শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : রাজ দরবারের কক্ষের প্রবেশ পথের ধাপগুলো খুব চমত্কার কমলা রঙের গালিচায় মোড়া। মন্ত্রীবর্গ আর রাজসভার উচ্চ পদস্থ আমলারা কম্পিত পদক্ষেপে ধীরে ধীরে রাজসভা কক্ষে প্রবেশ করেন প্রতিদিন।
আমি মন্ত্রী আর আমলাদের একেবারেই পছন্দ করি না!
ওনারা রাজসভায় আলোচনা জন্য উপস্থাপন করেন বহুবিধ সমস্যার বিষয় যেমন, সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সৈনিকদের বেতন ও রশদের সরবরাহ; দক্ষিণ পাহাড়ে কৃষি জমি বন্টন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
এ রকম আরো কতো বিষয়!
ওনাদের কথা বন্ধ হয় না। আমিও রাজসভা ছেড়ে উঠে যেতে পারি না!
যতক্ষণ পর্যন্ত না, আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন, তাঁর গোলাপ কাঠের তৈরী ছড়িটা হাতে নেন ভর দিয়ে উঠে পরার জন্য।

রাজসভার কার্যক্রম আমার কাছে অসহ্য লাগে কিন্তু আমাকে বসে থাকতে হয়, আমার তো উপায় নাই, রাজসভায় আমাকে বসতেই হবে।
সন্ন্যাসী চুয়ে খোং আমাকে বলেছেন, রাজা-বাদশাদের জীবনের সময় কাটে আড্ডা আর খোশগল্পের মধ্য দিয়ে!
হুয়াং ফু ফুরেন আর মং ফুরেন, রাজ দরবারে যখন মন্ত্রী পরিষদ ও আমলাদের সামনে বসেন, তখন তাঁরা তাঁদের মুখমণ্ডলে বজায় রাখেন রাজকীয় আভিজাত্য আর গাম্ভীর্যের ভাব।
রাজনীতির ক‚ট-চাল, নিয়ম-কানুন; দু’জনেই খুব ভালো জানেন! এই কাজে একজন আরেক জনের উত্তম সহযোগী!
তাঁদের দুজনের এই জুটিটা হয়েছে চমত্কার, খুবই মানানসই!
কিন্তু প্রতিদিনই রাজসভা শেষ হওয়ার পর, এই দুই নারী আর নিজেদেরকে সংযত রাখতে পারেন না। দু’জনের মধ্যে শুরু হয় ধারালো জিহ্বার তীক্ষ্ম বাক যুদ্ধ!
একবার, রাজসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো নিত্য সূর্য দালান নামের প্রাসাদে। মন্ত্রীবর্গ আর আমলারা সবাই দরবার কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেছেন; ঠিক এমন সময় হুয়াং ফু ফুরেন ঠাস করে মং ফুরেনের গালে মারলেন এক চড়!
আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম!
আমি দেখলাম মং ফুরেন, দু’হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে পর্দার অন্য পাশে চলে গেলেন।
পর্দার ওপাশে গিয়ে লুকিয়ে তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন; ব্যাপারটা ভালো করে বুঝার জন্য আমি তাঁর কাছে গেলাম, তাঁকে দেখতে।
তিনি কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন, “বুড়ি মরে না কেন? যত আগে মরবে, ততোই মঙ্গল!”

আমি দেখতে পেলাম একটা ভীষণ অপমানিত মুখমণ্ডল, যাতে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ!
যে মুখটা ছিলো খুবই সুন্দর, সেটা দাঁত কিড়মিড় করে জানান দিচ্ছে তীব্র রাগের গভীরতা।
আমার জ্ঞান হওয়ার সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আমি লক্ষ্য করেছি, আমার মাতা মং ফুরেনের চেহারার এ রকম একটা অদ্ভূত অভিব্যক্তি!

