মুরশাদ সুবহানী : রাম রাম রামেশ্বর বাবু, পিতলের হুঁকায় তামাক (তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর) টেনে আয়েশ করে দুপুরের ঘুম দিতে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি গভীর নিন্দ্রায় যাবেন। উঠবেন সন্ধ্যার পর। তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত হলো। পাশের রুমে স্টার জলসার স্টাইলে বাকযুদ্ধ চলছে। এ কারণেই তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আলসেমি ছাড়ছে না। রামেশ্বর বাবু’র ইচ্ছা করছে না, বিছানা ছেড়ে ওই ঘরে গিয়ে তাদের থামাতে চেষ্টা করার। আর তার কথায় বাকযুদ্ধের চলমান ঝগড়া থামতে নাও পারে, এমনও হতে পারে কড়াই আরো তেতে উঠতে পারে। ওই ঝগড়ার আসরে আছেন, তাঁর কর্ত্রী। কারো কথা তিনি বুঝতে পারছেন না।
একজন খুব বেশি জোরে চিল্লাচ্ছে। মনে হয় এক্ষুণি সব কিছু তছনছ করে ফেলবে। এরমধ্যে একটা থালা মেঝেতে পড়ার শব্দ পেলেন। নাহ, এবার যেতেই হবে। ওই ঘরে গিয়ে দেখেন, মা, বেটি ঝগড়া করছে, তাদের মৃদুস্বরে থামানোর চেষ্টা করছে ছোট ছেলে ঈশান। তাঁকে দেখেই কর্ত্রী আরো তেতে উঠলেন, এলো অকম্বার ঢেঁকি। রামেশ্বর বাবু মনে মনে সাহস সঞ্চয় করছেন, কি বলবেন, ভাবছেন? কন্যা বললো, তোমাদের বাড়িতে আর আসবো না। এখানে মানুষ বাস করে না। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, কী এমন হলো? আর যারা বাস করে তারা তো মানুষ, গরু ছাগল নয়। তাঁর মনে হলো এদের চেয়ে বরং গরু ছাগল ভালো। মনে সাহস নিয়ে বললেন, কি হয়েছে, দুপুর না গড়াতেই ঝগড়া-ঝাঁটি? মেয়ে বললো, কি আর হবে, চাউলের গুঁড়ো আর গুড় আনতে বলেছি, তাতে মা, আমাকে যত কথা শোনালো, তাতে আর তোমাদের বাসায় থাকা যায় না। ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই এক্ষুণি যা, আমার জন্যে একটা টিকিট করে আন (ওর শ্বশুর বাড়ি’র জেলার যাওয়ার জন্য)। রামেশ্বর বাবু এখনও বুঝতে পারছেন না, চাউলের গুঁড়ো আর গুড় আনাকে কেন্দ্র করে এতো ঝগড়া কেন হচ্ছে?
রাম রাম রামেশ্বর বাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে জানতে চাইলেন, চাউলের গুঁড়ো আর গুড় নিয়ে ভর দুপুরে ঝগড়ার কারণ কী? বললো, দ্যাখো বাবা, মাকে বলেছি, বাজার থেকে চাউলের গুঁড়ো আর গুড় কেনার জন্যে। রাগত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, উনি বললেন, বাজারের চাউলের গুঁড়া দিয়ে ভাল পিঠা হয় না। এবার উনি বাদ দিয়ে বললো, মা কি না তাঁর মায়ের কাছে মোবাইল করেছে, বাজারের চাউলের গুঁড়ো দিয়ে ভালো পিঠা হয় কী না জানার জন্যে। রামেশ্বর বাবু বললেন, এতে দোষের কী হলো? পিঠা কিসে ভালো হবে ‘আমি বুঝবো।’ এতে তৃতীয় পক্ষের পরামর্শের দরকার নেই। আমি এটা পছন্দ করি না। রামেশ্বর বাবু বললেন, আমার পরিচিত এক দোকান আছে, তার চাউলের গুঁড়া দিয়ে ভালো পিঠা হয় শুনেছি। নিয়ে আসবো। মেয়ে বললো, বাবা তুমি তাই করো। এর মধ্যে দিদার পরামর্শ লাগবে না। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলো। কর্ত্রী মুখ ভার করে রুমে গিয়ে দরজা দিলো। মেয়েও নিজের রুমে গিয়ে দরজা দিলো। এ যাত্রা ‘স্টার জলসার’ মতো ঝগড়া-ঝাঁটি বন্ধ হওয়ায় রামেশ্বর বাবু স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন। তার রুমে চলে এলেন। দুপুরে তিনি এই রুমে শয়ন করেন। এখানে কম্পিউটারে কাজ করেন। কাজ শেষে ঘুমাতে যান। আজ আর ঘুম হবে না। স্টার জলসার প্রথম পর্বের সূচনাতেই ঘুমের বারোটা বেজেছে। রামেশ্বর বাবু কম্পিউটারের সিপিও অন করেছেন। উইন্ডোজ চালু হচ্ছে। কর্ত্রী ডাকছে এই শুনছো, আমার মাথা ঘুরছে। তিনি স্ত্রীর রুমে গেলেন। বললো, আমার পাশে একটু বসো। আমার বুক ধড়ফড় করছে, মাথাটা ঘুরছে। রামেশ্বর বাবু বললেন, চারদিন আগেই তো তোমার মাথার স্ক্যান করানো হলো। সব ঠিক আছে বলে রিপোর্ট দিলো। ঘুমিয়ে যাও সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘুম আসছে না। চেষ্টা করো। করছি তো। রামেশ্বর বাবু স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। বললো, এখন যাও; তোমার কাজে যাও।
রাম রাম রামেশ্বর বাবুর সকালে কোন কাজ না থাকলে বেলা ১২টার আগে ঘুম থেকে জাগেন না। কাজ থাকলে আগের রাতে বলে রাখতে হয়, তাহলে ডাকা হয়। যদিও এই সংসারে সবাই তাকে একজন ভাবনা-চিন্তাহীন, কাজহীন প্রায় অপদার্থ বলেই মনে করে। তাদের ধারণা সাহিত্য চর্চা যাঁরা করেন, তারা অপদার্থ। আর রামেশ্বর বাবু’র স্ত্রী বলেন, ‘তিনি অকম্বা।’ এতে তিনি তেমন কিছু মনে করেন না। নিবিষ্ট চিত্তে নিজের কাজ করেন। কে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দিলো কী দিলো না কোন পত্র-পত্রিকা তার লেখা ছাপলো কী ছাপলো না এ নিয়ে তিনি ভাবেন না। রামেশ্বর বাবু এমন অনেকের কথাই জানেন, এক সময় পত্রিকা অফিসের লোকজন তাদের লেখা ফেলে দিতেন। পরে এদের মধ্যে যারা নোবেল পেয়েছেন, তখন তাদের কত কদর। রামেশ্বর নোবেল তো দূরের কথা নিজ জেলায় কোন সাহিত্য সংগঠন থেকেও কোন ক্রেষ্ট ও পুরষ্কার পাননি। এসব নিয়ে তিনি ভাবেন না। কে স্বীকৃতি দিলো কী দিলো না তাতে কিছু এসে যায় না। রামেশ্বর বাবু মফস্বল জেলা শহরের বাসিন্দা। একটা লেখা (তখন কম্পিউটার ততটা মার্কেট পায়নি)। কোনো কোনো পত্রিকা হাত কম্পোজ আবার কোন পত্রিকা মনো লাইনো টাইপে ছাপা হয়। ঢাকায় হাতে গোনা ২/৩টা পত্রিকা অফসেট প্রেসে ছাপা শুরু হয়েছে। ঢাকায় এক পত্রিকা অফিসে গেছেন রামেশ্বর বাবু। ওই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক মহাশয় তার পরিচিত। কিন্ত তিনি লেখা দিলে ছাপবেন বলেন, কিন্তু পরে আর ছাপা হয় না। রামেশ্বর বাবু সহজে রাগেন না। তবে জেদ আছে, সেটা প্রকাশ পায় না। তার হাসির মধ্যে জেদ চেপে থাকে। তিনি ওই পত্রিকা অফিসে একদিন গিয়ে দেখলেন, মফস্বল থেকে ছাপার আক‚তি নিয়ে আসা খামগুলো না খুলেই সাহিত্য সম্পাদক সাহেব ছিঁড়ে ছিঁড়ে ওয়েষ্ট