মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিত্সু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়।
চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

চার.
লন্ডনের ইস্ট লেনের থিয়েটার হলটা সন্ধ্যার পর পরই ভরে ওঠে অসংখ্য মানুষের মুখর কোলাহলে। নিম্নবিত্ত এসব মানুষের প্রায় সকলেই শ্রমিক, ভবঘুরে অথবা মদ্যপ প্রকৃতির। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে বা হতাশ দুশ্চিন্তার জীবন থেকে একটু মুক্তি পাবার আশায় ছুটে আসে তারা এই থিয়েটার হলে। এই থিয়েটার হলের গায়িকা বা নর্তকীর গান বা নাচ’ই তাদের বিনোদনের প্রধান আকর্ষণ। অনেক কষ্টের অর্থের টিকিটে তারা সব সময়ই চায় নিখাদ বিনোদন। কোন কারণে গায়িকা বা নর্তকী একটু কম বিনোদন দিলেই হল জুড়ে শুরু হয় গম্ গমে চেঁচামেচি আর বিকৃত স্বরে ডেকে ওঠা। সেদিন গায়িকা হিসেবে থিয়েটার হলে গান গাচ্ছিলেন হানা চ্যাপলিন। সুন্দর কণ্ঠের জন্য তিনি দর্শকদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। সন্ধ্যার এই অনুষ্ঠানে হানা সঙ্গে এনেছেন তাঁর পাঁচ বছরের ছেলে চার্লিকে। মা যখন স্টেজে, চার্লি তখন স্টেজের উইংস্ এর পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের গান শুনছে। চার্লির বয়স যখন তিন, তখন থেকেই মা তাকে গান, নাচ আর মূকাভিনয় শিখিয়ে আসছেন। ইতোমধ্যে ক্ষুদে শিল্পী হিসেবে পাড়ার ছেলেমেয়েদের কাছে বেশ বিস্ময়ের সমীহ পেয়ে আসছে সে। থিয়েটার হল নীরব। মা গান গাইছেন। দর্শকদের মত চার্লিও মগ্ন হয়ে গানের মধ্যে ডুবে আছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে চার্লি চ্যাপলিনের ভবঘুরে বেশ-এর মূর্তি

ইদানিং মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তারপর বাবার সাথে প্রায়ই ঝগড়া লেগেই থাকে। অবশ্য মা শুধু নিশ্চুপভাবে বাবার অত্যাচার সহ্য করেন। প্রায় প্রতিদিনই মদ্যপ বাবা টলতে টলতে বাড়ি এসে খিস্তি খেউর আরোক্ষায় আর সেই সাথে জানিয়ে দেন সংসার চালানোর কোনো খরচ তিনি দিতে পারবেন না। মা বরাবরই নিশ্চুপ থাকেন। থিয়েটার হলে গান গেয়ে যা সামান্য উপার্জন করেন তা দিয়েই সংসার চালানোর চেষ্টা করেন। ইদানিং মা গলার অসুখে ভুগছেন। অসুখটার নাম ল্যারেনজাইটিস। খুব বেশিক্ষণ গান করলে এবং খুব টান দিয়ে গান গাইলে গলায় ব্যথা শুরু হয় আর কন্ঠের স্বর বন্ধ হয়ে যায়। সেদিন পাঁচ বছরের বালক চার্লি চ্যাপলিন উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে মগ্ন শ্রোতা হয়ে মায়ের গান শুনে চলেছে। মা গান গেয়ে চলেছেন। একেবারে ভুলে গেছেন গলার ল্যারেনজাইটিস রোগের কথা। চার্লির মত দর্শকরাও সব মগ্ন শ্রোতা। হঠাত মায়ের গলা চির খেয়ে গেল। গলা থেকে স্বর বের করার অনেক চেষ্টা করেও তিনি পারলেন না। সারাদিন খেটে আসা ক্লান্ত সব মানুষগুলো বহু কষ্টের টাকায় কেনা টিকিটে বিনোদন না পেয়ে চিত্কার করে উঠলো। নিজেদের বসে থাকার চেয়ারে বারবার থাবা দিয়ে কুকুর বিড়ালের মতো ডাকতে শুরু করলো। লজ্জায় অপমানিত মা কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এলেন। থিয়েটারের ম্যানেজার মঞ্চে এসে দর্শকদের শান্ত করতে চাইলেন, কিন্তু খিস্তি খেউরের সাথে দর্শক সারি থেকে মঞ্চে জুতা এসে পড়তে লাগলো। ম্যানেজার মঞ্চ থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে গিয়েই উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ বছরের চার্লির সাথে ধাক্কা খেলেন। তিনি জানতেন এই পিচ্চি খুব সুন্দর নাচ গান আর মূকাভিনয় পারে। চার্লি কিছু বুঝার আগেই ম্যানেজার তার হাত ধরে মঞ্চে গিয়ে দর্শকদের জানিয়ে দিলেন এই ছেলেটিই এখন গান শোনাবে।

