Home কলাম খণ্ডিত কানাডা’র ভাবনা আমাকে আতংকগ্রস্থ করে তুলেছিলো

খণ্ডিত কানাডা’র ভাবনা আমাকে আতংকগ্রস্থ করে তুলেছিলো

মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

একুশ.
আমি দুটি উদাহরণ দিতে পারি যেগুলো আমাকে খুবই ভাবিয়েছিল। অনুচ্ছেদ ৩৮ এ যে বিষয়টির উল্লেখ ছিল তা হচ্ছে, কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের সব বিষয়েই মত দিলেও কিছু ক্ষেত্রে তার অসম্মতির ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে, বিশেষ করে জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে কোনো দ্ব›দ্ব দেখা দিলে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারে কোনো আইনকে উপেক্ষা করে নতুন আইন জারী করতে পারবে। আর অনুচ্ছেদ ৩৯ এ যে বিষয়টির উল্লেখ ছিল তা হচ্ছে, অটোয়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন কোনো প্রদেশের নিজস্ব কোনো সম্পদের ওপর তার কর্তৃত্বের যে ‘ডিক্লেরেটিভ’ ক্ষমতা আছে, তা হারাবে।

এই প্রস্তাবের মধ্যে এমন কিছু হয়তো ভুল ছিল না এবং নিজেদের প্রাদেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে তারাতো নিজেদের সুবিধাটাই আগে দেখবে। কিন্তু আমি বিষয়টা বরাবরই একটু অপর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছিলাম। আমার বারবারই মনে হতো এরকম ক্ষেত্রে বা এমন বিষয়টা যদি ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে আসে তাহলে আমরা ব্যাপারটা কিভাবে নিবো। প্রদেশের এমন চাওয়ায় অটোয়া কি পাবে? আমার প্রায়ই মনে হতো, হয়তো অটোয়ার দিকে কিছুই থাকবে না।

এ বিষয়ে আমার হতাশা আরো বাড়ার কারণ ছিল, আমি বুঝতে পারছিলাম যারা এই চুক্তির ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন বা এর পক্ষে মাঠে নেমেছেন, তাদের বেশীর ভাগই এই প্রত্যাশিত চুক্তির ধারা উপধারা ভালোভাবে পড়েন নি এবং এর সম্পর্কে যথার্থ কোনো জ্ঞানও ধারণ করতেন না। আমি হলফ করে বলতে পারি, এ বিষয়ে আমার যে জ্ঞান ছিল তা তাদের বেশীর ভাগের মধ্যেই ছিল না, কিন্তু আমি মনে মনে সব সময়ই চাইতাম, তারা এ বিষয়টা সম্পর্কের অন্তত ভালোভাবে জানুক। আমি এখানে বিশেষভাবে বলতে পারি, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াং প্রগ্রেসিভ কনজাভেটিভ’দের কথা যারা এই চুক্তির পক্ষে ক্যাম্পাসে জনমত গড়ে তোলার জন্য কাগজপত্র বিলি করে বেড়াচ্ছিল। তাদের সেই কাগজপত্র পড়ার পর আমি সেই ইয়াং প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ এর এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা এই জনমত গড়ে তোলার পুস্তিকার সাথে সাথে কেনো মূল চুক্তির কপিটি দিচ্ছে না। সে তখন আমাকে এড়িয়ে যাবার ভংগিতে বলেছিল, এই প্রচার পত্রে বুলেট পয়েন্ট এ যা দেয়া আছে এগুলোই সবার জানা প্রয়োজন। সে আরো বলেছিল, ‘সবার সব কিছু পড়ার কি আছে যেখানে আমরা কষ্ট করে সবার কি পড়া উচিৎ তা বের করে এখানে ছাপিয় দিয়েছি।’ আমি তার কথায় এইভাবে জবাব দিয়েছিলাম, ‘কারণ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশের মানুষ যেই জায়গাই জোরালোভাবে দাঁড়াতে চাচ্ছে সেটা সম্পর্কে তাদের একেবারে স্বচ্ছ ধারণা থাকা উচিৎ, তাদের ভালোভাবেই জানতে হবে তাদের প্রত্যাশিত ভবিষ্যৎ দেশটি দেখতে আসলে কেমন হবে। আর সেই বিষয়টা বুঝানোর জন্য এই এক ডজন বুলেট পয়েন্ট এর দিক নির্দেশনা যথেষ্ট নয়।’

