সাজ্জাদ আলী : ফজরের আজান দেবে বলে হাসমত কাকা বারান্দায় বসে ওজু করছে। ঈমান দাদা গোয়াল ঘরে গরু-বাছুর নিয়ে ব্যস্ত। গওড়ার মধ্যে কুচিকুচি করে খড় কেটে রেখেছে আবাল গরুগুলোকে খাওয়াবে বলে। আর তাগারিতে গরম পানি ঢেলে কুড়া মাখাচ্ছে, সেটা গাই গরুর খাবার। জেলে বুজি গবর গুলিয়ে বাইর বাড়ির উঠোন লেপছে। আর মাফিকের মা রান্নাঘরের দো-চুলায় দুই ডেকচিতে গুড়ের ফিরনি রাঁধছে। তার পাশে বসে মঞ্জু ফুফু আর কুটি পিসি দ্রুত হাতে সিদ্ধ আটার রুটি বেলছে। ওগুলোই আজ বাড়িসুদ্ধ লোকের সকালের নাস্তা।

গোয়াল ঘরের সামনেই উঁচু দোতলা খোপ। তার নিচতলায় মোরগ-মুরগি আর ওপরের তলায় কবুতরদের বাস। তখনও ওদের দরজা খোলা হয়নি। খোপের মধ্যেই ওরা বাকবাকুম আর কক কক শব্দে ডেকে ফিরছে। পাচু ভাই গোলা ঘরের তালা খুলে বেছন ধানের কোলাগুলোর ধুলো ঝাড়ছে। ওদিকে আমাদের খালেক কাকা দক্ষিণ ঘরের কোণার গাব গাছ থেকে আধা ধামা কাঁচা গাব পেড়েছে। এখন মুগুরের ওপরে গাব রেখে কুঁচিকুঁচি করে কাটবে। কুচানো সেই গাব পানিতে মিশিয়ে তার মধ্যে খ্যাপলা জাল ভিজিয়ে রাখা হবে। তাতে করে জালের আয়ু বাড়বে। এ সব চিত্র আমার দাদীবাড়ির এক ভোরবেলার। সবই আমার শৈশবে দেখা। তখনকার দিনগুলো মোটামুটি এভাবেই শুরু হতো।

দাদী ঘুম থেকে উঠেছেন, তবে ঘর থেকে বের হননি। পালঙ্কে বসেই আদা চা খাবেন। তারপর ধূমপান সেরে তবেই তিনি ভেতর বাড়ির উঠোনে পা রাখবেন। আর তাঁর পা রাখার মানেই তো বাড়ির লোকজনদের একেবারে থরহরি কম্প!

খালেক কাকার গাব কুচানো এগুচ্ছে না! কোথা থেকে যেন মিষ্টান্নের গন্ধ এসে হু হু করে তার নাকে ঢুকছে। এ অবস্থায় কাজ করা দায়! ধারালো দা, গাবের উপরে না পড়ে যদি আঙুলে পড়ে তো দফা ঠান্ডা! ঝুঁকি না নিয়ে উঠে পড়লো খালেক কাকা। মিষ্টি গন্ধটি শুকতে শুকতে একেবারে রান্নাঘরের দরজায় হাজির। ও মাফিকির মা, কী রান্দো? মিটিমিটি হেসে খালেক কাকার প্রশ্ন।

কাঠের মোটা নাহড়ের আগায় এক দলা ফিরনি উঠায়ে মাফিকের মা বলল, খালেক ভাই চাইখ্যা দেহ তো মিঠা হইলো কিনা?

একগাল হেসে গরম ফিরনি মুখে পুরলো খালেক কাকা। গালের ভেতরে এপাশ ওপাশ করে স্বাদ নিয়ে গিলে ফেললো। কিন্তু কতটা মিস্টি হয়েছে, তা নিয়ে কোনো কথা বলছে না। ওদিকে মাফিকের মা মন্তব্য শোনার অপেক্ষায়। আরো গুড় দিতে হবে কি না তার বোঝা চাই। জিজ্ঞাসা করলো, খালেক ভাই মিঠ্যা ওইছে?

