Home কলাম ক্যানাডিয়ান সামাজিক সমস্যা ও তার মোকাবেলা

ক্যানাডিয়ান সামাজিক সমস্যা ও তার মোকাবেলা

শারমীন শরীফ : আধুনিক সমাজে মানুষ শান্তুপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার জন্য সব কিছু করে। সুরক্ষিত সমাজ ব্যবস্থার জন্য সরকার ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা বোধ করে না কিন্তু তবুও অশান্তি হানা দেয়, উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা ঘটে থাকে। আমরা তখন এগুলোকে সামাজিক সমস্যা বলি যখন এই সব ঘটনাগুলো নেতিবাচকভাবে আমাদের বা কোন একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী কে প্রভাবিত করে। দ্রারিদ্য, বৈষম্য, পারিবারিক বা সামাজিক সহিংসতা বা মাদকাশক্তি এই ধরণের সমস্যার প্রকৃত উদাহরণ। এবং বর্তমান সমাজে এগুলো আমাদের অহরহই মোকাবেলা করতে হচ্ছে। যুগে যুগে এই সব সমস্যা আমাদের সমাজে কম বেশি সব সময়ই ছিল তবে তখন প্রচারণার মাধ্যম সীমিত ছিল বলে আমাদের জানবার সুযোগ কম ছিল।
আমি আজ আমাদের ক্যানাডিয়ান সমাজব্যবস্থার কিছু জটিল সামাজিক সমস্যা এবং অসঙ্গতি নিয়ে লিখব।

কোন সমস্যার প্রভাবই ছোট নয় এবং যে সমস্যাগুলো নিয়ে আমি লিখব সেই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি যারা হন তারা তাত্ক্ষণিক ভাবে শারীরিক-মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন এবং আমারা যা জনাই তার চেয়েও প্রায় অনেক বেশি ক্যানাডিয়ান সরাসরিভাবে এই সমস্যাগুলো তে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এবং এই সমস্যাগুলোর সমাধানও অনেক ব্যয়বহুল।

ক্যানাডিয়ান সরকারের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে এবং ফান্ড রয়েছে যার মাধ্যমে এরা এই সমস্যাগুলোর সমাধানে সাধারণ নাগরিকদের সাহায্য করে থাকেন। সমস্যা সমাধানের আগে দুটো নিয়ে চিন্তা অপরিহার্য্য;
১. সেইসব পরিবারকে সাহায্য করা যারা এই সমস্যাগুলো তারা সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছে।
২. ক্যানাডিয়ানদেরকে বুঝতে সাহায্য করা যে এইসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো যদি সমাধান না করে এমনি রেখে দেয়া হয় তাহলে তার সামাজিক প্রভাব কতটা হতে পারে।
ক্যানাডিয়ান সরকার মনে করেন “একজন ব্যক্তি যিনি কিনা সম্পদ, উপায়, নিজস্ব পছন্দ এবং ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবনযাত্রার একটি মৌলিক স্তর অর্জনে ব্যর্থ হন তারা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে ব্যর্থ হন”। প্রধান কয়েকটা সমস্যা নিয়ে একটু বিস্তারিত আলাপে যাওয়া যাক।

দারিদ্রতা : ২০১৮ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৩.২ মিলিয়ন ক্যানাডিয়ান অথবা ৮.৭ শতাংশ ক্যানাডিয়ান দারিদ্রতার মধ্যে বসবাস করেছে এবং মোট জনসংখ্যার ১.৭ মিলিয়ন ক্যানাডিয়ান অথবা ৪.৬ শতাংশ জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেছে। দারিদ্রতা মানুষের শক্তি এবং স্থিতি কে প্রভাবিত করে। দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী মানুষেরা বেশি স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগে থাকে। চাকরি গত সমস্যার পুনর্বাসন আবার তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারকে একটি বিশাল খাতে খরচ করতে হয়। এ সমস্যাগুলো যেন চক্রাকারে ঘুরতে থাকে মনে হয় এর থেকে যেন মুক্তি নেই।
২০০৮ সালে ফিড অন্টারিও (অন্টারিও অ্যাসোসিয়েশন অফ ফুড ব্যাংক) অন্টারিওতে দারিদ্র্যেতা মুক্তির পেছনে যে খরচ রয়েছে তা অনুমান করার চেষ্টা করেছিল, প্রতিবছর প্রদেশের দারিদ্রতা মুক্তির জন্য ১০.৪ থেকে ১৩.১ বিলিয়ন সামাজিক খরচ অনুমান করেছে। অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করতে অক্ষম পরিবারগুলির আনুমানিক খরচ অতিরিক্ত ৩২ থেকে ৩৮ বিলিয়ন শুধুমাত্র অন্টারিওর জন্য।

