সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: বারো
অয়নের ডায়েরি
বুধবার
১৮ই জুলাই ১৯৮৪
রাত দশটা।
আমার ঘুম ভাঙল সন্ধের অনেক পর। ঘরের ভেতরে তীব্র অন্ধকার।
মনে মনে ভাবলাম, এত অন্ধকার কোথা থেকে এল?
আচ্ছা, কবরের ভেতরে কি এমন অন্ধকার থাকে?
না এর চেয়েও বেশি অন্ধকার? অন্ধকারেই কি আলোর বাস?
আমি যখন এই সব উথালপাতাল চিন্তা করছি, ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল।
আমি বললাম, ‘কে ওখানে?’
ওপাশ থেকে বলল, ‘অয়ন, দরজা খোল’।

লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুললাম। অপু, শামিম আর জালাল এসেছে। এখন সময় রাত নয়টা। মা আমাদের রাত জাগার প্ল্যানটা জানতেন, তাই ইচ্ছে করেই আমাকে ডাকেননি।
রাতের খাবার সেরে আমরা গল্প-গুজব করলাম অনেকক্ষণ। তারপর যখন ছাদে উঠে এলাম তখন ঠিক মধ্যরাত। আজ মনে হয় অমাবস্যার রাত। চারদিকে গা ছমছম করা অন্ধকার!
কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাদের মন ভালো হয়ে গেল! আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা!
এক আকাশে, একসাথে এত তারা দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। উদ্বেলিত হলাম!
টেলিস্কোপে চোখ রেখে আমরা খুঁজে বের করলাম সপ্তর্ষিমণ্ডলকে, খুঁজে বের করলাম কালপুরুষকে!

নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে চোখ রেখেই আমি বললাম, ‘অপু, ওই সপ্তর্ষির থেকে, ওই কালপুরুষ থেকে কিছু আলো বের হয়ে ভ্রমণ করেছে হাজার হাজার আলোকবর্ষ! তারপর এসে দৃশ্যমান হয়েছে আমাদের চোখে। তার মানে, আমরা যেই সপ্তর্ষি বা যেই কালপুরুষের দিকে তাকিয়ে আছি, সেটি হাজার হাজার বৎসরের পুরনো সপ্তর্ষি। হাজার হাজার বৎসরের পুরনো কালপুরুষ। আমরা দিব্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সুদূর অতীতে। হাজার আলোকবর্ষ দূরের ওই তারার দিকে তাকানো মনেই তো অতীতের দিকে তাকানো’!

অপু বলল, ‘কি জানিস অয়ন, আমরা তাকিয়ে আছি অতীতে। দাঁড়িয়ে আছি বর্তমানে। আর আমাদের স্বপ্ন আমাদের নিয়ে ভেসে চলেছে সামনের ভবিষ্যতের দিকে।’
আমি বললাম, ‘অপু, অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের এই যে অদ্ভুত মিলন, সেই মহামিলনে আমি বা আমাদের অবস্থান কোথায়, বলতে পারিস?’
অপু বলল, ‘আমি জানি না, অয়ন। তবে খুব জানতে ইচ্ছে হয়। সময়, মহাশূন্য অথবা মহাকাল কি এর উত্তর জানে? হয়তো জানে, হয়তো বা জানে না’!

শামিম বলল, ‘অপু, আমরা কেউই এর উত্তর জানি না। তবে আমি নিশ্চিত, একজন এর উত্তর জানেন যিনি সময়, মহাশূন্য ও মহাকাল নিয়ে মস্ত এক খেলায় মত্ত। মহান সেই খেলোয়াড় যিনি, তার সৃষ্টিকে উদ্দেশ করে বলেছেন:
‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে
এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নিশিখা থেকে
অতএব তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার
কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?
তিনি দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের মালিক
অতএব তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার
কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?
তিনি পাশাপাশি দুই দরিয়া প্রবাহিত করেছেন
উভয়ের মাঝখানে রয়েছে অন্তরাল, যা তারা অতিক্রম করে না।
অতএব তোমার উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার
কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করিবে?’
শামিমের এই কথার পর আমাদের মধ্যে নীরবতা নেমে এল।
কয়েক মিনিট আমরা থমকে গেলাম!
কেউই কিছু বললাম না অথবা বলতে পারলাম না!
নীরবতা ভাঙল জালাল।

আকাশের দিকে তাকিয়ে জালাল বলল, ‘আচ্ছা অপু, ওই যে আকাশ, ওই যে নক্ষত্ররাজি, ওই যে মহাবিশ্ব, ওটা কত দূর বিস্তৃত? ওটা কি অসীম না সসীম?’