যেটা কিনা তাঁর অবয়বে, প্রায় স্থায়ী রূপ নিয়েছে, এমন কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়!
তাঁর উদ্বেগ অত্যাধিক। তিনি একজন অতিরিক্ত সন্দেহ প্রবণ মহিলা!
তাঁর সন্দেহ হয়েছিল, আমার সহোদর ভাই তুয়ান সিয়েনকে কেউ বিষ খাইয়ে মেরেছে!
সন্দেহভাজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিটি ছিলেন, পরলোকগত সম্রাটের আতি প্রিয় উপ-পত্নী তাই নিয়াং।

পরে অবশ্য এই কারণে তাই নিয়াংকে শাস্তি পেতে হয়েছে; ভয়াবহ শাস্তি!
ওনার হাতের দশটি আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছে! ওনাকে নির্বাসিত করা হয়েছে আবর্জনায় ভরা পূঁতিগন্ধময় হীম প্রাসাদে!
আমি জানি, সম্রাটের কোন পত্নী কিংবা উপ-পত্নী যদি কোন অপরাধমূলক কাজ করেন, তবে তাকে শাস্তি স্বরূপ পাঠিয়ে দেয়া হয় হীম প্রাসাদে, এটাই রাজ প্রাসাদের রেওয়াজ!

মূল রাজ প্রাসাদের পিছনের দিকে হীম প্রাসাদের অবস্থান। আমি একবার গোপনে হীম প্রাসাদে গিয়েছিলাম। তাই নিয়াং এর হাতের দশটা আঙ্গুল কেটে ফেলার পর, তাঁর অবস্থা কেমন হয়েছে সেটা দেখতে আমার খুবই ইচ্ছা করছিলো।
হীম প্রাসাদের অবস্থা সত্যিই ভয়াবহ! আঁধো অন্ধকার, মানুষের বসবাসের প্রায় অযোগ্য এটা। ভিতরে, চত্বরের চার দিকে জমেছে শ্যাওলা; দেয়ালের ফাঁক-ফোকরে আছে অনেকগুলো মাকড়শার জাল। কাঠের একটা ছোট জানালা দিয়ে আমি লুকিয়ে দেখলাম, তাই নিয়াং ঘুমিয়ে আছেন। তিনি শুয়ে আছেন শুকনো ঘাসের একটা গাদার উপর। ওটার পাশেই আছে একটা ভাঙ্গা কাঠের বালতী, যেটা ব্যবহার করা হয় মল-মুত্র পরিষ্কার করার কাজে। হীম প্রাসাদের ভিতর থেকে একটা দুর্গন্ধ আসছিলো, আমি বুঝলাম দুর্গন্ধের উত্পত্তিস্থল হচ্ছে, প্রায় উপচে পরা ঐ কাঠের বালতীটা!

কিছুক্ষণ পর আমি দেখলাম ঘুমন্ত তাই নিয়াং পাশ ফিরলেন। এবার ওনার একটা হাত আমার দৃষ্টি সীমায় আসলো। হাতটায় যেন কোন শক্তি নেই, হাতটা ঝুলে পরেছে শুকনা ঘাসের গাদার এক পাশে। ঝুলন্ত হাতের ক্ষতগুলোকে যেন জানালা দিয়ে আসা বাতাস আর ক্ষীণ রোদে কাপড় শুকাবার মতো করে শুকাতে দেয়া হয়েছে।
আমি লক্ষ্য করছি, হাতটা কালো হয়ে গেছে, ওটা যেন একটা পুরু কালো রঙের তেলের পিঠা!
হাতের ক্ষত ফুলে আছে, কালচে রঙের জমাট বাঁধা রক্ত দেখা যাচ্ছে, যার উপর উড়ে এসে বসেছে এক ঝাঁক মাছি!
তাই নিয়াং-এর হাতের ক্ষত স্থানের উপর মাছির ঝাঁক যেন নির্বিঘেœ বসার একটা চমত্কার জায়গা পেয়েছে!

আমি তাই নিয়াং-এর চেহারাটা দেখতে পাচ্ছি না। হীম প্রাসাদের ভিতরে আছেন বেশ কয়েক জন মহিলা। আমি জানি না, এদের মধ্যে আসলে তাই নিয়াং কোন জন! কেউ কেউ আমাকে বলেছে, প্রায়ত সম্রাটের পত্নী-উপপত্নীদের মধ্যে লুটে নামের তারের বাদ্য যন্ত্রের বাজনা যে মানুষটি বাজাতে সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন, তিনিই হচ্ছেন তাই নিয়াং! আসলে সেই মানুষটি কোন জন, সেটা আমার কাছে গুরুত্ববহ নয়! আমি ভাবছি, যার হাতের দশটি আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছে, তার পক্ষে লুটের তার টেনে সুমধুর সুর তোলা আর কখনওই সম্ভব নয়।
আগামীতে যে কোন উত্সবের সময় রাজ প্রাসাদের বাগানে বসে অপরূপ সুন্দরী কোন নারীকে আর কখনওই দেখা যাবে না, যাঁর হাতের টানে উঠছে লুটে নামের বাদ্য যন্ত্রের সুরের মূর্ছনা!

