সিনহা আবুল মনসুর : বৌদ্ধ ধর্মমতে অয়নের শেষকৃত্য হয়ে গেল ঢাকা থেকে দুশো চল্লিশ মাইল দূরে, চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে। অয়নের দাদাবাড়ি ওই শহরে। আত্মীয়স্বজনদের বেশির ভাগই ওখানকার বাসিন্দা। ঢাকা থেকে গেলাম শামিম আর আমি। শামিম আর অয়ন দুজনেই ছিল বুয়েটে, স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে। আর আমি ময়মনসিংহ চিকিত্সা মহাবিদ্যালয়ে। আমরা তিনজন স্কুল-বন্ধু।

আমার ধারণা ছিল অয়নকে ওরা পোড়াবে। না, পোড়ায়নি। অয়নকে ওরা মাটিতেই কবর দিল। পাহাড়তলীর বৌদ্ধমন্দিরের পাশে বিশাল এক কবরস্থান। ওখানেই চিরনিদ্রায় শুয়ে রইল অয়ন। শামিম আর আমি, আমরা দুজনে মিলে ওই কবরে ছোট্ট একটি চারাগাছ পুঁতে দিলাম।
শেষকৃত্য সেরে পরদিনই চলে এলাম ঢাকায়। তার পরের দিন চলে গেলাম হোস্টেলে। প্রাথমিক শোক কাটাতে কত দিন লেগেছিল তা মনে নেই, তবে এটুকু স্পষ্ট মনে আছে, প্রায়ই অয়নকে স্বপ্নে দেখতাম। স্বপ্নে কখনোই মনে হয়নি অয়ন মারা গেছে। স্বপ্নে আমরা দিব্যি গল্প করতাম। ঘুরে বেড়াতাম।

অয়নের জীবত্কালে শামিম আর অয়ন সময় পেলেই আমার হোস্টেলে যেত। আমরা তিনজন মিলে বেড়াতে যেতাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। ওখানে ছিল আমাদের কলেজের বন্ধু লিটন। লিটন কৃষি প্রকৌশল বিভাগে পড়াশোনা করত।
ক্যাম্পাসের ভেতরে ভারি সুন্দর একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন। বাগানের পাশেই ব্রহ্মপুত্র। খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র। এখনকার শুকিয়ে যাওয়া মরা ব্রহ্মপুত্র নয়। ওই নদীর পাড়ে বসে আমরা কত গল্প করেছি!

আমাদের গল্পের কোনো নির্দিষ্ট বিষয় থাকত না। কখনো বিষয় হতো সদ্য পড়ে ফেলা কোনো বই, কখনো ইতিহাসের কোনো অধ্যায়, কখনো-বা রাজনীতি। আবার কখনো কখনো ঢুকে পড়ত ধর্ম।
আমার মনে আছে, শেষবার যখন ওই বাগানে গেলাম, তখন ছিল বসন্তকাল। পড়ন্ত বিকেল। ঝিরঝির বাতাস। চারপাশটা ভর গেছে ফুলে ফুলে। লাল, নীল, হলুদ আর সাদা। কত বর্ণের, কত জাতের ফুল। কিছু চেনা, বেশির ভাগই অচেনা। নদীর পাড়েই দুটো বিশাল শিমুলগাছ। প্রচণ্ড শব্দ করে শিমুলের বীজ ফাটছে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলো ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।

