অনলাইন ডেস্ক : প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় এলাকায় অন্তত ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তীব্র গতির বাতাস আর প্রবল বর্ষণের কারণে দুই দেশের উপকূলীয় এলাকার দুই কোটিরও বেশি মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট; ডুবে গেছে মাছের ঘের ও আবাদি জমি।

চলতি প্রাক-বর্ষা মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রথম ঘূর্ণিঝড় রেমাল রোববার রাতে বাংলাদেশের উপকূলীয় কয়েকটি জেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় আছড়ে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রে পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিচু উপকূলীয় এলাকায় প্রায়ই এই ধরনের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে।

আবহাওয়া কর্মকর্তারা বলেছেন, রোববার গভীর রাতে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর মোংলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী সাগর দ্বীপের আশপাশের এলাকা অতিক্রম করেছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। তবে এই ঝড়ের অগ্রভাগের আঘাত শুরু হয় রাত ৯টার দিকে। ঘূর্ণিঝড়টি কিছুটা দুর্বল হওয়ার পর সোমবার সকালের দিকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অতিক্রম করছে কিছুটা ধীরগতিতে।

বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আসা শুরু করেছে। এর সাথে সাথে উভয়দেশেই ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান মিজানুর রহমান টেলিফোনে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে বাংলাদেশে অন্তত ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য দেননি তিনি।

যদিও এর আগে তিনি বলেছিলেন, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার সময় দু’জন নিহত হয়েছেন। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পুরো পরিমাণ জানার জন্য কর্তৃপক্ষের আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘‘মানুষ সাধারণত তাদের গবাদি পশু ও ঘরবাড়ি ছেড়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান না। তারা একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন; যা এই ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক দেরী হয়ে যায়।’’

এদিকে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে ঝড়ের আঘাতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে প্রদেশে মৃতের সংখ্যা ৬ জনে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে সেখানকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। প্রদেশের রাজধানী কলকাতায় কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে একজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এছাড়া সুন্দরবন লাগোয়া মৌসুনি দ্বীপে একটি মাটির বাড়ি ধসে এক নারী নিহত হয়েছেন।

ঢাকায় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, দুর্ঘটনা এড়াতে আগে থেকেই উপকূলীয় কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক উপকূলীয় শহরে গাছ পড়ে এবং বিদ্যুতের লাইন ভেঙে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে।

উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার বাসিন্দা রাহাত রাজা বলেন, ‘‘রাত থেকে আমাদের এখানে কোনো বিদ্যুৎ নেই। যে কোনো সময় আমার মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যাবে। আল্লাহর রহমতে আমরা যতটা ভেবেছিলাম ঘূর্ণিঝড়টি ততটা সহিংস হয়নি।’’

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দেশের উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ২ কোটি ২২ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। সংস্থাটি বলেছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবের সময় ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এসব গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে অনেক এলাকা ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা যাবৎ বিদ্যুৎবিহীন রয়েছে। ঝড় পুরোপুরি থেমে গেলে বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় আছেন পল্লীবিদ্যুতের কর্মীরা।

অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ কর্তৃপক্ষ বলেছে, রেমালের আঘাতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় এক হাজার ২০০টি বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে। এছাড়া ঝড়ের তাণ্ডবে রাজ্যে তিন শতাধিক মাটির ঘর ধ্বংস হয়েছে। প্রচণ্ড বাতাসের কারণে অনেকের বাড়িঘরের টিন ও খড়ের ঘরের ছাদও উড়ে গেছে। বৃষ্টি ও উচু জোয়ারের কারণে সুন্দরবনের কিছু বাঁধ এবং উপকূলীয় অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঝড়ের তাণ্ডব থেকে মানুষকে রক্ষায় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৮ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে লাখ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়। উপকূলীয় এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ও মানুষকে সতর্ক করতে ৭৮ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। এদিকে, বৃষ্টির কারণে রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এতে রাজধানীতে যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটেছে।

মোংলার বাসিন্দা নৌকার মাঝি শাহ আলম রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘তিনি গত কয়েক দশকের মধ্যে এত দীর্ঘ ঘূর্ণিঝড় আর দেখেননি। সাধারণত ঝড় কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। কিন্তু এই ঝড় গত রাত থেকে চলছে। আমি জানি না এটা কখন শেষ হবে।’’

ঝড়ের কারণে দেখা দেওয়া ভারী বৃষ্টিপাতে কলকাতার অনেক রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। স্থানীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ছবিকে দেখা যায়, শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেয়াল ধসে পড়েছে। কলকাতায় অন্তত ৫২টি গাছ উপড়ে পড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। কলকাতা বিমানবন্দরে ৫০টিরও বেশি ফ্লাইট বাতিল করার পর সোমবার পুনরায় চালু করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের কর্তৃপক্ষ বলছে, উভয় দেশে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৮ লাখ এবং ভারতে প্রায় দুই লাখ। ঝড়টি বর্তমানে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিকেলের মধ্যে ধীরে ধীরে আরও দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সূত্র: রয়টার্স।