অনলাইন ডেস্ক : করোনা ভাইরাসের ফলে উদ্ভূত সঙ্কট মেকাবিলায় চার দফা সমাধানের কথা বলেছেন তেল, গ্যস বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদ। এজন্য যে অর্র্থের প্রয়োজন হবে তারও উপায় বলেছেন তিনি। খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, জনগণের লুন্ঠিত সম্পদের একাংশ দিয়েই বর্তমান সঙ্কট মোকাবিলা সম্ভব। মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারের শেষ অংশ তুলে ধরা হল।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় কি এমন প্রশ্নে আনু মুহাম্মদ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দুই ট্রিলিয়নের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ইউরোপের দেশগুলোও নানা ধরণের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। চীন নানামুখি পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতও বর্তমান ধাক্কা সামলাতে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
তারা নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ন্যূনতম খাদ্য এবং অধিকতর দরিদ্র রাজ্যগুলোর জন্য পৃথক বরাদ্দ রেখেছে। অনেক গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি তারা কিছু পরিকল্পনা নিচ্ছে। সবমিলিয়ে নানারকম পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তাতে যতটা খারাপ পরিস্থিতি দেখছি তার কিছুটা হয়তো সমাল দেয়া যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে কতটা সামাল দেয়া যাবে? এর ফলে কতটা পরিবর্তন হবে? এই পরিবর্তন কতটা জনগণের পক্ষে যাবে?
বাংলাদেশের অবস্থা কি- বাংলাদেশে আমরা এমন কোনও প্যাকেজের কথা এখন পর্যন্ত শুনিনি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে শুধুমাত্র রপ্তানি খাত বা পোষাক শিল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি বরাদ্দ নির্দিষ্ট করে ঘোষণা করা হয়েছে। আর কিছু মৌখিক আশ্বাসবানী পেয়েছি যে, জনগণের সঙ্গে সরকার আছে। জেলা প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশ আপনারা লক্ষ্য রাখেন এবং জনগনের প্রতি আহবান আপনাদের প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ঘোষণাটি অস্বচ্ছ এবং অস্পষ্ট।
তাহলে সমাধান কি এমন প্রশ্নে তিনি যোগ করেন, বাংলাদেশে নিশ্চিতভাবে কিছু পেশা আছে যেমন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যাংকার তারা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বেতন পাবেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বেতন পাবে, মজুরি পাবে এ ধরণের মানুষের সংখ্যা আমাদের এখানে খুবই কম। দেশে আমরা যদি একশ ধরি জনসংখ্যা, তাহলে প্রতিষ্টান বন্ধ থাকলে বেতন পাবে তিন থেকে চার শতাংশ। আর বাকি যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আছে তারাও বেতন দিতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। আমাদের নির্মাণখাত এদেশের জিডিপির একটা বড় খাত। সে খাতের বিশাল অংশ শ্রমিক। তা পুরোপিুর বন্ধ। পরিবহন সেক্টর বিশেষ করে বাস থেকে রিকশা পর্যন্ত এমনকি পাঠাও, উবার পর্যন্ত বন্ধ। এই বিপুল পরিমাণ পরিবহন শ্রমিক সকলেই এখন বেকার। অন্যদিকে পরিবহন বন্ধ থাকায় পণ্য পরিবহন বন্ধ, ফলে কৃষকরা তাদের পণ্য বিক্রয় করতে পারছেন না। দেখা যাচ্ছে, যে পণ্যের দাম দশ টাকা তা এখন এক টাকায়ও বিক্রয় হচ্ছে না। আমাদের এখানে গড়ে ৬ কোটির কিছু বেশি মানুষ শ্রমজীবী। তার মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠনিক বা অনানুষ্টানিক শ্রমিক হিসাবে কাজ করে এমন