আমার মনে হয়েছিল, আমরা যেন আছি স্বর্গীয় উদ্যানে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের আনন্দ, আমাদের উল্লাস।
অয়ন গেয়ে উঠল-
‘আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত পাখি গায়…’
দুই কলি গান গেয়ে অয়ন বলল, ‘জানিস অপু, পুনর্জন্মে আমি এই বাগানে ফিরে আসব। একবার-দুবার নয়, ফিরে আসব বারবার।’
শামিম বলল, ‘আচ্ছা অয়ন, তুই প্রায়ই পুনর্জন্মের কথা বলিস। ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করে বলবি।’
হাঁটতে হাঁটতেই আমরা এসে বসলাম নদীর পাড়ে। আমাদের পেছনে ক্যাম্পাস, সামনে ব্রহ্মপুত্র।
অয়ন বলল, ‘কি জানিস শামিম, কর্মই ধর্ম। তুই যদি ভালো কর্ম করিস, তাহলে পুনর্জন্মে ভালো হয়ে ফিরে আসবি। আর যদি খারাপ কর্ম করিস, তাহলে ফিরে আসবি খারাপ হয়ে। জন্ম, মৃত্যু আর পুনর্জন্মের এই চক্র চলতেই থাকবে। কয়টা চক্র চলবে তা আমি জানি না। তুই যদি ভালো কাজ করতে থাকিস, তাহলে একসময় এই চক্র ভেঙে যাবে। এর পরে মৃত্যুর হলে তুই নিভে যাবি চিরতরে, তোকে আর ফিরতে হবে না এই ভুবনে। চক্রের এই অংশের নাম ‘নির্বাণ।’ আমাদের লক্ষ্য ওই নির্বাণ স্তরে পৌঁছানো!’
অয়নের কথা শুনে শামিম আর আমি দুজনেই চমকালাম। অয়ন বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাস করে! ‘নির্বাণ’ এর ব্যাপারটা আমাদের দুজনের জন্যেই নতুন।
আমি বললাম, ‘অয়ন, তুই ঈশ্বর মানিস?’
অয়ন বলল, ‘জানিস অপু- হিন্দু, খ্রিষ্ট ও ইসলাম- এই তিন ধর্মেই সৃষ্টিকর্তা আছেন। ভিন্ন ভিন্ন নামে। খ্রিষ্টানরা বলে গড। মুসলমানরা বলে আল্লাহ। হিন্দুরা বলে ভগবান। খ্রিষ্টধর্মে যিশু গডের পুত্র, ইসলাম ধর্মে মুহম্মদ আল্লাহর দূত আর হিন্দুধর্মে কেউ কেউ আছেন ঈশ্বরের অবতার। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম উত্পত্তির মূলে কোনো আল্লাহ, গড বা ঈশ্বরের উপস্থিতি নেই। জীবনের অপরিসীম দুঃখবোধ, যাতনাবোধ এবং বিপন্ন বিস্ময়ই এই ধর্মের মূল সোপান।
শামিম বলল, ‘দুঃখবোধের ব্যাপারটা কী’?
অয়ন বলল, ‘আমাদের আছে চার সত্য। আমরা বলি আর্যসত্য।
এগুলো হচ্ছে:
দুঃখ
দুঃখের কারণ
দুঃখমুক্তি এবং দুঃখমুক্তির উপায়।
বৌদ্ধধর্মের সাথে দুঃখবোধের এই গভীর সম্পর্ক দেখে অনেকেই এটাকে বলেছেন ‘দুঃখবাদ’। দুঃখবোধ আর বিপন্ন বিস্ময়ের কারণেই রাজকুমার সিদ্ধার্থ রাজপ্রাসাদ ছেড়ে নেমে আসেন পথে। কঠিন তপস্যার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেন এক জীবনবোধ। এই জীবনবোধের মূলে আছে জীবের প্রতি অহিংসা, মৈত্রী আর করুণা।
কি জানিস শামিম, আমাদের দেবতা নেই, ব্রহ্মা নেই, ঈশ্বরও নেই। দেবতা দেবেন, ব্রহ্মা দেবেন আর ঈশ্বরও দেবেন, আমরা শুধুই নেব। এ আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা মানি যত তৃষ্ণা ক্ষয়, ততই সুখ, ততই শান্তি।’
আমি অয়নকে বলি, ‘তোরা নিয়তি বিশ্বাস করিস?’
অয়ন বলল, ‘না, আমরা নিয়তি বিশ্বাস করি না। যা কিছু ঘটে, তা কোনো কারণেই ঘটে, ভাগ্য দৈবে, অদৃষ্টে বা নিয়তিতে ঘটে না। আমাদের যাবতীয় দুঃখের কারণ তৃষ্ণা ও অবিদ্যা। দুঃখ ঈশ্বরের রুষ্টতা থেকে আসে না। ঈশ্বর মানুষের মনোজগতের কল্পনা মাত্র’!
গল্প করতে করতে কখন যে সন্ধে পেরিয়ে গেছে আমাদের খেয়াল নেই। ব্রহ্মপুত্রের ওপর ভেসে থাকা ছোট ছোট নৌকায় কুপি জ্বলে উঠেছে। কুপি জ্বলে উঠেছে ব্রহ্মপুত্রের ওপারে ছোট ছোট গ্রামগুলোতেও।
গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে এখানে-সেখানে দুয়েকটা কুপি। নদী ওপর জমে থাকা হালকা কুয়াশা।
আর মাঝে মাঝেই নদীর পাড় ভাঙার অকল্যাণ শব্দ। হঠাত করেই চারপাশটাকে মনে হলো অজানা, অচেনা আর অপার্থিব।
আমরা নিঃশব্দের পা বাড়ালাম চেনা শহর আর চেনা মানুষের দিকে! (চলবে)
পুনশ্চ: লেখাটি ভাল লাগলে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।