ঐ বছরে ম্যাকগিল এ আমি সত্যিকারভাবে সেই চুক্তির বিষয়টা সবাইকে জানানোর কাজে নেমে পড়েছিলাম। শার্লোটটাউন চুক্তির যে কপিটা আমি তন্ন তন্ন করে দাগিয়ে দাগিয়ে পড়েছিলাম সেটা নিয়েই ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে ঐ চুক্তির বিষয়টা বন্ধুদের নিজ থেকেই জানানোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। সেই সময় আমার খুব ইচ্ছে করছিল, আমি যদি চুক্তির আসল বিষয়টা সবাইকে জানাতে পারতাম! কিন্তু তখন যে বাস্তবতা আমি লক্ষ্য করেছিলাম তা হচ্ছে, অধিকাংশই যে রাজনৈতিক স্রোত বইছিল তার দিকেই অবস্থান নিয়েছিল। ব্রায়ান মুলরনী’র প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ এর সমর্থকরা বরাবরই এই চুক্তির পক্ষে কাজ করছিল যদিও তার সমালোচকরা এ ব্যাপার থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করেছিল। এই চুক্তির এপিঠ ওপিঠের ভাবনাগুলো বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল। পূর্ব দিকের ফেডারেলিস্টরা এই চুক্তির প্রতি নিজেদের সমর্থন জানিয়েছিল, কিন্তু কুইবেকের বিমাতাসূলভ আচরণের জন্য প্রেসটন ম্যানিং এবং তাঁর রিফোর্ম পার্টি এটাকে নাকচ করে দিয়েছিল। তারা এই চুক্তির সিনেট সংস্কারের ধারা নিয়ে সন্তষ্ট ছিল না, কারণ সেটা সেই সময়ের রাজনীতির বিচারে এমন নতুন কিছু ছিল না।

বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিজেরাই শার্লোটটাউন চুক্তির বিপক্ষে কিছু কারণ তুলে ধরলো যাতে এ ব্যাপারে আমার অবস্থান নিয়ে কিছু মানুষের সাথে আমার কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বিষয়টা এমন ছিল যে, তারা এমন একটা অবস্থার ক্ষেত্র তৈরী করলো যে, যদি পিক্যুইজিটরা (পার্টি ক্যুইবেক এর সমর্থক) এবং আমি এই ধারণার বিপক্ষে অবস্থান নিই, তাহলে কি দাঁড়াবে? আর আমার কি এমন কিছু আছে যাতে বিচ্ছিনতাবাদীদের চাওয়ার সাথে আমি এক হতে পারি? আমার মনে আছে, সেই সময় আমি রেডিও থেকে ডাক পেয়েছিলাম, কারণ প্রডিওসার এর মনে হয়েছিল, আমি যেহেতু নিজে থেকেই নিজেকে ফেডারেলিস্ট হিসেবে দাবী করে এই চুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি, অতএব আমার পক্ষে রেডিও বিতর্কে যুক্তি নিয়ে সরবভাবে অংশগ্রহণ করা সম্ভব। সেই সময় আমার এই পক্ষাবলম্বন এর জন্য আমি একটা টি শার্ট পড়ে থাকতাম যাতে লেখা থাকতো – ‘মাই নো ইজ এ ফেডারেলিস্ট নো’।

অবশেষে ১৯৯২ সালের অক্টোবরের গণভোটে শার্লোটটাউন চুক্তির পক্ষের দল হেরে গিয়েছিল। বিজয়ী দল পেয়েছিলো শতকরা ৫৪ ভাগ ভোট আর বিজিত দল পেয়েছিলো ৪৬। ক্যুইবেকেও ওরা হেরেছিলো শতকরা ৫৭ – ৪৩ ভোটে। পশ্চিম দিকের চারটি প্রদেশই এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। এই ফলাফলে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাপারে আমার যে অবস্থান এবং আমার যে কার্যক্রম তাতে আমি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল এর পক্ষে আমি অবস্থান নিয়ে আমি আমার মত করে যুক্তি তর্ক চালিয়ে গেছি এবং আমি যা বিশ্বাস করেছি সেটা খুবই সৎভাবেই আমি সবার সামনে তুলে ধরেছি। আমার জীবনের এই অধ্যায়টা কানাডা সম্পর্কে আমার অনুভূতিকে আরো প্রখর করে তুলেছিল। আমি উপলব্ধি করছিলাম, আমার এই দেশের যা কিছু সুন্দর, যা সত্যিই রক্ষা করা প্রয়োজন তা যেভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে। যে মাসগুলোতে আমি আমার দাগিয়ে দাগিয়ে পড়া শার্লোটটাউন চুক্তির প্রায় ছিড়ে যাওয়া কপিটি নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম আর সবাইকে এর আদ্যোপান্ত বুঝানোর চেষ্টা করতাম, সেই সময়টা আমার রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশের যে যাত্রা তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল।
তিন বছর পর অন্যান্যদের মত আমাকেও আরেকটি রাজনৈতিক প্রচারণা ভাবিয়ে তুলেছিল। এই সময়ে বিষয়টা শুধুমাত্র সংবিধানের সংশোধনীর চেয়ে অনেক কঠিন কিছু ছিল। এই সময়ে এই বিষয়টায় দেশ ভাঙনের একটা সরাসরি ধাক্কা ছিল।

