কাজী সাব্বির আহমেদ : তারিখটা এখন ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে সেটা হবে খুব সম্ভবত সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ। ১৯৮৭ সাল। আমরা যখন বেইজিং এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছলাম তখন পড়ন্ত বিকেল। শীতের বিকেলের যে একটা ধূসর পর্দা থাকে সেটা সেই প্রথম টের পেলাম। ব্যাংকক থেকে যখন আমরা থাই এয়ার লাইন্সের বিমানে উঠি তখন সেখানে ছিল গায়ের চামড়া পুড়ে যাওয়ার মত গরম। আর বেইজিং এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে যখন বের হই তখন হিমেল এক বাতাসের স্পর্শ যেন হৃদপিণ্ড পর্যন্ত নাড়া দিয়ে গেল। আমি ঢাকার ছেলে হলেও লেখাপড়া করেছি উত্তরবঙ্গের রংপুর ক্যাডেট কলেজে। তাই হিমালয় থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা কনকনে বাতাসের সাথে বেশ পরিচিত, কিন্তু তারপরও বেইজিং-এর সেই প্রথম ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ এখনও আমার মনে দাগ কেটে আছে। এয়ারপোর্টের পরিবেশ ছিল একই রকমের ঠান্ডা, মানুষজনের কোন কোলাহল ছিল না। আমরা যেহেতু চীন সরকারের শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে পড়তে এসেছি, তাই আমাদের জন্য ইমিগ্রেশনে আগেই ব্যবস্থা করা ছিল। তাই কোন বাক্য বিনিময় না করেই ইমিগ্রেশন পার হতেই দেখি আমাদেরকে রিসিভ করার জন্য বাংলাদেশ এমব্যাসি থেকে এসেছেন হান্নান ভাই। সেখানেই তার সাথে আমাদের প্রথম পরিচয়। তিনি সাথে করে নিয়ে এসেছেন একটা মাইক্রোবাস। সেই বাসে চড়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউট-এর উদ্দেশ্যে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আমাদের মাইক্রোবাস এক সময় বেইজিং শহরের যাওয়ার রাস্তায় উঠল। অনেকটা আমাদের দেশের সেই সময়কার আন্তঃজেলা রাস্তার আদলে সেই রাস্তা। জাঁকজমকের কোন বালাই নেই। রাস্তার দুইপাশে খালি মাঠ কিংবা ফসলের ক্ষেত, মাঝে মাঝে কিছু বাড়িঘর আর সেই সব বাড়িঘরের আঙিনায় কিছু মানুষের অলস আনাগোনা। আহামরি তেমন কোন বিল্ডিং চোখে পড়ল না। সাঁঝের আলো-আঁধারিতে চারিদিকে মন হু হু করা এক বিষণ্ণতার ছায়া। হয়ত সেটা ছিল আমার একান্ত অনুভ‚তি। সেই দিনকার সেই মুহূর্তের অনুভ‚তিটি ভোলার নয় আমার মনের পাতায় আজীবনের জন্য গেঁথে রয়েছে,তবে সেটা ভাষায় প্রকাশ করাটা সহজ নয়। অনেক বছর পরে যখন মাইকেল জ্যাকসনের ‘স্ট্রেঞ্জার ইন মস্কো’গানটি প্রথমবারের মতন শুনি, তখন গানের-
“How does it feel?