আর কেউ আছে কি, যার হাতে তারের কম্পন যেন ছড়ায় মণিমুক্তা; কে তুলতে পারবে ওমন চমত্কার শ্রুতিমধুর সুর?
তাই নিয়াং কোন এক কালে প্রাসাদের পাচককে ঘুষ দিয়ে বশ করেছিলেন; ওকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমার সহোদর জেষ্ঠ্য ভ্রাতা তুয়ান সিয়েনের মিষ্টি সুপের মধ্যে সাদা আরসেনিক মিশিয়ে দেয়ার জন্য!
এ কাজটা তাই নিয়াং সত্যিই করেছিলেন কি না, সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে! তবে এ ব্যপারটা নিয়ে মোটেই কৌতুহলী হই নাই।
আমার মনে এসেছে অন্য একটা বিষয়।
শাস্তি!
অপরাধের শাস্তি হিসাবে, হাতের দশটা আঙ্গুল কেটে ফেলতে হবে, এমন শাস্তি কেন হলো?
কোন এক সময় আমি আমার মাতা মং ফুরেনকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম।
তিনি ক্ষণিকের জন্য বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠলেন, “আমি ওর হাত দু’টো দেখতে পারি না!”
তাঁর এ ধরনের উত্তর আমাকে মোটেও সন্তুষ্ট করতে পারে নাই।

এই বিষয়ে আমি আবারও ভেবেছি। প্রশ্ন করেছিলাম আমার গুরু চুয়ে খোংকে।
চুয়ে খোং মন্তব্য করেছেন, “দেখ, আসলে ব্যাপারটা খুবই সহজ!
তাই নিয়াং-এর আঙ্গুলগুলো লুটে নামের বাদ্য যন্ত্রের তারে তুলতে পারতো অপরূপ সুরের মূর্ছনা!
আর অন্যদিকে সুর তোলা তো দূরের কথা, মং ফুরেন তো বীণার মতো এই যন্ত্রটা একে বারেই বাজাতে জানেন না!”
আমার সিংহাসনে আরোহণ পর্যন্ত, ম্যাপেল বনের মধ্যে অবস্থিত হীম প্রাসাদে অন্তরীন অবস্থায় ছিলেন প্রয়াত সম্রাটের বারো-তেরো জন পত্নী-উপপত্নী!
রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে হীম প্রাসাদ থেকে ভেসে আাসা কান্নার শব্দ আমার কানে এসে বিঁধে।
মহা বিরক্তিকর এই কান্নার আওয়াজ, যা আমি মোটেই পছন্দ করি না! কিন্তু এই কান্নার শব্দ বন্ধ করার তো কোন উপায় নাই। এই বিদঘুটে স্বভাবের মেয়েলোকগুলো বাঁচতেও চায় না, আবার মরতেও চায় না! দিনের বেলায় সারাক্ষণ চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমায়, আর সন্ধ্যা হলে জেগে ওঠে পূর্ণ প্রাণ শক্তি নিয়ে, শুরু করে নাকি সুরে তাদের দুঃখের কান্না! তাদের এই টানা দীর্ঘ কান্নার আওয়াজ রাজ প্রাসদে শুনা যায়, নাড়া দেয় আমার রাতের গভীর ঘুমকে!
আমি এই ব্যাপারটার উপর খুবই বিরক্ত।
আমি তো আর প্রাসাদ ভৃত্যদের এমন কথা বলতে পারি না, “তোমরা হীম প্রাসাদে গিয়ে, ঐ মেয়ে লোকগুলোর মুখের আওয়াজ বন্ধ করার জন্য সব ক’টার মুখের ভেতর তুলা গুঁজে দিয়ে আসো!”
হীম প্রাসাদে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত; ওখানে তো যে কেউ ইচ্ছা মতো ঢুকতে পারে না। আমার গুরু চুয়ে খোং-এর সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করেছি।
তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন, আমি যেন রাতের বেলা হীম প্রাসাদ থেকে আসা ঐ শব্দটার সাথে অভ্যস্থ হয়ে যাই!