বাস্কেটে ফেলছেন। রামেশ্বর বাবু নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরস্থিরভাবে বললেন, আপনি খামের লেখা না পড়েই ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। সাহিত্য সম্পাদক মহাশয় বললেন, এরা মফস্বলে থাকে কী আর এমন লিখবে। অযথা তাদের লেখা পড়ে সময় নষ্ট করা। তিনি নিজের ভেতরে জেদ চেপে রেখে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, আপনার মতো গুণী মানুষকে জ্ঞান দেওয়ার মতো সাহস আমার নেই। তবুও বলি একটি পত্রিকার সাহিত্য পাতা প্রকাশিত হয় দেশে লেখক সৃষ্টি করার মহত উদ্দেশ্য নিয়ে। নামি-দামী লেখকদের মাঝে মফস্বলের দু’/একজন লেখকের লেখা ছাপার যোগ্য তো হতেও পারে। না হলে কিছুটা শুধরে দিয়ে প্রকাশ করলে এরাও একদিন ভালো লেখক হবেন না এ কথা তো জোর দিয়ে বলা যায় না। সাহিত্য সম্পাদক সাহেব রেগে গিয়ে বললেন, রাখুন আপনার নীতি কথা। তিনি কথা না বাড়িয়ে চলে এলেন। একটা ফুলস্কেপ কাগজ ও একখানা খাম কিনে এক চায়ের দোকানে ঢুকলেন। চা খাওয়া শেষ করে ম্যাসিয়ারকে বললেন, দু’চার মিনিট বসা যাবে। বললো, জ্বী স্যার। রামেশ্বর বাবু কাগজে একটা কবিতা লিখে নিজের নাম না দিয়ে ঢাকা শহরে নাম-ডাক আছে এমন একজন কবির নাম বসিয়ে দিলেন। চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে ওই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের নামে অফিসের বক্সে দিলেন। পরের শুক্রবারে দেখেন, লেখাটা প্রকাশ হয়েছে। তবে তার নামে নয়। অনেকদিন আগের কথা ভাবছেন, আর একটা লেখা কম্পিউটারে টাইপ করছেন। রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। রামেশ্বর বাবু হাই প্রেসারের রোগী। আর রাত জাগা ঠিক হবে না। তার কম্পিউটারের রুমে পাতা বিছানায় ঘুমাতে গেলেন।
রামেশ্বর বাবু’র ঘুম ভেঙ্গে গেল কর্ত্রীর চিত্কারে। লবনের বোয়ামের মুটকি কোথায় গেল? তিনি বিছানায় শুয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সকাল ৮টা বাজে। এই সাত সকালে মনে হয় স্টার জলসার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হচ্ছে। অনিচ্ছা সত্বেও বিছানা থেকে নেমে রান্না ঘরে গেলেন। কী হয়েছে, এতো জোরে চিত্কার করছো? কর্ত্রী চোখ বড় করে বললো, তোমার তো কোন কাজ-কম্ব নেই। দুপুর ১২টায় উঠলেই চলে। ডিম ভাজি করছি, লবনের মুটকী পাচ্ছি না। রামেশ্বর বাবু বললেন, তুমি তো ডিমে লবনের মুটকি দেবে না, দেবে লবন। বোয়াম থেকে লবন নিয়ে দিলেই তো হয়। তোমাকে বোঝানো আমার কম্ব নয়। কোন কালে বোঝনি আজও বুঝবে না। বয়স তো কম হলো না। সারারাত বোয়ামের মুখ খোলা ছিল, এতে পোকা মাকড় মুখ দিতে পারে। বাসায় যত টিকটিকি আছে, কী জানি কোন টিকটিকি লবনে ইয়ে করে দিয়েছে কিনা? ভাবলাম কথাটা মিথ্যে নয়। সত্যি যদি টিকটিকি লবনে বিষ্ঠা বা প্রস্রাব করে দেয় তাহলে বাসার সবার ফুড পয়জনিং হতে পারে। দাঁড়িয়ে কী ভাবছো? বললাম, কিছু না। দাঁড়িয়ে না