When you’re alone
And you’re cold inside
Like a stranger in Moscow”
লাইনগুলো আমাকে বেইজিং-এর এয়ারপোর্ট থেকে বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউট-এ যাওয়ার সময়টার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। এই লাইনগুলোতে যেমন সব হারানোর একটা বেদনার্ত হাহাকার আছে, সেদিন আমার মনেও সেই একই ধরণের এক মেলানকলির সুর বেজে উঠেছিল। বেইজিং-এর আবহাওয়া আমাদেরকে শীতলভাবে অভ্যর্থনা জানালেও তার কৌতুকপ্রিয় অধিবাসীরা কিন্তু তাদের স্বভাবসূলভ কৌতুহলদীপ্তক এবং আথিতিয়তাপূর্ণ আচরণ দ্বারা আমাদের চীনের জীবনকে করে তুলেছিল বৈচিত্রময় এবং নানা ঘটনায় সমৃদ্ধ।
চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে আমরা মোট দশজন বিভিন্ন বিষয়ে আন্ডারগ্রেড লেভেলে পড়তে এসেছি। দুইজন ফাইন আর্টসের, একজন মেডিসিনের আর বাকী সাতজন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন শাখার ছাত্র। যেহেতু চীনের ইউনিভার্সিটিগুলোর মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন হচ্ছে ম্যান্ডারিন (বিশুদ্ধ ফর্মের চাইনিজ) তাই আমাদেরকে প্রথম বছর চাইনিজ ভাষার উপর কোর্স নিতে হবে। আর সে জন্যই আমাদেরকে বেইজিং এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নিয়ে আসা হলো ‘বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউট’-এ। আমরা যখন এখানে এসে পৌঁছলাম তখন মাত্র সন্ধ্যা গড়িয়েছে। আসার পথে হান্নান ভাই আমাদেরকে এখানকার হোস্টেল এবং হোস্টেলের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বেশ কিছু ছবক দিয়েছেন। শুরুতেই তিনি আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে যে, আমরা যদি মনে করি এখানকার হোস্টেল মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ব্যাংকক থেকে ছেড়ে আসা ‘এশিয়া হোটেল’-এর মতন লাক্সারিয়াস হবে তবে কিন্তু আমরা বিরাট ভুল করব। হোস্টেলের ফ্যাসিলিটি নিয়ে তিনি শুধু একটি মন্তব্যই করলেন, ‘প্রথম প্রথম মনে হবে এখানে থাকা যাবে না, কিন্তু আসলে থাকা যাবে, শুধু একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে’। তাই কিছুটা চিন্তিত মনে যখন মাইক্রোবাস থেকে নামলাম তখন আমাদেকে ঘিরে ধরল একদল বাংলাদেশী স্টুডেন্ট যারা আমাদের ঠিক এক বছর আগে এখানে পড়তে এসেছেন। মাত্র ভাষা শিক্ষার কোর্স শেষ করে নিজ নিজ সাবজেক্টে পড়ার জন্য যে যার ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে থিতু হয়েছেন। তারা আমাদের জন্য প্যাকেট ডিনার নিয়ে এসেছেন, কারণ ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটের ডাইনিং হল ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। একবার ডাইনিং হল বন্ধ হয়ে গেলে ক্যাম্পাসের ত্রি-সীমানার মাঝে আর কোথাও খাবার পাওয়া যাবে না সে কথাটাও তারা আমাদেরকে বলে দিলেন। অতএব, সাধু সাবধান।