রাতের বেলা প্রাসাদ প্রাচীরের বাইরে নৈশ প্রহরীরা এক ধরনের কাঁসার থালায় বাড়ি দিয়ে শব্দ করে সংকেত আদান প্রদান করে। আমার গুরু আমাকে উপদেশ দিয়েছেন, আমি যেন হীম প্রাসাদ থেকে আসা কান্নার শব্দকে প্রহরীদের কাঁসা বাজানোর শব্দের মতোই মনে করি; তাহলে আর ঘুমের ব্যাঘাত হবে না!
তিনি বললেন, “ধরে নাও, হীম প্রাসাদের ঐ মেয়েদের কান্না হচ্ছে, প্রত্যুষের ঊষার আগমণের স্বাগত বার্তার শব্দ!
তুমি হচ্ছো, সিয়ে রাজ্যের রাজা; তোমাকে অনেক বিষয়েই ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে।”
আমার কাছে মনে হচ্ছে, সন্ন্যাসী চুয়ে খোং যা বলেছেন, তা উপলব্ধি করা যে কারো পক্ষেই কঠিন ব্যাপার!
আমি হচ্ছি, সিয়ে দেশের সম্রাট! আমাকে কেনো, সবকিছুতেই ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে?
বাস্তবে যা হওয়া দরকার, সেটা হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত!
আমার ক্ষমতা আছে!
আমার উচিত, আমার যা পছন্দ নয়, এমন সব ব্যাপার একে বারে শেষ করে দেয়া! যেমন, ঐ ব্যাপারটা! ম্যাপেল বনের ভেতর থেকে আসা কান্নার আওয়াজের উত্স!
রাজ প্রাসাদের দণ্ড বিধায়ককে তলব করে জিজ্ঞেস করলাম, “এমন কোন উপায় আছে কি, যাতে ঐ মেয়েলোকগুলো আর শব্দ করে কাঁদতে না পারে?”
দণ্ড বিধায়ক বললেন, “জ্বী জাঁহাপনা, আছে তো একটাই উপায়! ঐ মহিলাদের জিহ্বা যদি কেটে ফেলা হয়, ওরা আর শব্দ করে কাঁদতে পারবে না।”

আমি তাকে আবার প্রশ্ন করলাম, “জিহ্বা কেটে দিলে কি মানুষ মরে যেতে পারে?”
উত্তরে তিনি বললেন, “শুধু জিহ্বা? যদি ঠিকমতো কাটা হয় তবে, কোন মানুষই মরবে না!”
আমি বললাম, “তাহলে, আপনারা ওদের জিহ্বাগুলো কেটে ফেলুন। আমি আর কোন দিনই ঐ মেয়েলোকগুলোর নেকড়ের ডাকের মতো ভূতুরে কান্নার আওয়াজ শুনতে চাই না!”

গোটা ব্যাপারটা ঘটবে অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্যে!
আমি এবং দণ্ড বিধায়ক ছাড়া আর কেউই জানবে না!
কয়েক দিন পর দণ্ড বিধায়ক আমার কাছে, রক্ত মাখা একটা কাগজের পোটলা নিয়ে আসলেন। তিনি আস্তে আস্তে পোটলাটা খুলতে খুলতে বললেন, “এখন থেকে ঐ মহিলারা আর শব্দ করে কাঁদতে পারবে না!”

আমি তীর্যক দৃষ্টিতে কাগজের পোটলাটার ভিতরের দিকে তাকালাম। দেখলাম, কান্না প্রিয় প্রয়াত সম্রাটের পত্নী-উপপত্নীদের কর্তন করা জিহ্বাগুলো!
দেখতে অনেকটা সুস্বাদু বটি কাবারের মতো লাগছে!
আমি পুরষ্কার হিসেবে দণ্ড বিধায়ককে কয়েকটি রৌপ্য মুদ্রা দিলাম। তাকে হুকুমের সুরে বললাম যে, কোনভাবেই হুয়াং ফু ফুরেনকে ব্যাপারটা যেন না জানানো হয়। যদি তিনি প্রশ্ন করেন, তবে যেন বলা হয়, ঐ মেয়েলোকগুলো অসতর্ক ছিলো, ওরা নিজেরাই দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে নিজ নিজ জিহ্বা ছিড়ে টুকরো করে ফেলেছে!

