অনলাইন ডেস্ক : কঠিন অবস্থার মুখোমুখি বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকরা। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অবস্থা আরো করুণ। তারা চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। লকডাউনের সময় কয়েক লাখ শ্রমিক তাদের বেতন পাননি। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা দিচ্ছেন না নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু এশিল্পে অর্ডার কমে যাওয়ায় ইউনিয়ন সদস্যদের শুদ্ধিকরণ করছে। লন্ডনের অনলাইন দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কয়েক সপ্তাহ আগে শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আকতারের ফোনে ভাইব্রেশনের জন্য কেঁপে উঠল।

তিনি ভয়ার্ত হয়ে দেখতে থাকেন এতে ম্যাসেজের পর ম্যাসেজ এসে ভরে যাচ্ছে। প্রথমে গার্মেন্ট শ্রমিকরা ম্যাসেজ দিচ্ছেন তাদের সহকর্মীরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী দাবি করার জন্য তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এরপর অন্তঃসত্ত্বা নারী ও ইউনিয়ন সদস্যরা কল্পনার কাছে সাহায্য চেয়ে ম্যাসেজ দিচ্ছিলেন। তারা জানাচ্ছিলেন, তাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে।
গার্ডিয়ান আরো লিখেছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণে অর্থনীতিতে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে তাতে এক ঘূর্ণাবর্তে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত। এশিল্পের বিদেশী ব্রান্ডগুলো ২৪০ কোটি পাউন্ডের অর্ডার বাতিল অথবা স্থগিত করায় হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশে চাকরি হারানোর এক হিড়িক পড়ে যায়। এরই মধ্যে তারা যেসব কাজ শেষ করেছেন করোনায় লকডাউনের সময়ে কয়েক লাখ শ্রমিকের সেই কাজের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশ বড় রকমের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন এই বলে যে, তা সত্ত্বেও ১৮ লাখ শ্রমিক স্থায়ীভাবে কাজ হারাবেন। এরই মধ্যে অধিকারকর্মীরা বলছেন, পোশাক প্রস্তুতকারকরা কোভিড-১৯কে শ্রমিক ইউনিয়ন দুর্বল করা এবং অনাকাঙ্খিত শ্রমিক ছাঁটাই করার একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সালিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আকতার বলেছেন, যেসব লোককে চাইছেন না শিল্প মালিকরা তাদেরকে সরিয়ে দেয়ার জন্য এটাকে সুযোগ হিসেবে তারা ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে রয়েছেন যারা প্রতিবাদ করেন এবং যারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেন তারা।

চার সপ্তাহ আগে কল্পনা আকতার লক্ষ্য করেছেন তার সংগঠন ও অন্যরা এমন রিপোর্ট পাওয়া শুরু করেছেন যেখানে বলা হয়েছে, কমপক্ষে ৩০টি কারখানা থেকে কয়েক ডজন অন্তঃসত্ত্বা নারী শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যেহেতু নিত্যদিন শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে, তাই সামনের সপ্তাহগুলোতে এই সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হয়। এমন ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা মিতু। জুনের শেষের দিকে যখন প্রডাকশন ম্যানেজার তাকে বরখাস্ত করেন তখন তিনি ১৯ দিনের অনুমোদিত মেডিকেল ছুটি নিয়েছিলেন। কাজ করতে গিয়ে ঝিমুনি এবং অসাড় হয়ে পড়ার জন্য তিনি এমন ছুটি নিয়েছিলেন। যখন কাজে ফিরলেন তখন তিনি শুনতে পান ম্যানেজমেন্ট থেকে আলোচনা হচ্ছে মাতৃত্বকালীন কোনো সুবিধা দেয়া হবেনা। এরপরই মিতুকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তিনি কাজ হারান। মিতু বলেন, আমার আয়ের ওপর চলে আমার পরিবার। এখন আমাদেরকে বেঁচে থাকার জন্য ঋণ নিতে হবে। কিন্তু তা তো দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে।

৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা মর্জিনা। মে মাসে তার ম্যানেজার তাকে ও অন্য তিন অন্তঃসত্ত্বাকে বলেন, নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে বাসায় অবস্থান করতে। জুনে যখন তারা কাজে ফেরেন, তখন তাদেরকে বলা হয়, তাদের চাকরি নেই। ওই কারখানায় আট বছর ধরে কাজ করছিলেন মর্জিনা। তিনিও এখানে কোনো মাতৃত্বকালীন সুবিধা পাননি, যা নয় মাসের পূর্ণাঙ্গ বেতনের সময়। এই অর্থ তাকে আইনগতভাবে পরিশোধে বাধ্য কর্তৃপক্ষ।
অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বরখাস্ত করা বেআইনি। এ সময় সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের (এসজিএসএফ) সভাপতি নাজমা আকতার এই ধারার বৃদ্ধি দেখতে পেয়েছে, অর্ডার বাতিল হওয়ার কারণে। মে মাস থেকে তিনি অন্তঃসত্ত্বা ও বরখাস্ত হওয়া নারীদের পক্ষে ৫০টি মামলা করেছেন। এর মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিকদের পরিচয়পত্র নিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানি। তাদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। অন্যরা নারীদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। নাজমা আকতার মনে করেন, এমন আরো অনেক ঘটনা আছে। কিন্তু এই শিল্পে ব্যাপকভাবে চাকরি হারানোর প্রেক্ষাপটে বহু অন্তঃসত্ত্বা নারী সামনে এগিয়ে আসতে খুব ভয় পাচ্ছেন। নাজমা আকতার বলেন, বহু নারী মাতৃত্বকালীন সুবিধা পাচ্ছেননা। কারখানাগুলো থেকে তাদেরকে শুধু ছুটি নিতে বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদেরকে মাত্র কয়েকদিনের বেতন দেয়া হচ্ছে। যথারীতি এ নিয়ে আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। কিন্তু এই মহামারির কারণে নারীরা খুব ভীতসন্ত্রস্ত। তারা তাদের কাজ হারাতে চাননা।

প্রত্যন্ত এলাকায় এসব শিল্পের কাজ হয়। তাই বিভিন্ন ব্রান্ড সামাজিক অডিট এবং কারখানা পরিদর্শন করা বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে নিয়মভঙ্গ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন নাজমা আকতার। তিনি বলেন, মনিটরিং না থাকায় কারখানাগুলো যা ইচ্ছে তাই করতে পারছে। লিঙ্গভেদে সহিংসতার বাস্তব বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি আমরা। এক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠকদেরও টার্গেট করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আকতার। তিনি বলেছেন, এক তৃতীয়াংশ কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়নের বিরোধিতা রয়েছে। কারখানাগুলো যখন শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিল তখন আমরা সরাসরি ব্রান্ডগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতাম এবং তাদের সহায়তা পেতাম। কিন্তু এখন ওইসব ব্রান্ড কাজের অর্ডার বাতিল করছে। তারা সরবরাহকারীদের সঙ্গে লড়াই করছে। তখন আমরা আমাদের নিজেদের ভাগ্যের ওপর পড়ে আছি।

পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির শ্রমিক ও কর্মসংস্থানের সম্পর্ক বিষয়ক প্রফেসর ও বাংলাদেশি গার্মেন্ট কারখানা বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ মার্ক সেবাস্তিয়ান অ্যানার। তিনি সতর্ক করেছেন, ব্যাপকহারে কাজ হারানোর এবং শ্রমিক অধিকারকর্মীদের ছাঁটাই করার ফলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে। এটা একটা আন্তর্জাতিক সংকট, যা বৈষম্যমূলকভাবে সাপ্লাই চেইনের নিচের দিকে থাকা লোকজন আক্রান্ত হতে পারেন। এতে তাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। সামনের বছরগুলোতে আমরা এই চিত্র দেখতে পাবো।