ইব্রাহীম চৌধুরী : বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা তরুণ মিলিয়নিয়ার ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ডের ১০ দিন পরও এ নিয়ে আলোচনা থামছে না। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ হচ্ছে। নিজের সহকারীর আর্থিক দুর্নীতি ধরে ফেলায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে। শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি সন্দেহভাজন খুনি। এ ঘটনার পর পার্টি করারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। তবে কেন মেধাবী এই তরুণ খুন, সে প্রকৃত কারণ কখনো প্রকাশ্য আসবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান সবাই।

নিউইয়র্কসহ আমেরিকার সব ধর্ম–বর্ণের মানুষ ফাহিমের হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছে। এ লক্ষ্যে নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরে নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বাংলাদেশি আমেরিকা কিছু তরুণ উদ্যোক্তাও সক্রিয় হয়েছেন এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারের দাবি নিয়ে। একই সঙ্গে মানুষ ম্যানহাটনের ইস্ট হাউস্টনের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে প্রতিদিন ফুল দিয়ে শোক–শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন বাংলাদেশি আমেরিকান এই মেধাবী তরুণের প্রতি।

আমেরিকান কোন অপরাধের তদন্তে নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে জোরালো কোন প্রশ্ন থাকে না। তদন্ত প্রভাবিত হওয়ারও কোন কারণ নেই। এমন অপরাধের বিচার নিশ্চিতই হবে। তারপরও বহু মানুষ বলে থাকেন, প্রকৃত ঘটনা আমরা কখনো জানতে পারব না। এমন কথা আততায়ীর হাতে নিহত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজও বলা হয়ে থাকে। নিউইয়র্কে মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকলেও আইন পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছেন মানুষ।

ফাহিম হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার তাঁর সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিল এখনো মুখ খোলেননি। তদন্তের কোন অগ্রগতির কথা নিউইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। তবে রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক হ্যাসপিলের এক নিকটাত্মীয় ২১ বছরের হ্যাসপিলকে নিয়ে মুখ খুলেছেন। হ্যাসপিলের শৈশব সমস্যাগ্রস্ত ছিল। তবে তাঁর পেশাদার খুনির আচরণ অনেকেই মেলাতে পারছেন না। কারণ শৈশব ও কৈশোরে তিনি কখনো সহিংসতা দেখাননি। এ ধরনের অপরাধে জড়িতদের চরিত্রের মধ্যে কোন না কোনোভাবে সহিংসতা পাওয়া যায়। ফলে ফাহিম হত্যার ঘটনায় এই তরুণের জড়িত থাকার সংবাদে অনেকে অবাকই হচ্ছেন।

নিজেকে হ্যাসপিলের আন্ট (Aunt) পরিচয় দেওয়া মারজোরি সাইন নামের এক নারী নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, হ্যাসপিল শান্ত ছেলে ছিল। কোন কোন সময় বিরক্তিকর আচরণ করলেও কখনো তার মধ্যে সহিংসতা দেখা যায়নি। তবে হ্যাসপিলের শৈশব মোটেই স্থিতিশীল ছিল না। তাকে আত্মীয়দের ঘরবাড়ি ও আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করে থাকতে হয়েছে।

ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ড থেকে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত হ্যাসপিলকে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে দেখা গেছে। পুলিশ হাতে ধরা পড়ার আগেও সে পার্টি বেলুন কিনেছে। বেলুন কিনে সড়কে নেমে ডেলিভারি নিয়েছে বলে সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা গেছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর নিউইয়র্ক পুলিশের একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, এই লোকটি আমেরিকার নতুন ধরনের ‘সাইকো’!

মারজরি সাইন বলেন, হ্যাসপিল শিশু অবস্থায় তাঁর মাকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ পাগলখানায় চলে যেতে হয়েছে। ভ্যালি স্ট্রিম এলাকায় নানির কাছে আশ্রয় হয় তার। তার বয়স যখন ১২, তখন নানিও মারা যান। এরপরই নিকটাত্মীয় হিসেবে তাঁর কাছে হ্যাসপিলের আশ্রয় হয়। তবে তারকথা না শোনায় প্রায় ১৭ বছর বয়সে তিনি হ্যাসপিলকে একটি ফস্টার (পালিত) কেয়ার পরিবারে পাঠিয়ে দেন। এ নিয়ে মারজী আদালতে গেছেন। আদালতকে জানিয়েছেন, তিনি হ্যাসপিলকে আর লালনপালন করতে পারছে না। এর মধ্যে পরের বছরই হ্যাসপিলের বাবাও মারা যান। ফাহিম সালেহর ব্যক্তিগত সহকারী হ্যাসপিল সর্বশেষ ব্রুকলিনের প্রস্পেক্ট পার্ক এলাকায় বসবাস করতেন।

ফাহিম সালেহর হত্যাকাণ্ডের পর হ্যাসপিলকে যেভাবে দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে আগের কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে না। সম্পূর্ণ অহিংস চরিত্রের এমন এক তরুণ ঠান্ডা মাথায় পেশাদার খুনির মতো খুন করেছে।

১৩ জুলাই বেলা ১টা ৪০ মিনিটে ফাহিম যখন ইস্ট হাউস্টন স্ট্রিটে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের লিফটে ওঠেন, তখন এক ব্যক্তিও তাঁর পিছু পিছু দ্রুত লিফটে ঢুকে পড়েন। তদন্তকারীরা বলছেন, ওই ব্যক্তিই টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিল। তাঁর সঙ্গে থাকা ব্যাগে ইলেকট্রিক করাত ছিল বলে তাঁদের ধারণা। লিফটের ভেতরের সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ফাহিম ওই ব্যক্তিকে কিছু জিজ্ঞেস করছেন। এরপর কিছু কথা বিনিময় হতে দেখা গেছে দুজনের মধ্যে। পর মুহূর্তে ফাহিমকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখাচ্ছিল।