ঐ রাতে আমি খুব অশান্তির মধ্যে ছিলাম। যেটা আশঙ্কা করছিলাম, সে রকমই হলো!
হীম প্রাসাদ একে বারে নীরব-নিঃশব্দ! কোন শব্দ ভেসে আসছে না ওখান থেকে; শুধুমাত্র শোনা যাচ্ছে বাতাস বওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ! গাছের পাতা ঝরার ক্ষীণ আওয়াজ কিংবা রাতের বেলা প্রাসাদের কোন দরজা খোলা বা বন্ধ করার শব্দ।
পুরো সিয়ে রাজ প্রাসাদে যেন বিরাজ করছে মৃত্যু-নিশ্চল নিঃস্তব্ধতা!
আমি রাজকীয় বিছানায় শুয়ে আছি, এপাশ ওপাশ করছি। ভাবছি ঐ দুর্ভাগা মেয়েমানুষগুলোর কথা, যাদের জিহ্বা আমার হুকুমেই কেটে ফেলা হয়েছে!
হঠাত করেই আমার একটু ভয় করছে; আমার কানের পর্দাকে কষ্ট দেয়ার মতো কোন শব্দ এখন আর নেই!
কিন্তু তবু, আমার চোখে তো ঘুম আসছে না?
ঘুম আসা যেন আমার জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়েছে!
আমার নড়া চড়া করার শব্দ শুনে নীচে শুয়ে থাকা প্রাসাদ দাসী উঠে বসলো, জিজ্ঞেস করলো, “জাঁহাপনা, বাইরে যাবেন? শৌচাগারে যাবেন?”
আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।
আমি জানালা দিয়ে তাকালাম বাইরে। আধো অন্ধকারে একটা লন্ঠন জ্বলছে, দেখতে পাচ্ছি নীলাভ কালো আকাশ।
আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি, হীম প্রাসাদের মহিলাদের!
ওরা কাঁদছে, শব্দহীন কান্না!
কেন এত নিঃস্তব্ধতা?
আমি তো আওয়াজ পছন্দ করি না।
এখন তো কোন আওয়াজ নেই, তবে আমার ঘুম আসছে না কেনো?
আমি প্রাসাদ দাসীকে বলি, “নিয়ে এসো আমার ঝিঁঝি পোকার কৌটাটা!”

প্রাসাদ দাসী আমার পছন্দের ঝিঁঝি পোকার কৌটাটা হাতে করে নিয়ে আসে আমার কাছে। এরপর থেকে প্রতি রাতে আমি শুনতে থাকি কালো পাখার ঝিঁঝি পোকাগুলোর গুঞ্জন, আমার চোখে আসে ঘুম!
আমি খানিকটা উদ্বিগ্ন, কারণ শরত কাল শেষ হয়ে আসছে, শীত এগিয়ে আসছে, প্রথম বারের বড় তুষার পাতের পরপরই হয়তো আমার পোষা ঝিঁঝি পোকাগুলোর বড় একটা অংশ ঠান্ডায় জমে মরে যাবে। তখন কি ভাবে ঘুম আসবে আমার চোখে, নিদ্রাহীন সুদীর্ঘ রজনীগুলো আমার কাটবে কি ভাবে?

দণ্ড বিধায়ক আমার হুকুমে ‘অপরাধীদের’ দণ্ড দিয়েছেন। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা আমাকে করেছে উদ্বিঘ্ন, আমি তো অশান্তিতে আছি!
আমি লুকিয়ে লুকিয়ে লক্ষ্য করছি, এ ব্যাপারে হুয়াং ফু ফুরেন এবং মন্ত্রী পরিষদ ও আমলাদের কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে?

আমি দেখলাম তাঁরা এ ব্যাপারে একে বারেই ভাবলেশহীন; একে বারেই অসচেতন!
কোন এক দিন রাজসভা শেষ হওয়ার পর আমি হুয়াং ফু ফুরেনকে জিজ্ঞেস করলাম যে, স¤প্রতি কালে তিনি হীম প্রাসাদে গিয়েছেন কি না। আমি বললাম, “ঐ মেয়েলোকগুলো অপ্রত্যাশিতভাবেই, নিজেরাই কামড় দিয়ে নিজের জিহ্বাগুলো টুকরো করে ফেলেছে!”
আমার কথা শুনে হুয়াং ফু ফুরেন খানিকটা সময় খুব স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন,
“তাই তো! গত কয়েকটা রাত তো একে বারে নিঃশব্দ, মারাত্মক নিঃস্তব্ধ! এর আগে তো প্রতিটা রাতেই আমি ঘুমাতে পারতাম না!” (চলবে)