সিনহা আবুল মনসুর : (প্রস্তাবনা: অয়ন বড়ুয়া আমার ছেলেবেলার বন্ধু। কৌশরের বন্ধু। প্রথম যৌবনের বন্ধু। ওর সাথে পথ চলেছি এক যুগেরও বেশি। তারপর একদিন হঠাৎ পথটা আলাদা হয়ে গেল! ওরটা থেমে গেল মৃত্যুতে। অথবা চলে গেল অনন্তের দিকে। সিডি বেয়ে বেয়ে আমি নামলাম জীবনের পথে। ওই পথটা কখনো সোজা, কখনো বাঁকা! ওই পথে ফুল ছিল, কাঁটাও ছিল!
এইসব তো দুই যুগ আগের কথা!
অথচ মনে হয় এইতো সেদিন।
মাঝে মাঝে এও মনে হয়, অয়নের সাথে আমার এই যে বেডে উঠা, এই যে একসাথে পথ চলা তা কি আমার এই জীবনের ঘটনা না অন্য জীবনের? তা কি এই পৃথিবীর ঘটনা না অন্য পৃথিবীর?
অয়ন বলতো ‘জানিস অপু কর্মই জীবন! এই জীবনে তুই যদি ভাল কিছু করিস, তাহলে পরের জন্মে তুই ভাল কিছু হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবি’!
আমার আশেপাশের জন সমুদ্রে লক্ষ কোটি মানুষ। হঠাৎ হঠাৎ দু’য়েকটা ভাল মানুষ চোখে পড়ে।
আমার মনে হয় ওই মানুষটি কি অয়ন!
অয়নের মৃত্যুর পরে ওর লেখা একটি ডায়েরী অয়নের মা আমার হাতে তুলে দেন। ওই ডায়েরীতে অয়ন অনেক প্রশ্ন করেছে! সব প্রশ্নের উত্তরের আমি জানি না। উত্তর জানার জন্যে আমি বিজ্ঞানের কাছে গিয়েছি, ধর্মের কাছে গিয়েছি, ইতিহাসের কাছে গিয়েছি। বিজ্ঞান কিছু উত্তর দিয়েছে, ধর্ম কিছু উত্তর দিয়েছে, ইতিহাসও কিছু উত্তর দিয়েছে। কিন্তু পুরো উত্তর পাইনি!
পাঠকের কাছে এর উত্তর আছে কি?
হয়তো বা!
সেই প্রত্যশায় অয়নের গল্পটি আপনাদের সাথে ধারাবাহিকভাবে ভাগাভাগি করলাম!)
জীবন এতো ছোট কেন!
পর্ব: এক
তেইশ বছর বয়সে শরতের এক ভোরে অয়ন মারা গেল! পুবের আকাশটা তখন রক্তিম। সূর্যটা যেন ঠিক ডিমের কুসুম। বাতাসে হালকা হিম। ঘাসের ওপর শিশিরের জড়াজড়ি। যেসব পাখি গত রাতে নীড়ে ফিরে গিয়েছিল, ওরা ফিরে আসতে শুরু করেছে লোকালয়ের দিকে। জনপদের দিকে। পাখিরা হয়তো পছন্দ করে মানুষের সাহচর্য! পেছনের বাগানে, শিউলিতলা ভরে গেছে ফুলে ফুলে। দূরদূরান্ত থেকে শেফালি বালিকারা এসেছে শিউলি কুড়োতে।
সকালের সোনারোদ ঝরে পড়ছে ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরে। ওখান থেকে ওরা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
কী সুন্দর এই সকাল!
কী শুদ্ধ এই চরাচর!
সকালের এই সোনারোদ, বাতাসের হালকা হিম, পাখিদের উষ্ণতা অথবা কমলা-বোঁটার সফেদ শেফালি, কোনোটাই অয়নকে ধরে রাখতে পারল না।
অয়ন যাত্রা শুরু করল অনন্তের দিকে। অন্ধকারের দিকে!
অন্ধকার না আলোর দিকে?
আচ্ছা, মৃত্যু কি আলো না অন্ধকার?
মৃত্যু কি জীবনের শেষ না শুরু?
মৃত্যু যদি জীবনের শেষ হয়, তাহলে ঈশ্বর কে?
কোথায় থাকেন?
পাপ-পুণ্য, হিসাব-নিকাশ এগুলো কী? কখন হয়?
আবার মৃত্যু যদি জীবনের শুরু হয়, তাহলে পৃথিবীর এই জীবনটা কী?
এটা কি মৃত্যুর পরের ওই অনন্ত জীবনের ছোট্ট ভূমিকা?
বিশাল বইয়ে যেমন থাকে ছোট্ট একটি ভূমিকা অথবা উৎসর্গপত্র!
সামনের ইলেকট্রিক তারের ওপর একটি পাখি বসে আছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না চড়াই না শালিক। পাখিটা ধ্যানমগ্ন! হঠাৎ কোথা থেকে যেন আরেকটা পাখি উড়ে এসে বসল ওই পাখিটার পাশে। কানে কানে কী যেন বলল। তারপর দুজনেই উড়াল দিল।
আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম এগারোতলার ওই নিভৃত কোণে।
টানা বারান্দার ওপাশটায় কেবিন নম্বর এগারোশো তিন। ওখানেই লম্বালম্বিভাবে শুয়ে আছে একজন অয়ন।
অসুস্থ নয়, মৃত!
অয়ন যে মারা যাবে, এটা সে জানত। জানতাম আমি। জানত অয়নের চারপাশের সবাই। ওর ছিল লিউক্যামিয়া, শেষ পর্যায়ের!