আরেট্টু ফিন্নি দেও, খাইয়া কইত্যাছি মিঠা হলো কি না, খালেক কাকার রসনাই জবাব।
তোমার খাওয়ার খাইছল্যাত আর বদলাইলো না! ডেকচি থেকে আরেক দলা ফিরনি তুললো মাাফিকের মা। পেটুক খালেককে নিয়ে সে বড়ই ত্যাক্ত।
ফিরনির দলা মুখে পুরতে পুরতে খালেক কাকা বলে, দ্যাহ মাফিকির মা, খালেক কোনোদিনও খাওয়ার জন্যি পাগল না!

এ কথা শুনে মঞ্জু ফুফু আর কুটি পিসি তো হেসে গড়াগড়ি যায়। মাফিকের মা মুখটিপে বলে, হ তা সবাই জানে। তুমি খাওয়ার পাগল হইবা ক্যান? তয় অহন কও দেহি মিঠ্যা ওইছে কি না?

দাদীর নৌকাগুলোর দেখভাল করাই খালেক কাকার প্রধান কাজ। আমাদের বিল অঞ্চল, বছরের ৭ মাসই নৌকায় চলাচল। ঘাটের ছই দেওয়া পানসি নৌকাখানার কান্ডারি খালেক কাকা। নৌকায় তোশক বিছানো, বালিশ পাতানো। কোলবালিশেরও ব্যবস্থা আছে। আব্বা প্রতিদিনই ওই নৌকায় চড়ে তাঁর মিটিং-মিছিল-সালিসি করে বেড়ায়। এছাড়াও বাড়ির মেয়েরা, মানে আম্মা, মেজচাচি ও ফুফুদের নাইওর নেওয়া আনাও খালেক কাকার দায়িত্ব। দক্ষ মাঝি সে। ঝড়-বাদল, বৃষ্টি-রোদ কিছুতেই তার বৈঠা টলে না।

একদিন হয়েছে কি, আমাদের হাসান আর আসলাম পেয়ারা গাছে উঠেছে। যে সে পেয়ারা না। কুসুম পেয়ারা, ভেতরে টকটকে লাল কিন্তু বাইরে সবুজ। কামড় দিলে মিস্টি রসে গাল ভরে যায়। গাছের একেবারে ছিটকি ডালে কদিন থেকে ৫/৬টি ডাসা ডাসা পেয়ারা পেকে রয়েছে। চ্যাংটা হাসান সরু ডালে ভর করে আলগোছে ওগুলো ছিঁড়ছে। অসাবধানে তার হাত থেকে একটা পেয়ারা তলায় পড়লো। সাথে সাথে সেটি কুড়িয়ে নিয়ে খালেক কাকা কামড় বসিয়ে দিয়েছে। আরে কি কইরলা কি কইরলা খালেক ভাই, এই পেয়ারাগুলান কালাবুজির বাড়ি পাঠাবো বইল্যা পাড়তেছি, হাসান মগ ডাল থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।

ওই ছ্যামড়া, তোর এই গয়া মিঠা না, ভাল দেইখ্যা আরো পাড়।
তুমারে কইছে মিঠা না? খাওয়ার কিছু দেখলি তোমার মাথাডা আর ঠিক থাহে না খালেক ভাই, বলল আসলাম।
ওই বান্দর, তগো কতবার কবো যে খালেক খাওয়ার পাগল না।

ভেতর বাড়ির উঠোনে হাতলওয়ালা চেয়ারখানা পেতে বসে আছেন দাদী। হাক ছেড়ে ডাকলেন আমায়। দৌঁড়ে এসে তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বললেন, যাও ভাই হাত মুখ ধুইয়া আইস। মাইজ্যা চাচিরে কও তোমারে সাজাইয়া দিতি। বড় ফুফুরে আনতি তুমি রাজপাট যাবা।