আমাদের সবারই এই প্রথম বিদেশ আসা। তাই একদিকে যেমন নতুন দেশে নতুন জীবন শুরু করার উত্তেজনা কাজ করছে, আবার ঠিক তার বিপরীতে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটি দেশে কীভাবে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াবো সেই দুশ্চিন্তাও আমাদেরকে পেয়ে বসেছে। বিশেষ করে যে দেশের ভাষা আমরা এক বর্ণও বুঝতে পারি না। তার উপর আমরা সেই ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি যে চীনারা নাকি সাপ-ব্যাঙ ইত্যাদি সবই খায়। তাই খাওয়া-দাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তা কম নয়। আমাদেরকে মানসিকভাবে কিছুটা হতোদ্যম হতে দেখে সিনিয়ার ভাইয়েরা আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে চিয়ার আপ করার চেষ্টা করলেন। তারা তাদের নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে আমরা নাকি তিন মাসের ভেতরই কাজ চালানোর মতন চাইনিজ রপ্ত করে ফেলব। তারা নিজেদের মধ্যে যখন টুকাটাক চাইনিজে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন তখন খুব অবাক হলাম এই ভেবে যে আমিও একদিন তাদের মতন ‘চ্যাং চুং’ করে কথা বলতে পারব। চাইনিজদের কথা যেমন আমাদের কাছে ‘চ্যাং চুং’ আওয়াজের মতন লাগে, তেমনি আমাদের কথাও নাকি তাদের কাছে ‘চিলি কুলু, চিলি কুলু’ আওয়াজের মতন মনে হয়। বেশ কয়েক বছর পর আমাদের এক চাইনিজ বন্ধু আমাদের কাছে তাদের সেই গোপন কথাটি ফাঁস করে দিয়েছিল।
সিনিয়ার ভাইদের পরামর্শ, ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটে লেখাপড়ার চাপ নেই বললেই চলে, কিন্তু যখন নিজ সাবজেক্টের পড়া শুরু হবে তখন নাকি চোখে মুখে শর্সে ফুল দেখতে হবে। তাই এই সময়টা হচ্ছে ‘নো চিন্তা, ডু ফ‚র্তি’র সময়। কিন্তু ফ‚র্তি করার মতন তাৎক্ষণিক কিছুই চোখে পড়ল না। ক্যাম্পাসের ভেতর বেশ কয়েকটি হোস্টেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থিত। কিন্তু বিল্ডিং গুলো বেশ পুরানো। বিদেশী ছাত্রদের জন্য মূলত দুটি হোস্টেল বিল্ডিং, ছেলেদের জন্য বিল্ডিং নাম্বার ফাইভ আর মেয়েদেরটা বিল্ডিং নাম্বার এইট। চাইনিজে পাঁচ-কে বলে ‘ঊ’, আট-কে বলে ‘পা’ আর বিল্ডিং-কে বলে ‘লৌ’। সেই হিসেবে আমাদের ছেলেদের হোস্টেল হচ্ছে ‘ঊ-লৌ’ যেখানে আমাদের জন্য চারটি রুম বুক করা আছে। আমাদের দলের একমাত্র মেয়ের জন্য ‘পা-লৌ’-তে এক পাকিস্তানি সিনিয়ার স্টুডেন্টের সাথে থাকার ব্যবস্থা করা আছে। ছেলেদেরকে নিজেদের মধ্যে দুইজন করে রুমমেট ঠিক করে সেই রুমগুলোতে উঠে যেতে হবে। আমাদের বাকী একজনকে থাকতে হবে হান্নান ভাইয়ের সাথে। কারণ তিনিও এই ল্যাংগুয়েজ ইন্সটিটিউটের ছাত্র। চাইনিজ ল্যাংগুয়েজের উপর চার বছরের ডিগ্রী করছেন। আগামী বছর উনার ডিগ্রী শেষ হবে। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ এ্যাম্বাসীতে দোভাষী হিসেবে পার্টটাইম কাজ করছেন। বেইজিং আসার পথে থাই এয়ারলাইন্সের সৌজন্যে আমরা ব্যাংককে ‘এশিয়া হোটেল’-এ দুই রাত কাটিয়ে এসেছি। সেখানে আমাদের আটজন ছেলেকে ডাবল বেডের চারটি রুমে থাকতে হয়েছিল। বাকী একজনকে সিঙ্গেল রুম দেয়া হয়েছিল। দেখা গেল সেই আটজন এখানেও ব্যাংককের মতন নিজ নিজ রুমমেট বেছে নিল। অগত্যা সেই একজন অর্থাৎ হামিদকেই যেতে হল হান্নান ভাইয়ের রুমে। সিনিয়ার ভাইয়ের সাথে রুম শেয়ার করতে হবে বলে প্রথমে হামিদকে কিছুটা বিমর্ষ দেখালেও, যখন জানা গেল হান্নান ভাই আর হামিদ দুজনেরই দেশের বাড়ী পাবনা তখন অবশ্য হামিদকে বেশ উৎফুল্লই মনে হলো। আমি এবং আমার ক্যাডেট কলেজের সহপাঠী আজমী ৩১৭ নাম্বার রুমে উঠে গেলাম। রুমে গিয়ে দেখি একেকজনের জন্য একটি করে লোহার ফ্রেমের বেড, তাতে বেশ মোটা একটা ম্যাট্রেস, দু’খানা বেডশীট, একটা কম্বল, একটা লেপ ও একটা বালিশ। এছাড়াও রয়েছে কাপড় রাখার আলমিরা আর পড়ার চেয়ার-টেবিল। আরও রয়েছে প্রত্যেকের জন্য একটা পানির ফ্লাস্ক ও একটা টিনের বড় বৌল। এতকিছু পেয়ে আমার মনে হলো হান্নান ভাই কেন বললেন, ‘প্রথম প্রথম মনে হবে এখানে থাকা যাবে না’।
আমরা যে যার রুমে আমাদের লাগেজ রেখে এসে আবারো হোস্টেলের সামনের চত্বরে এসে জড়ো হলাম। হোস্টেল সংলগ্ন বেশ কয়েকটি বাস্কেটবল কোর্ট এবং তার পিছনে সকার কিংবা ভলিবল খেলার মাঠ রয়েছে। সেটা দেখে একটু চাঙ্গা বোধ করলাম অন্তত খেলাধূলা করে সময়টা পার করতে পারব। সিনিয়ার ভাইদের আনা ডিনার খেতে খেতে তাদের সাথে টুকাটাক কথাবার্তা হচ্ছিল আমাদের। এই টুকটাক কথাবার্তার মাঝেই তারা আমাদেরকে এখানকার ক্যাম্পাস জীবন সম্পর্কে অল্প-বিস্তর টিপস দিলেন যে গুলো ছিল ভীষণ রকমের প্র্যাক্টিক্যাল। যেমন কীভাবে কমন বাথরুম, টয়লেট ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে হোস্টেল থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত ডাইনিং হল থেকে কুপনের মাধ্যমে খাবার কিনতে হবে। কারণ এদেশের অনেক কিছুই আমাদের দেশের মতন না। যেমন গোছল করার সময় প্রথমে শাওয়ারের ঠান্ডা ও গরম পানির ট্যাপ ঠিকমতন অ্যাডজাস্ট করে তবেই কিনা শাওয়ারের নীচে দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি হোস্টেলে একটা গরম পানির গিজার্ড আছে যেখান থেকে ফ্লাস্কে পানি সংগ্রহ করা যাবে। খাওয়ার জন্য ঠান্ডা পানি আনতে হবে ডাইনিং হলের একটি নির্দিস্ট জায়গা থেকে। হোস্টেলের বাথরুমের বেসিনের ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা হান্নান ভাইকে দেখেছি হোস্টেলের সেই ঠান্ডা পানি খেতে, আর তারপর থেকেই আমাদের কাছে সেই ঠান্ডা পানির কোড নেম হয়ে যায় “হান্নান’স ওয়াটার”।
হান্নান ভাই তার স্বভাবজাত হাসিখুশি ব্যবহার দিয়ে আমাদের সবারই মন জয় করে নেন অল্প সময়ের ভিতর। তিনি আমাদের যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য সব সময়ই তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের চীনের জীবনের শুরুটা তার আন্তরিক বদান্যতায় হয়ে উঠেছিল নির্বিঘ্ন। এই বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের মার্চ মাসে তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সাভারের এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দোয়া করি মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।