মারা যাবার আগে খুব কম মানুষই নিজের মৃত্যুকে দেখতে পারে। অয়ন দেখেছিল। একবার নয়। দুবার নয়। অয়ন ওর মৃত্যুকে দেখেছে বারবার! শেষ দুই মাস যতবারই অয়নের মুখোমুখি হয়েছি, আমাদের সবার চোখেমুখে ছিল ভীতি আর শঙ্কা। এই শঙ্কা অয়নকে হারানোর। খুব সহজেই অয়ন পড়ে ফেলত ওই শঙ্কা! ওই ভীতি!
এইতো সেদিন অয়নকে দেখতে এলাম এই হাসপাতালেই। সন্ধ্যের একটু আগে। অয়ন ঘুমিয়ে ছিল। সিলিংয়ের দিকে মুখ। বালিশের মাঝখানে মাথা। দুপাশে দুহাত। গৌরবর্ণ মুখ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ঘুমের মধ্যেই ও যেন ককিয়ে উঠল একটু। মুহূর্তেই আমার মনে হলো বেদনাবিদ্ধ যিশু! আমি অসহায় তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
ধীর লয়ে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। হাত রাখলাম ওর কপালে। ঘুম ভাঙল অয়নের।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই কখন এলি?’
আমি বললাম, ‘এইতো।’
অয়ন বলল, ‘জানিস, খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। তুই আর আমি, দুজনে মিলে গিয়েছি চিম্বুক পাহাড়ে। বিশাল উঁচু সেই পাহাড়। ওই পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল এক বুদ্ধমূর্তি। বুদ্ধ বসে আছেন পদ্মাসনে। তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আমরা। ঠিক যেন গালিভারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লিলিপুট। আমরা ঘাড় কাত করে ওপরে তাকিয়ে আছি বুদ্ধের চোখের দিকে। তিনি যেন কথা বলছেন আমাদের সাথে। চোখের ভাষায়! তিনি যেন দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন আমাদের ভেতর!
আমাদের বাহির!
আমাদের সব!
পরিষ্কার শুনলাম তিনি যেন বললেন, ‘বেঁচে থাকো, দীর্ঘজীবী হও’!
আচ্ছা অপু, ‘চল না আমরা দুজনে মিলে যাই চিম্বুক পাহাড়ে। কথা বলে আসি ওই বুদ্ধমূর্তির সাথে’!
আমি বললাম, ‘অবশ্যই যাব, অয়ন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে প্রথমেই যাব চিম্বুক পাহাড়ে। তুই চাইলে দার্জিলিংও যেতে পারি। শুনেছি ওখানে আকাশে হেলান দিতে পাহাড় ঘুমায় আর পাহাড়ের ওপরে ঘুমায় মেঘ। পাহাড়ের ওপরে ছোট ছোট বাংলো।ওই বাংলোর জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে মেঘ। ওখানে যাবি, অয়ন?’
‘না, ওখানে যাব না, ওখানে তো বুদ্ধমূর্তি নেই। আমার যে ওই মূর্তিটার সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে। ওকে আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। অনেকবার স্বপ্নে বলতে চেয়েছি, পারিনি। বলার আগেই ঘুম ভেঙে যায়, স্বপ্ন ভেঙে যায়’!
কথাগুলো বলে আমার চোখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয় অয়ন। কী যেন লুকাতে চায়।
আমি বলি, ‘অয়ন, বুদ্ধমূর্তিকে তুই কী জিজ্ঞেস করতে চাস?’
এবার আমার চোখে চোখ রেখে অয়ন বলে, ‘বুদ্ধমূর্তিকে শুধু একটি অনুরোধ করব। তিনি যেন আমার হয়ে ভগবানকে জিজ্ঞেস করেন, ভগবান, কারো কারো জীবন এত ছোট কেন’?
অয়নের কথায় আমার মনটা ভেঙে যায়। চোখে জল আসে। চেষ্টা করেও লুকাতে পারি না ওই জল, অয়ন দেখে ফেলে। অয়ন আবারও দেখে ফেলে ওর মৃত্যুকে আমার চোখের জলে। অয়নকে নিয়ে চিম্বুক পাহাড় অথবা দার্জিলিং, কোথাও যাওয়া হয়নি। যেতে পারিনি!
তার আগেই অয়ন ছেড়ে গেল এই শহর! এই জনপদ আর এই ভুবন।
চলে গেল অন্য ভুবনে!
কেমন ওই ভুবন?
আমি জানি না! আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে! ওই ভুবনটা কি ত্রিমাত্রিক না চতুর্মাত্রিক?
ওটা কি থার্মো-ডাইনামিকসের দ্বিতীয় সূত্র মেনে চলে?
মেনে চলে আইনস্টাইনের থিয়োরি অব রিলেটিভিটি?
মেনে চলে নিউটনের মহাকর্ষসূত্র অথবা গতিসূত্র?
ওই ভুবনে কি ভালোবাসা আছে, মায়া আছে?
প্রতিযোগিতা আছে অর্থ, যশ প্রতিপত্তির?
আমাদের এই ভুবনের মতো ওই ভুবনটাও কি রিলেটিভ না অ্যাবসলিউট?
এগারোতলার ওই নিভৃত কোণে দাঁড়িয়ে আমি এই সব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাই না।ডুবে যেতে থাকি এক অন্তহীন বিষণতায়!এই অন্তহীন বিষণতার জন্ম এই ভুবনে নয়, ওই ভুবনেও নয়।এর জন্ম অন্য আরেক ভুবনে! চলবে
পুনশ্চ: লেখাটি ভাল লাগলে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।