আমি তো বিরাট খুশি। রীনা আপা, সহিদভাই, শোভা, লিমা, সব আমার খেলার সাথী। এদের আনতে যাবো! আমাকে আর পায় কে? তবে আমি খুশি হলেও খালেক কাকা বেজার। তার রাজপাট যাওয়া হচ্ছে না। দাদি এ দায়িত্ব আজ পাচুভাইকে দিয়েছেন। সে হবে নৌকার মাঝি আর আমি চড়ন্দার। খালেক কাকার আজকের কাজ, পশ্চিম মুড়ার লাটিম গাছের ডাল কেটে চলা ফাঁড়া।

বাবার বাড়ি থেকে যেই যায়, বড় ফুফু নিজে বসে থেকে তাকে পেট পুরে মিস্টি মন্ডা খাওয়ায়। আর আজ কি না সেই মিশন থেকে খালেক কাকা বাদ! হাতে কুড়াল নিয়ে বেজার মুখে লাটিম গাছের তলায় জাবড়ায়ে বসে আছে সে। খালেক কাকার কাছে রাজপাট মানেই ভুরি ভোজন! ওদিকে পাচুভাই যাওয়ার আয়োজন করছে। বৈঠা চৈড় গোছাচ্ছে। কাঁশফুলের ঝাড়– দিয়ে নৌকার বিছানা বালিশ ঝাড়ছে। এ নৌকায় আজ বাড়ির বড় মেয়ে উঠবে। সে তো চাট্টিখানি কথা না। পানের থেকে চুন খসলে খবর আছে।

বাড়ির লোকদের সুবিধা অসুবিধার দিকে মেজকাকির সজাগ দৃষ্টি। সবার আব্দারও তার কাছে। খালেক কাকার বেহাল দশা দেখে কাকি জিজ্ঞাসা করলো, ভাইজান কী হইছে?
না বউ কিছু না, শরীলডা ভাল লাগতিছে না, নিচু গলা খালেক কাকার।
ওই পাচু ব্যপার কী রে? তুই নৌকা ঝাড়ামোছা করতিছিস ক্যান?
কাকী, দাদীআম্মা আমারে রাজপাট যাইতে কইছে, জানান দিলো পাচু ভাই।
ও তাই কও! এতক্ষণে বুঝলাম। আইচ্চা আমি দেখতিছি ব্যপারটা, বলে মেজচাচি ভেতর বাড়িতে ঢুকলো।
মাথায় ঘোমটা টেনে, নত মুখে মেজচাচি দাদির কাছে এসে দাঁড়ালো। কিছু কইবা মাইজ্যা বউ, দাদী চোখ তুলে তাকালেন।
আম্মা, খালেক ভাইরে রাজপাট পাঠান। আপনি তো জানেনই বড়বুজির বাড়ির খাওয়া দাওয়ার উপর তার কতটা লোভ। মুখখান বেজার কইর‌্যা বইসা আছে সে। দেখলিও মায়া লাগে।
খালেকের আর খাইয়া প্যাট ভরবি না কোনোদিন। ওর প্যাট ভরলিও চোখ ভরে না! আইচ্চা তুমি যাও, পাচুরে তয় চলা ফাড়তি কও, বিরক্ত হয়ে দাদী বললেন।
ফুফু বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়তেই আমি লাফ দিয়ে নেমে এক দৌঁড়! দূর থেকে আমাকে দেখে ফুফু দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সোজা গিয়ে তাঁর বুকে আছড়ে পড়লাম। ওরে দ্যাখ তোরা আমার আব্বা আইছে রে! কি যে খুশি ফুফু! আমার মুখ মাথা চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলছেন। আমি বললাম, ফুফু আপনারে নিতি আইছি। দাদী আপনারে যাইতি কইছে। শিগ্রী নৌকায় ওঠেন।

