, দ্রæত প্যারিস ছেড়ে পালাতে হবে। ঠিক করে ওরা বিয়ে করবে। কখন কোথায় উপস্থিত হবে, কিভাবে শেষ ট্রেনে করে ওরা পালাবে, তাও ঠিক করে ফেলে।
স্টেশনে রিক অপেক্ষা করে এলিসার জন্য।কিন্তু এলিসা আসে না।
আসে বৃষ্টির জলে ভেজা এলিসার চিঠি।

চিঠিতে এলিসা জানায়, ‘রিক, আমি তোমার সাথে যেতে পারব না। তোমার সাথে আমার আর দেখাও হবে না। কারণটা তুমি আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। শুধু এটুকু জেনো আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
সেটা ছিল প্যারিস থেকে শেষ ট্রেন। সেটাতে করে প্যারিস থেকে পালিয়ে না গেলে জার্মান বাহিনীর হাতে বন্দী হতে হবে অথবা মরতে হবে। তাই রিক সেই ট্রেনে করেই প্যারিস ছেড়ে চলে যায়।
বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রেমিক-প্রেমিকা। কাসাব্লাঙ্কায় যখন রিকের সাথে এলিসার দেখা, তখন এলিসার সাথে ওর স্বামী আছে। প্যারিসের সেই পুরনো দিনগুলো নিয়ে রিকের মনে কতশত প্রশ্ন!
সেদিন কী এমন হয়েছিল?
কেন আসেনি এলিসা?
কেন তাকে স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখল?
একেবারে শেষ মুহূর্তে কেন জানাল তার সাথে যেতে পারবে না?
আর কেনই-বা এত দিন পর এলিসা এল এই কাসাব্লাঙ্কায়?

ধীরে ধীরে ওদের কথাবার্তায় উন্মোচিত হলো সেই সব না বলা কথা। আর সেই সময়ের পরিস্থিতি। এলিসা জানাল, প্যারিসে যখন তাদের প্রেম হচ্ছিল, তখনো সে ছিল বিবাহিতা। ওর স্বামী ছিল জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী।
তার সাথে এলিসার কোনো যোগাযোগই ছিল না। সে জানত না তার কোনো খবর। তবে লোকমুখে শুনেছিল যে জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে পালানোর সময় গুলিতে মারা গেছে ওর স্বামী। কিন্তু আসলে সে মারা যায়নি। ওখানেই ঘটল সব বিপত্তি। পরের কাহিনিটা আরো জটিল। এলিসা আর তার স্বামী কাসাব্লাঙ্কায় এসেছে আমেরিকায় পালিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু নানা সমস্যায় তারা যেতে পারছে না। ওই সময় রিকের হাতে অনেক ক্ষমতা। সে চাইলে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে এলিসার স্বামীকে বিপদে ফেলতে পারে। এলিসার স্বামীকে কাসাব্লাঙ্কায় রেখে এলিসাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে আমেরিকায়। আবার ইচ্ছা করলে শুধু ওদের দুজনকেও পাঠিয়ে দিতে পারে আমেরিকায়।

ছবির এই পর্বে এসে আমি নদীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নদী, তোমার কী ধারণা, কী করবে রিক? ও কি এলিসার স্বামীকে ধরিয়ে দেবে? মেরে ফেলবে? নাকি এলিসাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে আমেরিকায়?’
নদী বলল, ‘আমার ধারণা, রিক এলিসাকে নিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে যাবে।’
আমি বললাম, ‘আমার তা মনে হয় না।’
নদী বলল, ‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি, রিক এলিসাকে নিয়ে পালাবে।’
রিক এলিসাকে নিয়ে পালায়নি। এলিসার স্বামীকে বিপদেও ফেলেনি। বরং ঝুঁকি নিয়ে ওদের দুজনকেই আমেরিকাগামী বিমানে তুলে দিয়েছে।জীবনযুদ্ধে জয়ী রিক, প্রেমের যুদ্ধে হারল!
আসলেই কি হারল!
তা জানি না।
নদীর সাথে আমি বাজিটা জিতেছিলাম।বাজিতে হেরে নদী নিজেই আমাকে একটা চুমু উপহার দিয়েছিল।
যৌবনের প্রথম চুমু।
আহা!
কী সব আলোকিত দিন ছিল ওইসব!
যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ!
আমার অনাগত খারাপ দিনগুলোর কথা ভেবে ভেবে আমি শিউরে উঠি। আমি শিউরে উঠি!
জীবন এমন কেন! (চলবে)