শ্রমিক রয়েছে পাঁচ কোটির বেশি। যারা নিজেরাই নিজেদের কাজ তৈরি করে। সেটা হকার হোক, রিকশা চালক হোক। যাদের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন নেই; যাদের কোনও সরকারি সমর্থন নেই; যাদেও সামাজিক নিরাপত্তা নেই। যারা দিনে কাজ করলে তার আয় হয়, কাজ না করলে আয় হয় না। তার আয় না হলে কি হবে এটা কেউ জানে না। রাষ্ট্র তাদের কোনও দায়-দায়িত্ব নেয় না। সামাজিক নিরাপত্তায় আমরা কোথায়- সোশ্যাল সেফটির জায়গায় বাংলাদেশ বহু দেশের তুলনায় অনেক দুর্বল। বাংলাদেশের তুলনায় জিডিপি দুর্বল অনেক দেশ সামাজিক নিরাপত্তায় অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি বিপদে পড়ে তা দেখার মতো কোন প্রতিষ্ঠান নেই। বেকার হলে তো নেই-ই। করোনার মতো বিপদে তো আরও নেই। তারা চিকিৎসা বা দুর্ঘটনা হলে নেই। এমনভাবে নাগরিকদের বিপদে বিচ্ছিন্ন বা নির্লিপ্ত থাকা রাষ্ট্র খুব কমই আছে দুনিয়ায়।
তিনি বলেন, এখন আমরা পাঁচ কোটি শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে যদি তাদের পরিবার ধরি, তাহলে প্রায় নব্বই শতাংশ দাঁড়ায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এদের কি হবে? তাদের হয় তো তেমন কোনও সঞ্চয় নেই। এদের কোনও কোনও পরিবার হয় তো প্রবাসী আয় রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল। সামনের দিকে তা বন্ধ বা কমে যাবে। এরা একটা বড় সঙ্কটে নিপতিত হবে। সেই সঙ্কট মেকাবিলায় রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
ম্যাক্রো ইকোনমিক দিক থেকে দেখলে সঙ্কটটি হবে অন্যধরণের। একদিকে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কমে যাবে অন্যদিকে এক্সপোর্ট আর্নিং বা রপ্তানি আয় কমে যাবে। কৃষি বাদ দিলে এ দুটি আয়ের ওপরই আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ দাঁড়িয়ে আছে। এ দুটোর ওপর ভর করে যারা ক্ষমতাবান তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ পাচার করার পরও দেশের অর্থনীতি ধ্বসে পড়েনি, এর বড় কারণ রেমিটেন্স এবং এক্সপোর্ট আর্নিং হতো। ফলে বোঝা যেতো না, কিন্তু এখন তা বোঝা যাবে।
কৃষি উৎপাদনের মধ্যেও একটা বিপর্যয় দেখা দেবে। কোন কোন পণ্য উৎপাদন হলে সেটা বাজারজাত না করতে পারলে নষ্ট হবে। এর একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেখা যাবে। প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি আয় কমে গেলে আমদানি ক্ষেত্রেও চাপ পড়বে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কিভাবে সম্ভব- বিশ্ব্যাংক, আইএমএফ বা এডিবি তারা একটা সমাধান দেবে। তাদের সমাধানের মধ্যে প্রবেশ করা হবে পুরোপুরি আত্মঘাতী। এ সকল প্রতিষ্ঠান সব সঙ্কটে যে সমাধান দেয়, পুরো অর্থনীতির যে কাঠামোগত পরিবর্তন তাদের স্বার্থে দরকার এবং তাদের কর্তৃত্ব বাড়াতে যা যা দরকার সেই পন্থাই তারা গ্রহণ করে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিজস্ব চিন্তাভাবনা থাকা দরকার। রাষ্ট্রের মধ্যে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের নিয়েও একটা ব্যাপক আলোচনা করা দরকার। আমি মনে করি, স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ এই তিন মেয়াদেই পরিকল্পনা করা দরকার।