দুটো টুকরিতে রিনা আপা সবার কাপড়চোপড় ভরছে। অন্তত ৫/৭ দিন নানীর বাড়ি থাকতে হবে। ঘরের মেঝেতে পিড়ি পেতে খালেক কাকা খাচ্ছে। পাশে জলচকিতে বসে ফুফু নিজে তার খাবার বেড়েকুড়ে দিচ্ছে। বড় কাঁসার থালাখানা নারকেলের নাড়–, চাল কুমড়ার মোরাব্বা, খইয়ের মোয়া, বাতাসা, দানাদার, চিনির সন্দেশ ইত্যাদি দিয়ে ভরা। পাশে আরেক বাটি ভর্তি গুড়ের পায়েস। সবই খালেক কাকার জন্য। সে হাপুসহুপুস করে খাচ্ছে। এক গালে মোরাব্বায় কামড় দিচ্ছে তো আরেক গালে দুটো দানাদার ঢোকাচ্ছে। খাবারে মুখ ভর্তি, ঠিকমতো চাবাতেও পারছে না। আবার থালার বাকি মিস্টিগুলোর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সে চোখ দিয়েও খাবে।

রিনা আপা কাপড় ভাজ করছে আর খাওয়ার তরিকা দেখে মিটিমিটি হাসছে। একবার বলে উঠলো, ও মামা আস্তে আস্তে খান, গলায় বাইদা যাবি তো। সবই তো আপনার। আমরা ভাগ চাবো নানে।
ফুফু ধমকে উঠলো, অ্যাই মাইয়া তুই তোর কাম কর। খালেক ভাইর খাওয়া আমি দেখতেছি।
খালেক কাকার এই খাওয়ার লালসাটা তল্লাটে সবাই জানে। তলে তলে তা নিয়ে বিস্তর হাসিঠাট্টাও চলে। কিন্তু কেউ তার সামনে কিছু বলে না। লোকে সব থেকে মজা পায় যখন সে বলে যে “খালেক কোনোদিনও খাওয়ার জন্যি পাগল না”!
বলতে গেলে প্রায় চারজনের খাবার সে শেষ করে ফেললো। তারপরেও ফুফরু জিজ্ঞাসা, ও খালেক ভাই প্যাট ভরছে? আর কিছু খাইতি মন চায়? দেবো কিছু?
না না বুন্ডি ম্যালা খাইছি। তয় দ্যাহো মুরাব্বা যদি থাহে, দুএকখান দিতি পারো।
ফুফু তাড়াতাড়ি উঠে ডেকচির মধ্য থেকে আরো মুরাব্বা বের করতে লাগলো। সহিদ ভাই, আজাদ, লিলি ফুফু ওরা সবাই দরজায় উঁকি দিয়ে দিয়ে খালেক কাকার খাওয়া দেখছিলো। মায়া ফুফু সাহস করে বলে উঠলো, ও ভাবি আপনার ভাইর পাত তো খালি! খাবার দ্যান নাই? নাকি খাইয়া থাল খালি কইরা ফালাইছে?
ফুফু তেড়ে উঠলো, ওই শয়তানগুলান তোরা গেলি এখান থেকে! ফাজিলগুলান কোথাকার!
ফুফু বাড়ির লোকেরা সবাই আমাদের বিদায় দিতে ঘাটে জড় হয়েছে। আমি নৌকার আগার গলুইয়ে দুপা ছড়িয়ে বসে আছি। ফুফু ছইয়ের ভেতরে ঢুকে আরাম করে বসে হাত নেড়ে তার দেবর ননদদের থেকে বিদায় নিচ্ছে। আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে খালেক কাকা নৌকা ভাসালো।

অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে সিপার কাকা উঁচু গলায় জিজ্ঞাসা করলো, ও খালেক ভাই, আইজ তোমার বুন্ডি কি কিছু খাইতি দিছিলো তোমারে?
বৈঠা বাওয়া বন্ধ করে ঘাড় ফিরায়ে খালেক কাকা বলল, ভাইডি সিপার একখান কতা কই, শুইনা রাহো “খালেক খাওয়ার পাগল না”।

(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)