ব্যাপারটা বুঝে উঠতে চার্লির কিছুটা সময় লেগেছিল। তারপর মায়ের সম্মান বাঁচাতে মা যে গানটি গাইছিলেন সেই ‘জ্যাক জোনস্’ গানটিই শুরু করল সে। শুধু গানই নয়, গানের সাথে সাথে নাচ। দর্শকরা কখনো এত ছোট একজন ছেলের এত অদ্ভুত গান ও নাচ আগে দেখেনি। মুগ্ধ দর্শকরা মূহুর্মুহু তালিতে অভিবাদন জানালো ছোট্ট চার্লিকে। আর সেই সাথে খুশি হয়ে পয়সা ছুঁড়তে লাগল মঞ্চের ওপর।

ওটাই ছিল চার্লির জীবনের প্রথম দর্শকদের সামনে উপস্থিতি। সেদিনকার সেই ছোট্ট চার্লিই পরবর্তীতে প্রায় ষাট বছর পৃথিবীর চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকদের আনন্দ দিয়েছেন আবার কখনো অভিনয় দিয়ে কাঁদিয়েছেন। ১৮৯৫ সালে চলচ্চিত্র শিল্পের যাত্রার পর যদি একক কোন নাম উল্লেখ করতে হয় যিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় ও চলচ্চিত্র পরিচালনায় সারা পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তাহলে সবাই নিঃসন্দেহে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠবে চার্লি চ্যাপলিনের নাম।

চার্লি চ্যাপলিন জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের ইস্ট লেনে। বাবা মা দুজনেই ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী ও অভিনেতা। তার মা পূর্বে আরেকটি বিয়ে করেছিলেন এবং সেই ঘরে সিডনী নামে এক পুত্র সন্তান ছিল। চার্লির বাবা চার্লস চ্যাপলিন ছিলেন কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল এবং মদ্যপ প্রকৃতির। ফলে সংসার চালানোটা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

১৯০৫ সালে ‘শার্লক হোমস’ নাটকে কিশোর চার্লি চ্যাপলিন

বরাবরই মা’কেই সংসারের হাল ধরতে হত। কিন্তু মা প্রায় সব সময় সুন্দরভাবে সংসার চালাতে ব্যর্থ হতেন। এবং প্রায়ই অসুখে ভুগতেন। সাংসরিক টানপোড়নে মদ্যপ বাবা এবং অসুস্থ মাকে নিয়ে চ্যাপলিনদের সংসার লন্ডনের ইস্ট লেন থেকে লন্ডনের দক্ষিণ অঞ্চলে কেনিংটন নামের বস্তিতে উঠে আসে। এই বস্তিটি ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে দরিদ্র ও দুস্থ মানুষদের বসবাসের জায়গা। এই বস্তিতে শৈশব জীবনের দিনগুলো যেভাবে কেটেছে চার্লির তা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ভুলতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে যে অমর ভবঘুরের চরিত্র সৃষ্টির জন্য তিনি এত জনপ্রিয় সেই দরিদ্র হতচ্ছাড়া অথচ সহৃদয় মানুষটির চরিত্র চ্যাপলিন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তাঁর ছেলেবেলার নিদারুণ দারিদ্র্য ও অভাব অনটনের জন্য।
পরবর্তী জীবনে অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তিনি যে খ্যাতি ও বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছিলেন সম্ভবত পৃথিবীর অন্য কোন অভিনেতা এবং পরিচালক এমনটা পারেননি। তারপরও তিনি তাঁর সাফল্যের সুন্দর দিনগুলোতেও বাল্যজীবনের সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলো ভুলতে পারেননি।