অপু বলল, ‘কি জানো জালাল, একটা সময় ছিল যখন ধারণা করা হতো, এই মহাবিশ্ব সসীম। ওর সীমানা আছে। গেল শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি, ১৯২৫ সালে, বিজ্ঞানী এডুইন হাবলই প্রথম ইঙ্গিত দেন যে মহাবিশ্ব সীমাহীন! এবং ক্রমশ স¤প্রসারণশীল!
তিনি তার মতবাদে বলেন যে, পৃথিবী থেকে হাজার হাজার আলোক যুগ দূরে রয়েছে অসংখ্য ছায়াপথ। ওই ছায়াপথগুলো গতিশীল। গতিশীল ওই ছায়াপথগুলোর গতিবেগ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এরা পরস্পর পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের মধ্যকার দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছেই, অর্থাৎ মহাবিশ্ব ক্রমশই স¤প্রসারণশীল’!
জালাল বললো, ‘কিন্তু কোথা থেকে এল এই স¤প্রসারণশীল মহাবিশ্ব?’
উত্তরে অপু বলল, ‘বিজ্ঞানীরা এই মহাবিশ্বের অতীত বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সমগ্র মহাবিশ্ব একটি সুপ্রাচীন বিন্দু অবস্থা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। ওই বিন্দু অবস্থায় জগতের সকল পদার্থ ও শক্তি অতি উত্তপ্ত এবং ঘন অবস্থায় ছিল। কিন্তু এ অবস্থার আগে কী ছিল, তা নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো ঐকমত্য নেই। অবশ্য সাধারণ আপেক্ষিকতা এর আগের সময়ের ব্যাখ্যার জন্য মহাকর্ষীয় অদ্বৈত বিন্দু বা ‘সিঙ্গুলারিটি’ নামক একটি মতবাদের প্রস্তাব করা করেছে। সিঙ্গুলারিটি হচ্ছে এমন একটা সময় বা এমন একটা অবস্থা, যেখানে পদার্থবিদ্যার কোনো সূত্রই কাজ করে না। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আজ থেকে চৌদ্দশো কোটি বছর আগে ছিল ওই সময়টা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ওই অবস্থা থেকে এই বিশ্বের জন্ম!

জন্ম এক মহাবিস্ফোরণের ফলে!
যে বিস্ফোরণের নাম ‘বিগ ব্যাং’!
অতি আধুনিক বিজ্ঞানীরা অবশ্য সাইক্লিক ইউনিভার্স বা পৌনঃপুনিক ব্রহ্মাণ্ডের ধারণাও দিয়েছেন। এই ধারণা দিতে গিয়ে তারা কাজে লাগিয়েছেন পদার্থবিদ্যার আধুনিক আইডিয়া স্ট্রিং থিয়োরি। যে থিয়োরি অনুযায়ী, পদার্থের ক্ষুদ্রতম উপাদান কোনো কণা নয়, ওটা হচ্ছে সুতোর মতো এক বস্তু। ওদের মতে, বিগ ব্যাং একটা নয়, হয়েছে একের পর এক! এই নক্ষত্রবীথি আর এই মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে বারবার’!
জালাল বললো, ‘অপু, ওই বিন্দুটা কোথা থেকে এল? ওই বিস্ফোরণটাই-বা কে ঘটাল?’
শামিম মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। এবার মুখ খুলল।