১৯৯৫ সালের অক্টোবর গণভোটের ‘হ্যাঁ’ ভোটের বিপক্ষে মন্ট্রিয়লে অখণ্ড কানাডা’র পক্ষে ঐক্য ও সম্প্রীতির র‌্যালী।

সময়টা ছিলো ১৯৯৫ এর অক্টোবর মাস, তখন কুইবেকবাসী প্রদেশের দ্বিতীয় গণভোটের জন্য তৈরী হচ্ছিল। যদি ‘হ্যাঁ’ ভোট জিততো, তাহলে প্রমাণ হতো যে প্রদেশের অধিকাংশ জনগণ কুইবেক’কে কানাডা’র মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করার যাবতীয় আলোচনা শুরু করার ক্ষমতা দিচ্ছে। গণভোট শুরুর মাত্র এক সপ্তাহ পূর্বে এমন কথা বাতাসে ভাসছিল যে কুইবেক বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কানাডা থেকে কুইবেক’কে বিচ্ছিন্ন করার দিকে এগুচ্ছে। মন্ট্রিয়লের আমার অনেক বন্ধু এবং আমি তখন এক গভীর শংকায় সময় কাটাচ্ছিলাম আর আতংক নিয়ে ভাবছিলাম, আমরা বর্তমান অখণ্ড কানাডার শেষ দিনগুলো পার করছি। খণ্ডিত কানাডা’র ভাবনা আমাকে আতংকগ্রস্থ করে তুলেছিল।

আমি মনে করতে পারি ‘হ্যাঁ’ পক্ষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কি ধরনের প্রচার ও কুটচাল চালিয়ে জনগণের মাথা ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল আর এ ব্যাপারটা আমাকে কীভাবে ব্যাথিত করছিল। আমার বারবার মনে হচ্ছিল তারা যা কিছু প্রচার করছে, তার গুরুত্ব বা গভীরতার কোনো কিছুই তারা বুঝতে পারছে না। আমার এটাও মনে হচ্ছিল, তোমরা যদি সত্যিই একটি নতুন দেশ গড়তে চাও, তাহলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষের সত্যিকারের ইচ্ছা বা বাসনা সঠিকভাবে গ্রহণ করা উচিৎ। এ বিষয়ে কোনো ছল চাতুরীর আশ্রয় নেয়া বা কোনো রকম রাখ ঢাক করা উচিৎ নয়, একেবারে খোলাখুলিভাবে ব্যাপারটা জনগণের সামনে তুলে ধরা উচিৎ। কারণ এই পরিবর্তনের সময় জনগণের সঠিক সমর্থন নেয়াটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন একটা দেশ গড়ে তোলার যে ব্যাথা তা যদি সইতেই হয়, তবে সবার জানা প্রয়োজন তারা যে নতুন জিনিসটা পাচ্ছে, তা এই কষ্ট বেদনার মূল্যে যথার্থ কিনা। আর এই ‘হ্যাঁ’ ভোট যদি জয়ী হয় তাহলে এর মানে কি দাঁড়াবে? নিশ্চয় এর মানে দাঁড়াবে, একটা ভুল তথ্য আর প্রত্যাশার মরিচিকায় অধিকাংশ মানুষের মত গ্রহণ করা। এই বিষয়টা ভাবলেই আমি মনে মনে মুষড়িয়ে যাচ্ছিলাম।

ভোটের তিন দিন বাকী থাকতেই আমার বন্ধু ইয়ান রে এবং আমি মন্ট্রিয়লের ডাউন টাউনে লাখ লাখ মানুষের ঐক্য ও স¤প্রীতি’র পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলাম। ওটা ছিল কানাডা’র ইতিহাসের সবচেয়ে একক বড় রাজনৈতিক সমাবেশ। বিশাল আকৃতির ম্যাপল লীফ পাতাকা চারিদিকে পতপত করে উড়ছিল এবং প্লেস দ্যু কানাডা’র চারিদিকে লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল। এই জমায়েতটা খুব ভালোভাবে দেখার জন্য ইয়ান আর আমি সিআইবিসি’র উঁচু ভবনের দিকে এগিয়ে গিয়ে কোনভাবে ভবনটির দোতলার খোলা জায়গাটায় একটু স্থান করে নিয়েছিলাম। তোমরা যদি সেই পদযাত্রার বিখ্যাত বড় সেই পোস্টারটা কেউ কখনো দেখে থাকো, তবে তোমরা আমাদের দু’জনকে সিআইবিসি’র সেই খোলা জায়গায় প্রচার মাধ্যমের যে দুটো সাদা তাঁবু ছিল তার একেবারে পাশেই দেখতে পাবে। আমার চারপাশে এত বেশি অসংখ্য কানাডিয়ান’কে দেখে আমার খুব ভালো লাগছিল। বলা যেতে পারে, আমি খুব বেশী রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম এবং দীর্ঘদিন ধরে আমার ভিতর প্রাদেশিক আন্দোলনে কানাডা বিভাজনের যে আবোল তাবোল চিন্তা মস্তিষ্কে জেঁকে বসেছিল সেটা প্রশমিত করতে এই সমাবেশ আমাকে খুব বেশী সহায়তা করেছিল।