চার্লির বাবা চার্লস চ্যাপলিন উচ্ছৃঙ্খল ও মদ্যপ হলেও সব সময় হাসি খুশি থাকতেন। তিনি নিজেই গান লিখতেন এবং নিজের লেখা গানে সুর দিতেন। সেই সময় ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খুবই খারাপ অবস্থায় ছিলো। ফলে নিজের পেশায় যে অর্থ উপার্জন হত তা দিয়ে সংসার চলত না। হতাশ চার্লস মনের দুঃখ দূর করার জন্য প্রতি সন্ধ্যায় বসতেন এক শুড়িখানায়। কেনিংটনের ‘দি হর্নস’ শুড়িখানা। চার্লির বয়স যখন ছয়, তখন মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে বাবা চার্লস লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হলেন। হয়তোবা অনিয়ম আর অত্যধিক মদ্যপানের ফলে এমনটা অনিবার্য হয়ে গিয়েছিল। অসুস্থ বাবাকে শুড়িখানার একটু দূরের সেন্ট টমাস হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। বাবা আর অসুখ থেকে সেরে উঠলেন না। বাবা যে রাতে মারা যান, সেই রাতে ছয় বছরের চার্লি হাসপাতালের বাবার বেডের পাশের জানালার নীচে সারারাত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা আর অন্ধকারের মধ্যে একা ছয় বছরের এক বালক দাঁড়িয়ে ছিল আছে মৃত্যুপথযাত্রী পিতার রোগমুক্তির কামনায়। সেই ঠান্ডা-অন্ধকারে সারাটা রাত ডুকরে-ডুকরে কেঁদেছিল সে। সকালের আলো ফুটে ওঠার পর সে জানতে পেরেছিলো রাতেই তার বাবা চিরদিনের মত তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। খবরটা শোনার পর চার্লি আর কাঁদতে পারেনি। দুঃখ শোক আর অনিশ্চয়তায় শুধু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

বাবার মৃত্যুর পর চার্লি এবং তার সত ভাই সিডনীকে একটি অনাথ আশ্রমে পাঠানো হলো। কিন্তু কিছুদিন পরই অনাথ আশ্র্রম থেকে বের হয়ে এসে সাত আর এগার বছরের দুই ভাই রাস্তায় রাস্তায় এবং বিভিন্ন মিউজিক হলে নাচ-গান ও অভিনয় করে কিছু কিছু উপার্জন করা শুরু করলো। দুই ভাই’ই তাদের মাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো, সেই সাথে একে অপরের প্রতিও ছিলো তাদের গভীর ভালোবাসা। মা দুজনকেই সব সময় পরমভাবে আগলে রাখতেন, কিন্তু মা’র ছিলো একটি কঠিন অসুখ। মাঝে মাঝে কিছুদিনের জন্য তিনি পাগল হয়ে যেতেন। যখন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো, সেই সময় দুই ভাই রাস্তায় রাস্তায়, পার্কে, হাটে-বাজারে ঘুরে আধা ভিখারী ও আধা ভবঘুরের মত জীবন কাটাতে বাধ্য হতো। ক্ষুধার তাড়নায় তাদের নাচ-গান করতে হতো, সঙ্ সাজতে হতো, এমনকি কুকুর-বিড়ালের মতো আওয়াজ করতে হতো। এভাবেই কাটতে থাকে চার্লির কৈশোর জীবন।
এর মধ্যে চার্লি চ্যাপলিনের পরিচয় হল ফ্রেড কার্ণোর সাথে। সালটা ছিল ১৯০৫। ফ্রেড কার্ণো সেই সময়ের খুব নামকরা প্রমোদ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপক। ফ্রেড কার্ণোর সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মূল কাজ করেছিল সিডনী। ইতোমধ্যে সিডনী পেশাদার অভিনেতা হিসেবে লন্ডনের বিভিন্ন মঞ্চে অভিনয় শুরু করেছে। প্রায় সাত বছর চার্লি কার্ণোর দলে ছিলেন এবং এই দলের হয়ে তিনি ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ১৯১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমন চার্লি চ্যাপলিনের জীবনের নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হয়ে গেল। ১৯১০ সালের ৩ অক্টোবর নিউইয়র্কের কলোনিয়াল থিয়েটারে প্রথম অভিনয়ের মাধ্যমে চার্লি দর্শকদের মুগ্ধ করলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চার্লির অভিনয়ের ভুঁয়শী প্রশংসা করে সংবাদ বের হতে লাগলো। চার্লির সুন্দর অভিনয় এবং দর্শকদের নিখাদ দম বন্ধ করা হাসানোর মতা দর্শকদের বিমোহিত করতে লাগলো প্রতিনিয়ত। দর্শকরা তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো কখন স্টেজে চার্লিকে দেখবে। ইতিমধ্যে চার্লির মাইনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে সপ্তাহে আট পাউন্ড। ১৯১০ সাল থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত চার্লি আমেরিকায় কাটিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন।