প্রথমত, স্বল্প মেয়াদে এখন সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে জনগণের অন্তত তিনমাসের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা। অন্তত তিনমাসের জন্য পাঁচ কোটি পরিবারের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এই সময়কালে তাদের চিকিৎসার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। কেউ যেন রোগাক্রান্ত না হয়ে আরও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে না পড়ে। তৃতীয়ত, করোনা ভাইরাসের সময় সকলকে বলা হচ্ছে, আইসোলেশনে থাকেন, ঘরে থাকেন, সোশ্যাল ডিসটেন্স মেইনটেন করেন। ঘর থেকে বের হবেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, এই শহরে বড় সংখ্যক মানুষের তো ঘর-ই নেই। ঢাকায় যারা রাস্তায় ঘুমাতো তারা এখন কোথায়? এটা দেখার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র বা সরকার আছে কি কারণে? দুনিয়ার অনেক দেশে যখন এ সমস্যা হয়েছে তখন তারা সঙ্গে সঙ্গে স্কুল বা সরকারি ভবন খালি করে সেটাকে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করেছে। চতুর্থত, কৃষক যেনো তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যয্যমূল্য পায় তার জন্য সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে তা সম্প্রসারিত করা দরকার। সরকার কৃষকের পণ্য কিনবে এবং সেগুলোই কমদামে জনগণের মধ্যে বিক্রয় করবে। তাতে কৃষকরা যেমন লাভবান হবে অন্যদিকে যাদের আয় নেই, ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে তারাও উপকৃত হবে।
হিসাব করে দেখেছি, সরকার যদি সত্তর থেকে নব্বই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে তাহলে তাদের তিনমাস ন্যূনতম খাদ্য যোগন, চিকিৎসা, থাকার ব্যবস্থা এবং কৃষকদের পণ্য ক্রয়ের একটি কাঠামো সরকার তৈরি করতে পারবে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, সরকার এই টাকার বরাদ্দ করতে হলে খুবই স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র সরকারি দলের লোকজনদের দিলে এটার সুফল সকলে পাবে না। এটা একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির মাধ্যমে করতে হবে। শুধুমাত্র সরকারি প্রজেক্ট হিসেবে এটাকে নিলে কোন কাজ হবে না। এখন সরকার যদি বলে টাকা পাবে কোথায়? এরজন্য জনগণের ওপর নতুন করে কোন কর ধার্য করার দরকার নেই। টাকা আছে? প্রশ্ন হচ্ছে কোথায় আছে? কাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে? এটা সরকার খুব ভাল করে জানে। সরকার জানে, কারা গত দশ বছরে সাত থেকে আট লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। কিংবা দেড় থেকে দুই লাখ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি। এই ঋণ খেলাপি কয়েকটি পরিবারের হাতেই বেশিরভাগ টাকা। সেই পরিবারগুলো কারা তা সরকারের জানা। তারা জনগণের যে সম্পদ পাচার করল বা লুন্ঠন করল সেই সম্পদের একাংশ উদ্ধার করলেই এর জন্য অর্থ বরাদ্দ অসম্ভব কিছু নয়। এর জন্য বিশ্বব্যাংক বা এডিবির কাছে ঋণ চাওয়ার কিছু নেই বা জনগণের ঘাড়ে বাড়তি কর চাপাবার কিছু নেই। দশ বছরে যদি আট লক্ষ কোটি টাকা বাইরে পাচার হয় বা দুই লক্ষ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয় এখানেই তো দশ লক্ষ কোটি টাকা। এর এগারো বা বারো ভাগের একভাগ যদি সরকার নিতে পারে তাহলেই বর্তমান সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সরকার বলতে পারে বিদেশে পাচার করা অর্থ কিভাবে আনবে? বিদেশ থেকে অর্থ না আনতে পারলেও তাদের চিহ্নিত করা নিশ্চয় কঠিন নয়। তাদের দেশের ভেতরে যে সম্পদ আছে তা বাজেয়াপ্ত করে এই অর্থ উদ্ধার সম্ভব। সরকার যদি না চায় তাহলে জনগণের ওপর নতুন করের বোঝা চাপানো এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণে জড়ানো দরকার হবে। আর সে পথে গেলে আমরা বিপদমুক্ত হতে পারব না। বরং নতুন করে আরেকটি সঙ্কটের আবর্তে নিপতিত হবো।