শামিম বলল, ‘জানিস অয়ন, জটিল এই ব্যাপারগুলো আমাদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থে কখনো সরাসরি, আবার কখনো-বা রূপক হয়ে এসেছে। এই গ্রন্থের নাম কোরআন। এর প্রণেতা কোনো মানুষ নন। কোরআন হচ্ছে সরাসরি আল্লাহ’র বাণী। আজ থেকে পনেরোশো বছর আগে এগুলো নাজিল হয়েছে আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওপর। আজ থেকে পনেরোশো বছর আগে, ওই কোরআনে আল্লাহ বলেছেন:
আমি স্বীয় ক্ষমতাবলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমি অবশ্যই এর প্রসারণকারী!
আজ থেকে মাত্র একশো বছর আগেও পৃথিবীর কোনো বিজ্ঞানীই যে কথা বলতে পারেননি, পনেরোশো বছর আগে পবিত্র কোরআনে তা স্পষ্ট করে বলেছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা’!
সৃষ্টিকর্তা আরো বলেছেন:
‘কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এর পরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না!
এখানে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তের কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে’!
কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনলাম আমি।
তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই মহাবিস্ফোরণের পর আর কী কী হয়েছিল?’

অপু বলল, ‘বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিস্ফোরণের পর দীর্ঘকাল মহাবিশ্ব ধোঁয়াময় অবস্থায় ছিল এবং পরে তা একত্রে ঘনীভূত হয়ে গ্রহ-উপগ্রহ আর অনন্ত নক্ষত্রবীথি তৈরি হয়।
শামিম বলল, ‘এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:
‘অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন, যা ছিল ধূম্রকুঞ্জ, অতঃপর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা স্বেচ্ছায় আসলাম’!
অপু বলল, ‘বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব সৃষ্টির এই সময়টাকে ছয়টি ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো:
টাইম জিরো
ইনফেলেশন
অ্যানিহাইলেশন
প্রোটন ও নিউট্রন
অ্যাটমিক নিউক্লিয়া এবং স্ট্যাবল অ্যাটম!
শামিম বলল, ‘পবিত্র কোরআন বলছে:

‘তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন ছয়টি খণ্ডিত সময়ে। অতঃপর আরশের ওপর সমাসীন হয়েছেন। তিনি জানেন যা ভূমিতে প্রবেশ করে ও যা ভূমি থেকে নির্গত হয় এবং যা আকাশ থেকে বর্ষিত হয় ও যা আকাশে উত্থিত হয়। তিনি তোমাদের সাথে আছেন তোমরা যেখানেই থাকো। তোমরা যা করো, আল্লাহ তা দেখেন’!
শামিমের মুখে পবিত্র কোরআনের এই সব কথা শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম:
‘আমি অয়ন। বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। আমি তো ঈশ্বর মানি না!
নিয়তি মানি না!
আমি বিশ্বাস করি কর্ম!
আমার কাছে কর্মই ধর্ম!
আবার আরেক মনে ভাবি:
সৃষ্টিকর্তা কি আসলেই আছেন? তিনি কি আসলেই দেখেন?
কী দেখেন?
কিভাবে দেখেন?
কখন দেখেন?
তিনি কি আসলেই সময়, মহাশূন্য ও মহাকাল নিয়ে বিরাট এক খেলায় মত্ত?
তিনি কি দেখছেন আজ এই অন্ধকার রাতে অনন্ত নক্ষত্রবীথির তলে দাঁড়িয়ে আছে চার যুবক!
ওই চার যুবকের মধ্যে রয়েছে ‘অয়ন‘ নামের এক যুবক!
ওই যুবকের নদী নামে একজন প্রেমিকা আছে। ওই যুবকের অপুর মতো, শামিমের মতো,জালালের মতো কিছু বন্ধু আছে?
আছে মা, আছে বাবা!
কিন্তু তার পরও ওই যুবককে বড় অসময়ে, বড় সহসাই চলে যেতে হবে অজানা এক ভুবনে!
ওই যুবকের খেদ, ওই যুবকের দুঃখ, ‘হায়! জীবন এত ছোট কেন’! চলবে….