অনলাইন ডেস্ক : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। গ্রেপ্তার হয়ে জামিন নিয়েছেন। জামিনের শর্ত ছিল ‘ঢাকা শহরে’ অবস্থান করতে হবে। না জানিয়ে এই শহরের বাইরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই শর্ত ভেঙে এবারের ঈদে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দলবেঁধে হাওরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই আসামি হলেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা জোবায়ের মনির। এ ঘটনায় চিন্তিত মামলার বাদী, সাক্ষী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা এলাকার লোকজন। তাঁরা বিষয়টি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর গণহত্যা চালায় রাজাকারেরা। একই সময়ে পেরুয়াসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীদের নির্যাতন করা হয়। স্থানীয় শ্যামারচর বাজারের পাশে মরা সুরমা নদীতে মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় পানিতে।
পেরুয়ায় গণহত্যার শিকার পরিারের সদস্য ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, পেরুয়ায় গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনে নেতৃত্বে দেন শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল খালেকের ভাই মুকিত মনির ও কদর আলী, তাঁর ছেলে প্রদীপ মুনির ও জোবায়ের মুনিরসহ শতাধিক লোক। আবদুল খালেক না থাকলেও এলাকায় এখনো প্রভাবশালী তাঁর পরিবার। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না। ২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর পেরুয়া গণহত্যা নিয়ে ‘পেরুয়াবাসীর স্বজন হারানোর দিন আজ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর মানুষজন মুখ খুলতে শুরু করেন।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি লিখিত অভিযোগ দেন পেরুয়া গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা রজণী দাস। এরপর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এই গণহত্যার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। এক পর্যায়ে এই গণহত্যায় যুক্ত থাকা ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় ট্রাইব্যুনাল থেকে। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর জোবায়ের মনির, জাকির হোসেন, তোতা মিয়া, সিদ্দিকুর রহমান, আবদুল জলিল, আবদুর রশিদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০১৯ সালের ১৭ জুন রজণী দাসের করা মামলায় জোবায়ের মনিরসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুর হোসেন।
জোবায়ের মনির অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ঢাকা শহরে নিজ বাসায় অবস্থান করবেন, শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারবেন না’—এই শর্তে ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন নিয়েছেন। কিন্তু তিনি জামিনের সেই শর্ত ভেঙে ঈদের আগের দিন শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে যান। ঈদের দিন পশু কোরবানি দিয়েছেন। এরপর নিজের লোকজনকে নিয়ে নৌকা ও স্পিডবোটে করে এলাকায় ঘুরেছেন। গত সোমবার তিনি এলাকা ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় শ্যামারচর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ওমরচান দাশ বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধ মামলার একজন আসামি জামিনের শর্ত ভেঙে এলাকায় এসে এভাবে প্রকাশ্যে নৌবিহার করে যাওয়ার ঘটনায় আমরা চিন্তিত। এটা মামলার বাদী, সাক্ষীদের প্রতি এক ধরনের হুমকি। ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আমরা আমাদের এই উদ্বেগের কথা তাদের জানিয়েছি।’
শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনজুর মোর্শেদ বলেন, ‘আমরা শুনেছি জোবায়ের মনির ঈদে বাড়িতে এসেছিলেন। বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে লিখিত প্রতিবেদন দেব।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা রজণী দাসের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুর হোসেন বলেন, অসুস্থতাজনিত মানবিক কারণ দেখিয়ে জোবায়ের মনির জামিন নিয়েছেন। জামিনের শর্ত অনুযায়ী তিনি ঢাকা শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারেন না। তিনি জামিনের শর্ত ভঙ্গ করেছেন। এলাকায় গিয়ে মামলায় বাদী, সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। স্থানীয় পুলিশ বিভাগকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। একইভাবে বিষয়টি ট্রাইব্যুনালেও অবহিত করা হবে।