পারিবারিক সহিংসতা: যেকোনো ধরনের শারীরিক অত্যাচার, দুর্ব্যবহার, অবহেলা বা আর্থিক অপব্যবহার যাতে কিনা শিশু বা পরিবারের যে কোনো মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং সেটার কারণ যদি হয় পরিবারের অন্য যেকোন সদস্য তাহলে সেটাই পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে পড়ে। সোজা ভাষায় বলতে গেলে, পরিবারের সদস্য দ্বারা পরিবারের অন্য যে কোন সদস্য সহিংসতার শিকার হলেই সেটাই ফ্যামিলি ভায়োলেন্স। ২০১৬ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ মানুষ পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। শিশু এবং নারী সামগ্রিকভাবে ৫২% সহিংস অপরাধের শিকার তার ৬৭% শতাংশই মহিলা।
২০১৪ সালের আরেকটি সামাজিক সমীক্ষায় দেখা গেছে পারিবারিক সহিংসতা ৭০ ভাগ সহিংসতা হয়ে থাকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন তবে উল্টোটাও হয়ে থাকে। আরও দেখা যায় ৯৩ শতাংশ শিশু শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে এবং যে কথা তারা কখোনো প্রকাশ করেননি শিশু অবস্থায় অথবা বড় হয়েও তারা সেটা প্রকাশ করতে সংকোচ বোধ করেছেন। এইসব সহিংসতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লুকিয়ে যাওয়া হয় এবং সেটা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় না। আমি আগেই বলেছি এগুলো চক্রাকারে ঘুরতে থাকে যেমন শারীরিক এবং মানসিকভাবে যারা বিধ্বস্ত থাকেন, যারা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন না এবং পারিবারিক সমস্যার সাথে তাদের জীবনে আরেকটি সমস্যার যোগ হয় সেটা হল দারিদ্রতা এবং পড়ে সেটা মানিসিক স্বাস্থ্য কে আক্রান্ত করে।

মানসিক স্বাস্থ্য এবং আসক্তি : উপরে বর্ণিত দু’টি সমস্যা থেকে যে আরেকটি সমস্যা তৈরি হতে পারে সেটা হলে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং এর থেকে আসতে পারে আসক্তি। হতাশা, জুয়ায় আসক্তি, স্ত্রী বা স্বামী নির্যাতন, শিশুর উপরে নির্যাতন, আআত্মহত্যা প্রবণতা, মাদক আসক্তি এগুলো সব মানসিক সমস্যার মধ্যে পড়ে। যেগুলোর প্রধান কারণ হতে পারে দারিদ্রতা অথবা নির্যাতন। প্রতিটি বিচ্ছিন্ন সমস্যা একটি আরেকটির সাথে সম্পৃক্ত। মানসিক অসুস্থতা একজন মানুষের আয়ু ১০ থেকে ২০ বছর কমিয়ে দিতে পারে বলে চিকিত্সকরা অনুমান করেন। বলা হয়ে থাকে ১০ থেকে ২৯ বছর বয়সী কেনেডিয়ানদের জন্য এটা দ্বিতীয় প্রধান মৃত্যুর কারণ। একটা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য, শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রধান অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়।

বর্ণবাদ : কি সেটা আমরা কমবেশি সবাই জানি। যখন একটি জনগোষ্ঠী মনে করে তারা অন্য জনগোষ্ঠীর থেকে উত্কৃষ্ট তখনই সৃষ্টি হয় বর্ণবাদের, বৈষম্যের কুসংস্কারের এবং সহিংসতার আর জাতিগত পার্থক্যই হল এর প্রধান কারণ। ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে দেখা গিয়েছে যে ক্যানাডায় ২৫০টিও বেশী দেশ ও জাতির বসবাস। তাই কানাডাকে বলা হয়ে থাকে বহু সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে সমন্বিত দেশ বা মাল্টিকালচারাল কান্ট্রি। ২০১৮ সালে পুলিশ ক্যানাডায় ঘৃণার দ্বারা অনুপ্রাণিত ১৭৮৯টি অপরাধমূলক ঘটনা রিপোর্ট করেছে যা এমন কোন একচেটিয়া ঘটনা নয়। ২০১৪ সালে ক্যানাডায় নিরাপত্তা উপরে একটি সাধারণ সামাজিক সমীক্ষণ করা হয় এবং যাতে দেখা গিয়েছে যে ৩৩০,০০০টি ঘৃণা প্রণোদিত অপরাধমূলক ঘটনার স্ব-প্রতিবেদন হয়েছে যার দুই-তৃতীয়াংশ কিনা কখনোই পুলিশকে জানানো হয়নি। যদিও ক্যানাডায় বর্ণবাদের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে এবং বর্ণবৈষম্য মূলক আচরণ কোন ভাবেই গ্রহনযোগ্য নয় তবুও এই ঘটনাগুলো ঘটছে। বর্ণবৈষম্যের কারণে কেনেডিয়ান জাস্টিস সিস্টেমের পেছনে সরকারকে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয় যেটা কিনা আমাদের অর্থনীতির উপর একটি বিশাল প্রভাব ফেলছে।