থেকে মুটকিটা খুঁজে দিলেই তো হয়। রামেশ্বর বাবু মুটকিটা দেখতে পেলেন, বোয়ামের পাশে পড়ে আছে। তুলে বললেন এই নাও তোমার মুটকি। এটা নিশ্চয়ই বড় বৌদির কাজ রাত-নেই, দিন নেই, যখন তখন উনার এটা ওটার দরকার হয় আর রান্না ঘরে আসে। রামেশ্বর বাবু সেটা মনে করলেন না, তার স্ত্রী লবনের মুটকি খোলার সময় এটা পড়ে গেছে বোয়ামের পাশে খেয়াল করেনি। বড় বৌদি এ কথা শুনে ছুটে এলেন রান্না ঘরে। কী বললে, তুমি মেজো বৌদি? আমি সব সময় তোমার রান্না ঘরে আসি। রামেশ্বর বাবু এবার বুঝতে পারছেন স্টার জলসার মতো আবার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে গেছে। বড় বৌদি আমার কথা শুনে একেবারে মাজায় কাপড় পেঁচিয়ে এসেছো? ইচ্ছা করে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে। দ্যাখো, মেজো বৌদি তোমার সাথে ঝগড়া করতে আমার বয়েই গেছে। রামেশ্বর বাবু রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে নিজের ঘরে এলেন, ওয়াশ রুমে ট্যাপ ছাড়লেন, হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে। ট্যাপের পানি পড়ার শব্দ ছাড়িয়েও রান্না ঘরের ঝগড়া শোনা যাচ্ছে। কী আমার হায়া-লজ্জা নেই? তোমার আছে? এই শুনছো, রামেশ্বর বাবু বুঝতে পারলেন তার বড় বৌদি বড় দাকে ডাকছেন। তিনি কম্পিউটার রুমের বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন, এখন আর ঘুম আসবে না। তিনি শুনছেন, বড় দাকে বৌদি বলছেন, এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকবো না। এক্ষুণি চলে যাবো। তুমি নতুন বাসা দেখো ভাড়া থাকবো। মেজো বৌদির কথা বার্তায় মনে হচ্ছে এই বাড়িটা শুধু তার একার। এখানে তার আধিপত্য থাকবে। তুমি যদি বাসা না দেখো, আমি বাপের বাড়ি চললাম।
রামেশ্বর বাবু এখন আর কারো ঝগড়া-ঝাটি শুনতে পাচ্ছেন না। বৌদি মনে হয়, কাপড়-চোপড় গোছগাছ করছেন বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্যে। তিনি খাবার টেবিলে এলেন, নাস্তা করার সময় কর্ত্রীকে ধারে কাছে দেখলেন না। তিনি আপন মনে নাস্তা করে কম্পিউটার রুমে এলেন। ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে বাইরে বের হওয়ার সময় বললেন, এই শুনছো, বাইরে যাচ্ছি, দরজটা লাগিয়ে দাও। এবার আওয়াজ এলো পোড়া-কপাল আমার। আমি ছাড়া কী এই বাড়িতে দরজা দেওয়ার আর কোন মানুষ নেই। রামেশ্বর বাবু বাজারে এলেন, গত রাতে ফেরার সময় দোকান বন্ধ থাকায় চাউলের গুঁড়ো আর গুড় আনতে পারেননি।
মুকুল তাকে দেখে বললেন, আরে রামেশ্বর বাবু যে, অনেক দিনপর আপনার পদধূলি পড়লো আমার দোকানে। তিনি বুঝতে পারেন না, তার পদধূলিতে কী এমন আছে, যেটা না পড়লে মুকুলের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। মুকুল বসার জন্যে মোড়া এগিয়ে দিলেন, রামেশ্বর বাবু বসলেন, মুকুল বললেন, চা বলবো, বলুন। তার পুত্র সাদ্দামকে ডেকে বললেন, বাবা তোমার কাকার জন্যে চা নিয়ে এসো। চা খেতে