চার্লি চ্যাপলিন

১৯১৩ সালের গ্রীষ্মকালে আবার আমেরিকায় এলেন চার্লি। এবার তার আলাপ হল পরিচালক ডি. ডবিøউ. গ্রিফিথের কৃতি ছাত্র পরিচালক ম্যাক সেনেটের সাথে। ম্যাক সেনেট তাকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আমন্ত্রণ জানালেন। সেনেটের কীস্টোন কোম্পানীতে যোগ দিলে চার্লিকে সপ্তাহে পঁচিশ পাউন্ড দেয়া হবে। আট পাউন্ড থেকে পঁচিশ পাউন্ড, একেবারে তিনগুন বেশি সম্মানী। সিদ্ধান্তহীনতাই পড়ে গেলেন চার্লি। যদিও অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি, কিন্তু যে মাধ্যমে অভিনয় করতে হবে, সেটাতো তার একেবারে অচেনা, উপরন্তু সেটার ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। এমন দোলাচলের মধ্যে চার্লি কার্ণো দলের ম্যানেজার আলফ রিভসের কাছে বিষয়টি খুলে বললেন। আলফ রিভসের ছোট ভাই বিলি রিভস ছিলেন চার্লির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর রিভস অসম্ভব স্নেহ করতেন চার্লিকে। তার উত্সাহ ও অনুপ্রেরণায় চলচ্চিত্রে নামতে রাজি হয়ে গেলেন চার্লি চ্যাপলিন। কিন্তু কার্ণো দলের সাথে তার চুক্তির মেয়াদ তখনো শেষ হয়নি। কীস্টোন কোম্পানীকে তিনি জানালেন, নভেম্বর মাসে কার্ণো দলের সাথে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় রওনা হবেন।