ডাইনিং হল যে সময় ধরে দিনে তিনবার খুলে সেটাও আমাদের সিনিয়াররা আমাদেরকে বলে দিলেন। ডিনার যে সন্ধ্যা ছয়টার ভেতর সেরে ফেলতে হবে সেটা জেনে খুব অবাক হলাম। শুনেছিলাম আমাদের দেশের জেলখানাগুলোতে এই ব্যবস্থা চালু আছে। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম এই ভেবে যে, এ কোন জেলখানায় এসে ঢুকলাম। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার এই যে চীন ছেড়েছি সেই কত যুগ আগে কিন্তু সেই সন্ধ্যা ছয়টায় ডিনার করার অভ্যাস এখনও ছাড়তে পারিনি। আমাদেরকে আরও সতর্ক করে দেয়া হলো যে ডাইনিং হল বন্ধ হওয়ার পর রাতে আর কোথাও আর সহজে খাবার পাওয়া যাবে না। কারণ এই ক্যাম্পাসের আশেপাশে কোন রেস্টুরেন্ট নেই। আসলে সেই সময়ের বেইজিং আর আজকের বেইজিং-এর ভিতর অনেক পার্থক্য। ‘হাইতিয়েন’ নামক ডিস্ট্রিকে অবস্থিত ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটটি মূল শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বেইজিং-এর অনেকগুলি প্রসিদ্ধ ইউনিভার্সিটি এই ‘হাইতিয়েন’ ডিস্ট্রিকের ‘সুয়ে ইউয়ান ল্যু’ (ইনস্টিটিউট অ্যাভেনিউ) নামক একটি লম্বা রাস্তার দুই পার্শ্বে অবস্থিত। এই ‘সুয়ে ইউয়ান ল্যু’-এর দুইটি ইন্টারসেকশনের মাঝে অবস্থিত আমাদের এই ইনস্টিটিউটটি। প্রথম ইন্টারসেকশনটির নাম ‘সি তাও খৌ’ কিংবা ‘চার রাস্তার মোড়’ আর পরেরটার নাম ‘ঊ তাও খৌ’। ‘ঊ’ মানে যে পাঁচ সেটা তো আগেই উল্লেখ করেছি। এই দুই ইন্টারসেকশনে কিছু গ্রোসারী শপ রয়েছে যেখানে মূলত ফলমূল, তরিতরকারি এবং ব্রেড বা বিস্কুট জাতীয় শুকনো খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু বিকেল পাঁচটায় সেই গ্রোসারীগুলো আবার বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ‘সুয়ে ইউয়ান ল্যু’-এর এই দুই ইন্টারসেকশনের মাঝে নেমে আসে সুনসান নিস্তবতা। তখন এই রাস্তা দিয়ে কেবলমাত্র দুই একটি সাইকেল কিংবা ঘড়ির কাঁটা ধরে দুটি পাবলিক বাসকে চলাচল করতে দেখা যায়। রাস্তার দুই পাশ তখন অন্ধকারে ডুবে থাকে। তবে ইনস্টিটিউটটির যে প্রান্তটি ‘ঊ তাও খৌ’-এর সাথে মিশেছে সেখানে অবশ্য একটি ‘শিয়াও মাই পু’ (কনভিনিয়েন্স স্টোর) আছে যেটা রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে। সেটাই একমাত্র ভরসা যদি আমাদের খাবারের অন্য কোন ব্যবস্থা না থাকে। অর্থাৎ আমাদেরকে সব সময়ই কিছু খাবার হাতের নাগালে রাখতে হবে আপদকালীন সময়ের জন্য।
এক সময় সিনিয়ার ভাইয়েরা বিদায় নিলে আমরা যে যার রুমে ফিরে যাই। বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটের হোস্টেল ‘ঊ লৌ’ অর্থাৎ বিল্ডিং নাম্বার ফাইভে আমাদের চীনের জীবনের প্রথম রাতটি কেটেছিল এক ধরনের আচ্ছন্নতার ভেতর দিয়ে। আমি ক্যাডেট কলেজে দীর্ঘ ছয় বছর হোস্টেলে কাটিয়ে এসেছি, আমার জন্য হোস্টেলে থাকাটা মোটেই কঠিন কিছু নয়। সারা দিনের ক্লান্তিতে আমরা সবাই কাহিল ছিলাম, তাই তাড়াতাড়ি বিছানা পেতে গা এলিয়ে দিতেই টের পেলাম যে বালিশের ভিতর তুলার বদলে রয়েছে এক ধরনের বীচি। সেই সাথে বুঝতে পারলাম যে চাইনিজদের জীবনযাত্রা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের চেয়ে ভিন্ন। সেই ভিন্ন জীবনযাত্রা এবং জীবনবোধকে ধীরে ধীরে আরও জানার সুযোগ হয়েছিল আমার দীর্ঘ সাত বছর বেইজিং-এ বাস করার মাধ্যমে। হান্নান ভাইয়ের সাবধান বানী যেমন মিথ্যা ছিল না, তেমনি অন্যান্য সিনিয়ার ভাইদের দেয়া ভরসাগুলোও অমূলক ছিল না। ধীরে ধীরে আমাদের চীনের জীবনটা হয়ে উঠেছিল নানা ঘটনার জন্য স্মরণীয় এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে সমৃদ্ধ। অচেনা চীন একসময় হয়ে উঠলো চেনা পরিচিত হয়ে।