খেতে বললেন, আজকের পেপার আসেনি। জ্বী। তিনি পেপারের প্রথম পাতা দেখে বললেন, নাহ আজকাল নেতিবাচক ছাড়া কোন খবর নেই। শুধু খুন-খারাপী, চাঁদাবাজী আর রাজনৈতিক বক্তব্য। দেশে কী ইতিবাচক কিছু হয় না? উন্নয়ন, কৃষিতে সফলতা ইত্যাদি। পেপারে এসব খবর কম ছাপা হয়। বেশি গুরুত্ব পায় নেতিবাচক খবরাখবর। তিনি পত্রিকা রেখে মুকুলকে বললেন, চাউলের ভাল গুঁড়ো এবং গুড় লাগবে। মেয়ের বায়না পিঠা বানাবে। খুব ভালো চাউলের গুঁড়ো আছে একেবারে ঢেঁকিতে করা গুঁড়ো আর চিনি মেশানো ছাড়া ভালো আখ রসের গুড় আছে। কত কিলো দিবো। রামেশ্বর বাবু জানেন না, কত কেজি লাগবে। তিনি আন্দাজে বললেন, ২ কেজি করে দিন। দাদা তেল লাগবে না। তাকে তেলের কথা কিছু বলা হয়নি। খাঁটি সরিষার তেল আছে, আমি নিজে সরিষা কিনে ঘানিতে ভাঙ্গিয়ে এনেছি। রামেশ্বর বাবু বললেন, ভালো কোন কোম্পানীর সরিষার তেল নেই। কি যে বলেন, থাকবে না কেন? স্কয়ার, প্রাণের তেল আছে।
তিনি বাড়িতে এসে চাউলের গুঁড়ো, গুড় আর তেল মেয়ের হাতে দিলেন। বাবা তুমি যে মনে করে তেল এনেছো। তেলের কথা তো তোমাকে বলা হয়নি। ভালো করেছো। কর্ত্রী কাছেই ছিলেন, বললো, শুধু চাউলের গুঁড়ো আর গুড় আর তেল আনলেই চলবে। তরিতরকারি, মাছ এগুলো নেই। সেটা কে আনবে শুনি? তিনি আবার বেড়িয়ে গেলেন। পথিমধ্যে সাংবাদিক কাজী বাবলার সাথে দেখা হয়ে গেল। রামেশ্বর বাবু আদাব, কেমন আছেন? বাজারে যাচ্ছেন বুঝি? তার হাতে বাজারের ব্যাগ দেখেও তো অনুমান করা যায় তিনি কোথায় যাচ্ছেন। এ রকম প্রশ্ন অনেকই করেন। রামেশ্বর বাবু বললেন, হ্যাঁ, তুমি কেমন আছো, পেপারের কাজকর্ম কেমন চলছে, বললো, আপনার আর্শীবাদে ভালই চলছে। চালিয়ে যাও। বলে তিনি বড় বাজারে এলেন। তরিতরকারি. আর সইল মাছ কিনে বাড়িতে ফিরে কর্ত্রী’র হাতে দিলেন। ভেবে ছিলেন, তাজা মাছ দেখে স্ত্রী তার খুশী হবে, বরং উল্টো হলো, তেতে উঠলেন, এই লাফানো মাছ কুটবে কে? বাজার থেকে কেটে আনতে পারোনি? রামেশ্বর বাবু বললেন, যার কাছ থেকে মাছটা নিয়েছি, তার কাছে কাটার বটি ছিল না। তা আর থাকবে কেন? বাড়িতে কোটার জন্যে আমি তো আছিই। রামেশ্বর বাবু’র ইচ্ছা করছিল না বিষয়টা জানার তাতে তৃতীয় পর্ব শুরু হতে পারে ভেবে, তারপরও জানতে চাইলেন, বৌদি কি বাপের বাড়ি চলে গেছেন? আর যাবে কোথায়, কর্ত্রী গলা চড়িয়ে বললো, বৌদির জন্যে তোমার যখন এতই দরদ উথ্থলে উঠছে, তুমি তার ঘরে গিয়ে দেখে আসো না, ‘তিনি আছেন, না গেছেন।’ এবার জলসার তৃতীয় পর্ব সত্যি শুরু হচ্ছে। রামেশ্বর বাবু তার কম্পিউটার রুমে চলে এলেন, এর মধ্যে বৌদির কন্ঠ শুনতে পেলেন, কি বললে, মেজো আমার জন্যে তোমার বরের দরদ। ছি: একথা বলতে তোমার লজ্জা করে না। আর করবেই বা কেন? কুলমান তো দেখতে হবে। রামেশ্বর বাবু’র স্ত্রী গলা সপ্তমীতে চড়িয়ে বলছে, শুনি তোমার কুল কত বড়? তুমি আমার কুল নিয়ে কথা বলছো। রামেশ্বর বাবু মনে মনে বলছেন, হে ভগবান এদের থামান। নিত্যদিন নানা ছোট্টখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি শুনে পাড়া প্রতিবেশীরই বা কি ভাবে? এই পাড়ায় তাঁর পিতার সুনাম ছিল। তাদের তিন ভ্রাতার শুনাম আছে। এ সবই তো যেতে বসেছে।