১৯১৩ সালের ২৮ নভেম্বর কানসাস সিটির এম্প্রেস থিয়েটারে কার্ণো দলে অনুষ্ঠানটি ছিল ঐ দলের সাথে চার্লির শেষ অভিনয়। অভিনয়ের শেষে চার্লি গিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রেনে উঠে বসলেন। সুন্দর সাফল্যের স্বপ্নে নয়, বরং অনিশ্চিত ভবিষ্যত-এর আশঙ্কায় তার সারা মন তখন নিমজ্জিত। হলিউড তখনো গড়ে উঠেনি। সামান্য কয়েকটা স্টুডিও, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর সবকিছুর মধ্যেই ছিল একটা দৈন্য-দারিদ্র অবস্থা। তবে সেখানকার তালগাছের সারি সত্যিই বিমোহিত করেছিল চ্যাপলিনকে, সেই সাথে কমললেবুর বাগান। সেই বিশাল কমলালেবুর বাগানেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে লাগলো হলিউডের স্টুডিও পাড়া। সেই মেক্সিকোর পাশে নিউইয়র্ক থেকে সুদূর দক্ষিণ পশ্চিমে এই হলিউডে চলচ্চিত্র নির্মাতারা নিউইয়র্ক ছেড়ে এমনি আসতে চাননি। বলা যেতে পারে তারা বাধ্য হয়েছিলেন জমজমাট নিউইয়র্ক ছেড়ে সুদূর হলিউডের পথে পা বাড়াতে। সেই সময় ছবি তোলার জন্য সূর্যের আলোর উপর নির্ভর করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। কারণ তখন উন্নত ধরণের ফিল্ম এবং জোরালো আর্ক লাইট আবিস্কৃত হয়নি। আর নিউইয়র্কে বরাবরই সূর্যের আলো কম থাকে। ফলে চলচ্চিত্র নির্মাতারা স্বাচ্ছন্দ্যে শুটিং করতে পারছিল না। নিউইয়র্কে চলচ্চিত্র নির্মাণে এমন সমস্যার পরও আরেকটি উত্কট ঝামেলা তাদের সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল। সেই সময় এক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী চলচ্চিত্র শিল্পে তাদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল। তাদের দাবি ছিল, পূর্ব থেকেই তারা সকল রকমের মুভি ক্যামেরার পেটেন্ট নিয়ে রেখেছে, সুতরাং তাদের অনুমতি না নিয়ে মুভি ক্যামেরায় কেউ যদি ছবি তোলে, তবে সেটা বেআইনি কাজ হবে। এ দাবিকে উপো করে কেউ কেউ ছবি তুলবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শক্তিশালী পেটেন্ট-গ্রুপ জোর করে তাদের ক্যামেরা কেড়ে নিতে লাগল। এমনকি মারপিট শুরু করে দিল, অফিস তছনছ করতে লাগল। শক্তি ও সংখ্যায় অপেক্ষাকৃত ছোট দলটি কোন উপায় না পেয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নতুন গন্তব্য ঠিক করেছিল পশ্চিমের দিকে। তাদের প্রথম পছন্দের জায়গা হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিল হলিউডকে। কারণ এই শহরটিতে সূর্যের আলোর সমস্যা ছিল না। সেই সাথে শহরটি ছিল মেক্সিকোর কাছেই। তাদের ধারণা ছিল, শক্তিশালী পেটেন্ট-গ্রুপ যদি আবার ঝামেলা করে তবে তারা দলবল নিয়ে মেক্সিকোতে গিয়ে গা ঢাকা দিতে পারবেন। ক্যানিফোর্নিয়ার এই ছোট নিস্তব্ধ শহরটি যে কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্ব চলচ্চিত্রের মূল কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হবে তখন সেটা কারো ধারণার মধ্যেই ছিল না।

চিত্রনির্মাতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি হলিউডে এসে তাঁবু গাড়লেন, তিনি হচ্ছেন কর্ণেল সেলিগ। তিনি এসেছিলেন ১৯০৮ সালে। তারপর ১৯০৯ সালে আসলেন ব্রস্কো বিলি অ্যান্ডারসর। ডি ডবিøউ গ্রিফিথ এবং ম্যাক সেনেট এসেছিলেন ১৯১০ সালে। চলচ্চিত্র জীবনের প্রথম পর্যায়ে এদের সবার সঙ্গেই চার্লি চ্যাপলিন কাজ করেছিলেন।
প্রথম যে চলচ্চিত্রে চার্লি চ্যাপলিন অভিনয় করেছিরেন তার নাম ‘মেকিং এ লিভিং’। হলিউডে চার্লি এসেছিলেন স্রেফ জীবিকার সন্ধানে। সেদিক দিয়ে তার অভিনীত প্রথম ছবিটির নাম খুবই তাত্পর্যময়। ছবির পরিচালক ছিলেন ফ্রান্সের অরি লোর্মা। এক রিলের এই ছবিটির প্রদর্শনের মেয়াদ ছিল মাত্র দশ মিনিট। এই ছবিতে চার্লি অভিনয় করেন খামখেয়ালি উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির যুবকের যে খবরের কাগজের এক ফটোগ্রাফারের স্ত্রীর সাথে প্রেম জমিয়ে ফটোগ্রাফের ক্যামেরাটি বাগিয়ে নিয়ে সটকে পড়ে। ফলে সবাই তাকে তাড়া করে; এ রকমই কয়েকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে ছবিটি শুরু হয়। জনতার হাত থেকে পালাতে গিয়ে সে আশ্রয় নেয় এক মহিলার শয়নকক্ষে। তার পিছন পিছন তাকে তাড়া করে সেই ফটোগ্রাফারও সেই মহিলার শয়নকক্ষে ঢুকে পড়ে। সে দেখতে পায়, বিছানার উপর চাদর মুড়ি দিয়ে কে শুয়ে রয়েছে। তার সন্দেহ হয় জোচ্চোর যুবকটিই বিছানার উপরে মটকা মেরে পড়ে আছে। শুরু হয়ে যায় ধস্তাধস্তি। তারপর চাদর সরে গেলে দেখা যায়, চাদরে নিচে যুবক নয়, শুয়ে ছিল মহিলাটি। স্তম্ভিত ফটোগ্রাফারের বিস্ময় কাটতে না কাটতেই মহিলার স্বামী এসে উপস্থিত হয়ে যায়। মহিলার কাছে সব শুনে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে ফটোগ্রাফারের উপর। শুরু হয় হট্টগোল, হাঙ্গামা। অত:পর পুলিশ এসে সব কিছু শান্ত করে। ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, খবরের কাগজের অফিসে এসে চার্লি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ফটোগ্রাফার সেখানে এসে ঢুকতেই তার হাতে তিনি তুলে দিলেন তার ক্যামেরা নয়, তুলে দিলেন ভদ্রমহিলার শয়নকরে সেই ধস্তাধস্তির একখানা ছবি।

