অনলাইন ডেস্ক : বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও অনেক কৃষি পণ্যই আমদানি করতে হয়। এতে একদিকে যেমন আমদানি বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে বৈশ্বিক সংকটের কারণে মাঝে মাঝেই আমদানি বিড়ম্বনায় পড়তে হয। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ আমদানি হয় চীন থেকে, এরপরেই রয়েছে ভারত। দেশটি থেকে যেসব খাদ্যপণ্য আমদানি হয় তার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, আলু, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, সূর্যমুখী ও সয়াবিন তেলসহ ভোজ্যতেল, চিনি, মধু, কোমল পানীয়, চিপস, বিস্কুট, চকলেট ও ক্যান্ডি জাতীয় খাবার।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। যার ৯৫ শতাংশই আসে ভারত থেকে। সেজন্য ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশের বাজারে দাম বাড়ে। যদিও, সম্প্রতি পাকিস্তান, মিশর ও চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আমদানি করা শীর্ষ দশটি পণ্যের মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে অপরিশোধিত চিনি, পাম তেল, সয়াবিন তেল, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, আদা, মরিচ, গম, চাল, মসুর ডাল এবং পেঁয়াজ। এছাড়া রসুন, চা, তেলবীজ এবং হলুদ রয়েছে শীর্ষ খাদ্য সামগ্রী আমদানির মধ্যে রয়েছে।

আমদানিকৃত এসব পণ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো-পেঁয়াজ ও আলু। যদিও দুটি পণ্যই চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে আলুর বাৎসরিক চাহিদা ৭৫-৮০ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন ১০৪ লাখ মেট্রিক টন। পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ লাখ মেট্রিক টন, উৎপাদন ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঘাটতি না থাকলেও প্রতি বছরই পেঁয়াজ-আলু আমদানি করা হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রাশিদুল ইসলাম বলেন, দেশে ১০০ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়, চাহিদা রয়েছে ৬০ লাখ মেট্রিক টন। তবুও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলু আমদানি করা হয়েছে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও কেনো আমদানি করছে, এর কারণ খুঁজে বের করত হবে।

তিনি বলেন, গরু, মুরগী ও মাছের খাদ্য হিসেবে ভুট্টা ব্যবহার হচ্ছে। ফলে ভুট্টা চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় আলুর জমি কমছে। কৃষকরা মাঝে মাঝে আলুর পরিবর্তে ভুট্টা চাষ করেন। আবার কোনো বছর ভুট্টা থেকে আলুর চাষ বেশি করেন। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে আলুর বাজারে।

সংরক্ষণে সমস্যা
অধ্যাপক ড. মো. রাশিদুল ইসলাম বলেন, সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতার কারণে আলু আমদানি করতে হয়। মৌসুমে উৎপাদিত আলু সারাবছর চাহিদা মেটানোর জন্য যেভাবে সংরক্ষণ করা দরকার, তা হয় না। এছাড়া পর্যাপ্ত সংরক্ষাণাগারও নেই। অনেক আলু চাষী কোল্ডস্টোরেজ ফাঁকা পান না। সেখানেও সিন্ডিকেট রয়েছে। তাই বাজারে পর্যাপ্ত আলু সরবরাহের জন্য কোল্ডস্টোরেজের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া অধিক লাভের জন্য অনেকে আলুবীজের ব্যবসায়ের দিকে ধাবিত হয়েছেন, এতে বাজারে আলু সরবরাহের পরিমাণ কমেছে।

রোগবালাই
গেল বছর নাবি ধ্বসা রোগের কারণে আলু উৎপাদন কম হয়েছে জানিয়ে ড. মো. রাশিদুল ইসলাম বলেন, নাবি ধ্বসা রোগ হলে আলু নষ্ট হয়ে যায়। তাই চাষীরা লোকসানের ভয়ে পরিপক্ক হওয়ার আগে আলু সংগ্রহ করে বিক্রি করে দেন। ফলে চলতি বছরে ঘাটতি দেখা দেয়। তাই চলতি বছর বাজার দাম কমার সম্ভাবনা কম। সবশেষ চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হলেও কেনো আলু আমদানি করা হচ্ছে, সে বিষয়ে তদন্ত করে কারণ খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

আমদানি নির্ভরতা কেনো কমানো যায় না
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসাইন সিদ্দিকী বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরকারি পরিসংখ্যানে ভুল আছে। এটি বুঝা যায়, রাষ্ট্রের চাহিদা, যোগান ও আমদানির চিত্র দেখে। এজন্য অনেক কৃষিপণ্য উদ্বৃত দেখালেও আমদানি করতে হয়। নতুবা সরকারই ভক্ষক। তিনি বলেন, আমদানি যেহেতু করতে হয়, তাই যেখান থেকে আমদানি করলে ব্যয় কম হয়, জনগণ উপকৃত হয়, সেখান থেকে আমদানি করা দরকার। আমদানির ক্ষেত্রে ভূরাজনীতির প্রভাব রয়েছে। তবে জনগণের স্বার্থ অবশ্যই দেখতে হবে।

নির্ভুল ডাটা সংগ্রহ
অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসাইন সিদ্দিকী আরও বলেন, শুধু আলু পেঁয়াজ নয়, সব পণ্যের ডাটা সঠিকভাবে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা করতে হবে। ডাটার উৎসগুলো যাতে প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমদানির নির্ভরতা কমাতে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আপনি পথ চলবেন। কোন দিকে যাচ্ছেন বুঝা যাবে।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
সরকারকে আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসাইন সিদ্দিকী বলেন, প্রয়োজনে প্রতিটি খাদ্যশস্যের চাহিদা হিসাব করে গবেষণা এবং বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকে আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। এজন্য কোন অঞ্চলে কী চাষ করা হবে, তা গবেষণা করে ঠিক করা দরকার।