গণভোটের সেই রাতে শাসা, মিশেল আর আমি বাবার সাথে বাড়ীতে বসেই টেলিভিশনে সবকিছু দেখছিলাম। ‘না’ ভোট খুব অল্পের জন্য জিতে গিয়েছিল। ‘না’ ভোট পেয়েছিলো শতকরা ৫০.৫৮ ভোট আর ‘হ্যাঁ’ ভোট পেয়েছিল শতকরা ৪৯.৪২। মাত্র ৫৪,২৮৮ ভোটের পার্থক্য ছিল। যদিও আমরা দেখছিলাম কানাডার বিভাজনটা আর হচ্ছে না, তারপরও আমার বাবা খুব অস্থিরভাবে ছটফট করছিলেন, কিন্তু যখন সরকারীভাবে ভোটের ফলাফল জানানো হলো, তখন তিনি শান্তভাবে তাঁর মাথাটা ঝুঁকিয়ে শুধু উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ভালো’ আর তারপর আরো শান্তভংগিতে তিনি তাঁর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

শিল্পীর তুলিতে ১৯৯৫ সালে স্বাধীনতার জন্য গণভোটের সময় কুইবেক

যা ঘটে গেলো তার জন্য আমরা বন্ধুরা একটু হৈ চৈ করার কথা ভাবছিলাম। সেজন্য আমরা বন্ধুরা রু ম্যাতক্যাফ বার এ জড় হলাম। সেখানে আমরা একটা গুজব শুনছিলাম, বিচ্ছিন্নবাদীরা পার্ক ম্যাইসোনেভূ’র পূর্ব দিক থেকে এসে ডাউন টাউন দখলের পাঁয়তারা করছে। তবে ঐ গুজবটার কোনো ভিত্তি ছিল না। কারণ পার্টি কুইবেক এর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যদি এমন কর্মকাণ্ডের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতো এবং সেই অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইতো, তাহলে তা সহজেই দাঙ্গা পুলিশের নজরে আসতো আর যেভাবেই হোক দাঙ্গা পুলিশ সে ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে তাদের নিবৃত্ত করতো। এ ছাড়া সেই রাতে ডাউন টাউনে যে পরিমাণ দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল, তাতে তাদের উপস্থিতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড করতে সাহস পায়নি। সেই রাতে আমারও মনে হয়েছিল, আইন শৃংখলা বাহিনী খুব বেশী সতর্ক না হলে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারতো।

এত বছর পরও মাঝে মধ্যেই আমি সেই দিনগুলিতে ফিরে যাই। আমার মাথায় বার বার একটা চিন্তা ঘুরপাক খায়, সেই সময় ২৭,১৪৫ ‘না’ ভোটার যদি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষে ভোট দিতেন তাহলে বর্তমান কানাডা’র রূপ কেমন হতো। নিশ্চয়, আজকের এই কানাডা তখন আর থাকতো না। যদি নাই থাকতো তাহলে পৃথিবীর কাছে আমাদের কী বলার থাকতো ? নিশ্চয় সবাই বলাবলি করতো, কানাডা’র মত বহুজাতির যে দেশটা সব জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে এক পারস্পরিক সৌহার্দের প্রতীক হিসেবে সামনে এগিয়ে চলেছে, সেই দেশও নিজেদের মধ্যে স¤প্রীতির বন্ধন অটুট রাখতে ব্যর্থ হলো, আর এমনটা হলে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সহ ও সুন্দর অবস্থানের যে স্বপ্ন তা প্রচণ্ডভাবে হোঁচট খেতো।

বর্তমান সময়ে, এটা একটা অন্যতম প্রধান প্রশ্ন যা আমাকে প্রায় ভাবিয়ে তোলে। (চলবে)
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা

Exit mobile version