১৯১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘মেকিং এ লিভিং’ ছবিটি মুক্তি পায় ব্যবসায়িকভাবে ছবিটি তেমন সুবিধা করতে পারেনি। এ ছবিতে চার্লির অভিনয় দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছিল। বিশেষ করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার অভিনয়ের প্রশংসা করা হয়েছিল। ‘মেকিং এ লিভিং’ ছবিতে অভিনেতা অভিনেত্রীদের নামের উল্লেখ না থাকায়, পত্র-পত্রিকায় তার নাম উল্লেখ করতে গিয়ে কেউ লিখেছিলেন চ্যাপমান, কেউ চ্যাটলিন আবার কেউ এডগার ইংলিশ।
কিস্টোন কোম্পানীর পাঁয়ত্রিশটি ছবিতে চার্লি অভিনয় করেছিলেন। এর মধ্যে তেরটিতে অভিনয় করেছিলেন অন্যের পরিচালনায়, পাঁচটিতে তিনি যুগ্ম পরিচালক ছিলেন এবং সতেরটি ছিল তার নিজস্ব রচনা ও পরিচালনার। তাঁর অভিনীত দ্বিতীয় ছবি ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’। ছবিতে তিনি প্রথমবারের মত তাঁর অভিনীত বিখ্যাত সাজসজ্জায় আবির্ভূত হলেন। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তাঁকে বলা হয়েছিল উদ্ভট সাজসজ্জা করতে। চ্যাপলিন সেদিন পরেছিলেন লম্বা মোটা এক সহকর্মীর ট্রাউজার আর তার লম্বা জুতা জোড়া উল্টো করে অর্থাত বাম পায়েরটা ডান পায়ে আর ডান পায়েরটা বাম পায়ে যাতে হাঁটার সময় জুতা জোড়া পা থেকে বেরিয়ে না যায়। খুব রোগা আরেক সহ অভিনেতার কোট পরেছিলেন যা শরীরের সাথে আঁটো সাঁটো হয়ে চেপে বসেছিল। তারপর হাতে নিলেন বেতের তৈরি ছোট্ট একটি ছড়ি যা ইচ্ছেমত ঘোরানো যায়, মাথায় পরলেন বাউলার হ্যাট আর নাকের নীচে টুথব্রাশের মত গোঁফ লাগিয়েছিলেন। অদ্ভুত এই বাহ্যিক অবয়বে চার্লি চ্যাপলিন পরবর্তীতে হয়ে উঠলেন চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে এক অপার বিস্ময়। এক বছরের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন পৃথিবীর অন্যতম পরিচিত এবং জনপ্রিয় অভিনেতা। সেই সাথে তাঁর আয় বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। (চলবে)