রামেশ্বর বাবু স্ত্রীর কথা শুনতে পাচ্ছেন, বড় বৌদির প্রসঙ্গ পাল্টে এখন তার স্ত্রী বলছে, তার হয়েছে যত জ্বালা। রান্না-বান্না আজ আর করা হবে না। উপোস থাকতে হবে। তার মেয়ে বলছে, মা এক্ষুণি হয়ে যাবে। রাম রাম রামেশ্বর বাবুর মেয়ে ডাকলেন, বাবা টেবিলে আসো পিঠা হয়ে গেছে। তিনি দেখলেন, একটি বড় থালায় অনেকগুলো পিঠা ভাজা। দেখে মনে হচ্ছে, এগুলো চিকেন ফ্রাই। মেয়ে বললো, বাবা চাউলের গুঁড়োর সাথে ডিম মিশিয়ে তৈরী করেছি। খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে। রামেশ্বর বাবু হাই প্রেসারের রোগী কুসুম বাদে ডিম খেতে হয় চিকিত্সকের পরামর্শ অনুসারে। চর্বি জাতীয় খাবার যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো ইত্যাদি। চিকিত্সকের পরামর্শ মতে চলেন, তাও রোগ ভাল হয় না, মানুষ মরে যায়। ‘চিকিত্সক কোন মানুষকে বাঁচাতে পারেন না।’ তবুও মানুষের বেঁচে থাকার আক‚তি আছে। সবাই বেঁচে থাকতে চান, অসুখ-বিসুখে ছুটে যায় চিকিত্সকের কাছে। এখন চিকিত্সা, শিক্ষা এই দুই খাতে ব্যয় বেশি। রামেশ্বর বাবু ভাবছেন, মানুষ খেয়ে খুব বেশি পয়সা ব্যয় করেন না। যত বেশি টাকা-পয়সা চিকিত্সা আর শিক্ষার জন্য ব্যয় হয়। বাবা কি ভাবছো। নাহ, কিছু না। তোমার মায়ের কথা শুনলাম একটু আগে, সে কোথায়? কলের ধারে গেছেন, মাছ ধুতে। তিনি জানতে চাইলেন, কুসুম বাদে ডিম দেওয়া হয়েছে কি না? মেয়ে বললো, বাবা কুসুম না দিলে পিঠা ফুলবে কিভাবে। ডিম পুরোটাই ভেঙ্গে দিতে হয়। আমার তো কুসুম খাওয়া নিষেধ। একদিন একটু কুসুম খেলে কিছু হবে না। তোমার মা, বড় কাকা-কাকী আর ছোট ভাইকে ডাকো। মাকে বলেছিলাম, সে পড়ে খাবে। আমার উপর রাগ করে আছে। বড় কাকা আর কাকীকে আমি দিয়ে আসবো। ছোটটা বাড়িতে নেই। আর ছোট কাকা তো দেশে থাকেন না। রামেশ্বর বাবু একটা পিঠা তুলে খেতে শুরু করলেন, মেয়ে জানতে চাইলো, বাবা কেমন হয়েছে, বললেন, খুব ভাল হয়েছে। শুনে ও খুশী হলো। তিনি একটা পিঠা খেয়ে উঠে পড়লেন। বাবা আর একটা খাও থাক মা, পরে খাবো। এমন সময় কলের উপর থেকে স্ত্রীর কন্ঠ শুনতে পেলেন, তোর বাবাকে সবগুলো দে। না খেতে খেতে একেবারে কাঁকলাস হয়ে গেছে। রামেশ্বর বাবু বুঝলেন, ঝাল নিচ্ছে তার উপর। তিনি উঠে তাঁর কক্ষে এলেন। ভাবছেন, কী করা যায়, দুপুর গড়িয়ে আসছে? ক্লান্ত হয়ে পড়ছে দিনের আলো। তিনি কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না। একটা ছোট গল্প লেখা শুরু করে ছিলেন, সেটা শেষ করা দরকার। আজ বোধ আর হবে না। #
লেখক : (সাহিত্যের সেবক, অ্যাডভোকেট জজকোর্ট, পাবনা, বাংলাদেশ। ফ্লোরিডা, ইউএসএ প্রবাসী)
[বি: দ্র: এই গল্পের কাহিনী কাল্পনিক। কারো নামের সাথে মিলে গেলে তা অনিচ্ছাকৃত ]