অনলাইন ডেস্ক : করোনা মহামারীর রেশ কাটার আগেই শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, চলতি বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন কমবে প্রায় দেড় শতাংশ। এর মধ্যে ইউরোপ অঞ্চলে কমবে প্রায় ৮ শতাংশ এবং ওশেনিয়া অঞ্চলে কমবে ১৪ শতাংশেরও বেশি। সংস্থা দুুটি মনে করে, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহে সবচেয়ে বেশি বিঘ্ন ঘটাচ্ছে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে আসছে বছরে বৈশ্বিকভাবে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। কিন্তু দুর্ভিক্ষ এড়াতে বিশ্বের ক্ষমতাধর সংস্থা ও জোটগুলোকে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ যতটা দীর্ঘায়িত হবে, বৈশ্বিক পরিস্থিতি ততটাই খারাপ হবে, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি ও দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান বিশ্লেকরা এমন আশঙ্কা করেছিলেন আরও আগেই। এখন সেটারই বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে বলে মনে করে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। স্বর্ণ ও জ্বালানি তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী দেশগুলোর মধ্যে মতভেদ এবং বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিশ্বের সর্বত্রই। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। এই ক্ষতি দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে নিয়ে যাচ্ছে নাজুক পরিস্থিতির দিকে। সময় যত গড়াচ্ছে, সংকট ততটাই বাড়ছে এবং বিশ্ব ধীরে ধীরে ভয়াবহ এক মন্দার দিকে এগোচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এর বড় প্রভাব পড়তে যাচ্ছে কৃষি উৎপাদনে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ রীতিমতো বৈশ্বিক সংকটের জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালছে, যার মাশুল দিচ্ছে পুরো বিশ্বাবাসী।
বিশ্বব্যাংক গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, অর্ধশতাব্দী পর সবচেয়ে পড়তি সময় পার করছে বিশ্ব অর্থনীতি। আগামী ২০২৩ সালটি বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকুচিত হবে অন্তত দশমিক ৪ শতাংশ। ১৯৭০ সালের পর বিশ্ব র্অনীতি এখন সবচেয়ে মন্থর অবস্থায় রয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। আগামী বছর এর মুখোমুখি হবে বিশ্ব¦। আসছে বছরের সম্ভাব্য ওই অর্থনৈতিক মন্দায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। সম্প্রতি ‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সে প্রতিবেদনে এসব আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সামনে যে পরিস্থিতি আসছে তা উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। এ জন্য টেকসই বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানমুখী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে বিশ্বব্যাংক। এতে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে।’
জাতিসংঘের শিল্প-বাণিজ্য সংস্থা আঙ্কটাডের সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাবিশ্বেই ব্যবসা ও বিনিয়োগের গতি মন্থর এবং এটা ক্রমান্বয়ের কমছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য। তখনও করোনা মহামারীর প্রভাব বিদ্যমান ছিল। সারাবিশ্বেই যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে। এর ফলে ক্রমবর্ধমান খাদ্য, জ্বালানি ও আর্থিক সংকট সৃষ্টি করে বিদ্যুৎ ও মৌলিক পণ্যের মূল্যস্ফীতি উসকে দিচ্ছে। এতে আসছে বছরগুলোতে ঝুঁকির প্রতিকূলতা ও বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নিম্নগামী চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
এরই মধ্যে জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দামও বাড়ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অন্য খাতগুলোর মতো কৃষি উৎপাদনেও কৃষকের খরচ এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এ পরিস্থিতি দেশে দেশে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে দেশের জনসংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সে হারে খাদ্যোৎপাদন বাড়েনি। বিবিএস ও ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে সোয়া ৫ শতাংশের বেশি। যদিও এ সময় খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশেরও কম। দেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রধান দুই খাদ্যশস্য চাল ও গম উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৭৩ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার টনে।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৬৭ লাখ ৩০ হাজার টন চাল ও গম আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের দাম বাড়তির দিকে থাকায় ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার টনে।
এদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, খাদ্যদ্রব্যের দাম কমবে না, বরং আরও বাড়বে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। তিনি বলেন, খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে না, আরও কমবে- এই চিন্তা যে করবে সে বোকার স্বর্গে বাস করে।