ধর্ম বৈষম্য এবং সামাজিক বর্জন : সামাজিক বর্জন সাধারণত লোভ এবং কুসংস্কার দ্বারা পরিচালিত হয় আর এর সাথে যোগ হয়েছে ধর্ম। ভিন্ন ধর্মের মানুষকে ভিন্ন চোখে দেখা,তাদের বিশ্বাস কে ছোট করে দেখা এবং স্বীকৃতি না দেয়ার প্রধান অন্তরায় হলো স্বল্প শিক্ষা, ভুল শিক্ষা বা গোঁড়ামি। ২০২০ সালে বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ হয়েছিল এই প্রতিবাদ ছিল বিশেষত আমাদের জাস্টিস সিস্টেমের বিরুদ্ধে। বলা হয়েছিল আমাদের জাস্টিস সিস্টেম বর্ণবৈষম্যের সহায়ক নয় এবং দাবী করা হয়েছিল যে পলিসিতে অনেক পরিবর্তন আনতে হবে যাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সুষ্ঠ বিচার পায়। এখানে আমরা যারা ভিন্ন দেশের ভিন্ন রংয়ের বা ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের, ধর্মের বা গোত্র থেকে এসেছি আমাদের এখানে আরো একটি বৈষম্যের শিকার হতে হয় সেটা হল চাকরিগত ক্ষেত্রে বৈষম্য। “কেনেডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স” বলে একটি মজার শব্দ চালু আছে এখানে যেটা অহরহ আমাদের শুনতে হয় এবং বিশেষ করে যারা নতুন ইমিগ্র্যান্ট, চাকরি খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন তাদের এটার মুখোমুখি হতে হয়। আমি এটাকে বিশেষভাবে বৈষম্যমূলক বলে মনে করি। ক্যানাডায় আসতে হলে প্রথমেই আমাদের শিক্ষাগত এবং পেশাদারি যোগ্যতার প্রমান দিতে হয়। ক্যানাডায় যারা নতুন তাদের কেনেডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স থাকবে না এটাই স্বাভাবিক তবে এটা চাওয়ার কারণ কি? নিজের দেশে স্ব-পেশায় সুদক্ষতা থাকলেও এই কেনেডিয়ান এক্সপেরিয়েন্সের পাল্লায় পড়ে নতুন অভিবাসীদের অনেকেই নিজের পেশায় কাজ খুঁজে পাননা এবং বেঁচে থাকার তাগিদে তখন তারা যেকোন ধরনের কাজ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে এরা হীনমন্যতায়, হতাশায় ভুগতে থাকেন এবং যেটা পড়ে মানসিক এবং স্বাস্থগত সমস্যায় রূপ ধারণ করে। প্রতিটি সমাজের কিছু সামাজিক সমস্যা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক তবে একে সথার্থ ভাবে মোকাবেল করে জীবনের মানকে উন্নত করে বেঁচে থাকাই সার্থকতা।

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে ক্যানাডা পৃথিবীর মধ্যে একটি অন্যতম বন্ধু বত্সল এবং নিরাপদ দেশ। নারীদের জন্য অভয়ারণ্য এবং সকল ধির্মের, বর্ণের এবং লিঙ্গের মানুষের জন্য এটি স্বর্গরাজ্য।

কখনো কখনো মনে হয় এই স্বর্গেও বুঝি কীট ঢুকে পড়েছে। পরিবর্তনটাই স্বাভাবিক তবে সেটা যত ইতিবাচক হবে ততই আমাদের জন্যই মঙ্গল। হোকনা দেশটা ঠান্ডা কিন্তু আমাদের হৃদয় তো উষ্ণ। এটা এমন একটি দেশ যেখানের একই রাস্তায় পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে গির্জা, মন্দির, মসজিদ এনং সিনেগগ, নির্দিধায় যে যার ধর্ম পালন করছে কোন ঝামেলা ছাড়া। ভাল থাকুক ক্যানাডা এবং সেই সাথে ভাল থাকুক বিশ্বের সকল মানুষ। (তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা

Exit mobile version