ফাহিম লিফট থেকে বাইরে পা রাখতেই মাস্ক পরিহিত ওই ব্যক্তি ফাহিমকে আক্রমণ করেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, টিজার দিয়ে পেছন থেকে আঘাতের পর ফাহিম সামনের দিকে পড়ে যান। এরপর লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সিসি টিভির ফুটেজ আর রেকর্ড হয়নি। তদন্তকারীরা মনে করেন, এরপরই হ্যাসপিল ছুরিকাঘাত করে ফাহিমকে হত্যা করেন। পরে হ্যাসপিল কার সার্ভিস ডেকে হোম ডিপোয় চলে যান। কার সার্ভিসের সেই পেমেন্ট তিনি পরিশোধ করেছেন ফাহিমের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে। হোম ডিপো থেকে কিছু ক্লিনিং আইটেমও কেনেন হ্যাসপিল।

ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের লিফটের সিসি টিভি ক্যামেরায় দেখা যায়, পরদিন ১৪ জুলাই দুপুরে আবার ফিরে আসেন হ্যাসপিল। সঙ্গে ছিল রিচার্জেবল ভ্যাকিউম। পুলিশের মতে, হত্যার পর লক্ষণ মুছে ফেলার চেষ্টায় ভ্যাকুউম ব্যবহার করা হয়েছিল।

পুলিশের ধারণা, ১৪ জুলাই দুপুরে ইলেকট্রিক করাত ব্যবহার করে ফাহিমের দেহ খণ্ডবিখণ্ড করেন হ্যাসপিল। এ সময় ফাহিমের বোন অ্যাপার্টমেন্টের দরজা নক করেন। তিনি পুলিশকে ‘ওয়েলফেয়ার চেকের’ (নিকটাত্মীয় বা প্রতিবেশীর অপমৃত্যু হয়েছে এ রকম আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চাওয়া) অনুরোধ জানান। তবে পুলিশ আসার আগেই ভবনের পেছনের সিঁড়ি দিয়ে হ্যাসপিল পালিয়ে যান।

এখন পর্যন্ত ঘটনার বিবরণে এমন তথ্যই জানা গেছে পুলিশের পক্ষ থেকে। ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের সূত্র ধরেই ১৭ জুলাই প্রায় এক মাইল দূরের একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে হ্যাসপিলকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিন না দিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। হ্যাসপিল এখনো কোনো তথ্য দেননি। তবে তিনি নিজেকে নিরপরাধ বলে দাবি করছেন।

ফাহিমের দাফন সম্পন্ন

১৯ জুলাই পারিবারিক আয়োজনে নিউইয়র্ক আপ স্টেট উইন্ডসর শহরে নূর মুসলিম কবরস্থানে ফাহিমের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। জানাজা ও দাফনের সময় ফাহিম সালেহর পরিবারের লোকজনসহ আমন্ত্রিতরা উপস্থিত ছিলেন। জানাজা ও দাফনের সময় কোনো সংবাদমাধ্যমকে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

ফাহিম সালেহর আপ স্টেটের স্কুলের কয়েকজন সহপাঠী জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বন্ধুর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফাহিম সালেহর মরদেহ কবরস্থানে পৌঁছায়। আধা ঘণ্টার মধ্যেই সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়। নিউইয়র্ক পুলিশের পাহারায় লাশবাহী গাড়ি কবরস্থানে নিয়ে যায়। পুলিশের উপস্থিতিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

খুনির শাস্তির দাবিতে কর্মসূচি

২১ জুলাই সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বাংলাদেশি-আমেরিকান কমিউনিটি কাউন্সিল-বিএসিসির আয়োজনে র্যালি ও প্রার্থনা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই নিষ্ঠুর-নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার ফাহিম সালেহ’র আত্মার মাগফিরাত কামনায় বিশেষ প্রার্থনা করা হয়।

ব্রুকলিনে বাংলাদেশ মুসলিম সেন্টারের সামনে প্রবাসীদের মানববন্ধন থেকে ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান হয়েছে। ২০ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সন্দ্বীপবাসীর আয়োজনে ফাহিম সালেহ হত্যার প্রতিবাদ মানববন্ধন কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী অংশ নেন। এতে অংশগ্রহণকারীরা ফাহিমের ছবিসহ পোস্টার-প্লে কার্ড হাতে ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানিয়ে নানা স্লোগান দেন।

স্ট্রং ওমেনস্ কমিউনিটি নামের একটি সংগঠন ২১ জুলাই ফাহিমের খুনির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে। ওমেন্স কমিউনিটির সংগঠক মনিকা হক এবং তাঁর টিম দাবি করেন, সেকেন্ড ডিগ্রি নয়, ফার্স্ট ডিগ্রি নয় বরং যেভাবে ফাহিমকে ইলেকট্রিক করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে মেরে ফেলা হয়েছে, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। একই দাবিতে সমাবেশ হয় ক্যালিফোর্নিয়ায়।

‘জাস্টিস ফর ফাহিম সালেহ’ শিরোনামে বাংলাদেশি আমেরিকান তরুণ পেশাজীবী ও উদ্যোক্তারা ২৫ জুলাই জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার্সিটি প্লাজায় ‘শোক ও প্রার্থনা সমাবেশ’ আহ্বান করেছে। এ সমাবেশের উদ্যোক্তারা নিউইয়র্কের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের সংস্কার করে ঘাতকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের দাবি জানাচ্ছেন।