অনলাইন ডেস্ক : বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিমান, নৌ ও স্থলপথ দিয়ে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার যাত্রী দেশে প্রবেশ করছেন। তাদের ভালোভাবে স্ক্রিনিং করা হচ্ছে না। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনও করা হচ্ছে না। এতে আবারও বিদেশ থেকে আসা করোনায় দেশে নতুন সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বিমানবন্দরগুলোয় যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তা জনস্বাস্থ্যের ভিত্তিতে নয়, কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। অথচ দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এখন যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় সেটি হল করোনাভাইরাস আক্রান্ত নয় এমন সনদ যাত্রীদের কাছে থাকতে হবে। কিন্তু এই পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার জন্য দিন-তারিখের দরকার হয় না। যে কেউ যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে। কেউ নমুনা দেয়ার পরমুহূর্তেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু তার পরীক্ষার ফল আসবে নেগেটিভ। অর্থাৎ লক্ষণ প্রকাশ না পেলে এই যাত্রীর মাধ্যমে পুরো উড়োজাহাজে ভাইরাস ছিড়িয়ে পড়তে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২১ জানুয়ারি থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিমান, নৌ ও স্থলবন্দর দিয়ে ৮ লাখ ২৬ হাজার ১৪৮ জন যাত্রী প্রবেশ করেছে। ২৪ ঘণ্টায় (১৫ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে ১৬ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত) যাত্রী এসেছেন ২ হাজার ৪২৮ জন। এর মধ্যে ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই (হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) দেশে প্রবেশ করেছে ২ হাজার ২৭৫ জন। এছাড়া চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৪ ঘণ্টায় প্রবেশ করেছে ১৩৯ জন এবং অন্যান্য স্থলবন্দর থেকে দেশে প্রবেশ করেছে মাত্র ১৪ জন। এদের মধ্যে ৯ জনের মধ্যে করোনার উপসর্গ আছে। সেখান থেকে মাত্র একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, যারা সার্টিফিকেট নিয়ে আসেন, সেটা মোবাইলে হলেও তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। সেটি কোনো গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠানের নাকি নামমাত্র, সেগুলো যাচাই করা হয় না। কেউ যদি দেখাতে না পারে তবে তাদের ইন্সটিটিউশনাল কোয়ারেন্টিনে পাঠানোর নির্দেশ রয়েছে। তবে শুধু প্রবাস ফেরত শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়। সম্প্রতি বেশকিছু দেশ থেকে যাত্রী আসছেন, যাদের পাসপোর্টের পেছনের মলাটে ‘ফিট টু ফ্লাই’ স্টিকার লাগানো থাকে। এই স্টিকারযুক্তদেরও ছেড়ে দেয়া হয়। এই কর্মকর্তা বলেন, বিদেশ ফেরতদের দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের দেশে বিমানবন্দরগুলোয় যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সেটা জনস্বাস্থ্যের ভিত্তিতে নয়, কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্ত জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় গ্রহণ করা উচিত। তিনি বলেন, অনেক দেশেই ট্রান্সমিশন বন্ধ করার জন্য বিমানবন্দর একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান। যেখানে পুরো বিশ্বেই রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে সবার জন্য একটা নির্ধারিত নীতিমালা থাকা উচিত। তবে যখন কোনো দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়, তখন বিমানবন্দরে কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক নয়। এখন কোনো দেশে কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আবার কোনো দেশে পরীক্ষার সনদ গুরুত্ব পাচ্ছে। এটা একটা কূটনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে পরীক্ষার সনদ কোনো বিজ্ঞানসম্মত বিষয় নয়। কারণ পরীক্ষার নমুনা দেয়ার পরমুহূর্তেও ওই মানুষ করোনাভাইরাস আক্রান্ত হতেই পারেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে বিমানবন্দরগুলোয় স্ক্রিনিং করেই উড়োজাহাজে যাত্রী ওঠানো হয়। তাই এসব যাত্রী ঢাকায় অবতরণ করার পর তাদের আইসোলেন করার দরকার পড়ে না। আমাদের দেশ থেকে যারা বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা। তাদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সেজন্য ভ্রমণের ৭২ ঘণ্টা আগেই কোভিড-১৯ পরীক্ষা করে সনদ দেয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা) ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, কোন দেশের যাত্রীদের ক্ষেত্রে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে, এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। তবে সাধারণ ক্ষেত্রে বিমানবন্দরে বা অন্যান্য বন্দরে যে বিষয়টির গুরুত্ব দেয়া হয়, সেটি হল যে দেশ থেকে এসেছে যাত্রীর কাছে, সেই দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের করোনা নেগেটিভ সনদ আছে কি না- সেটি থাকলে ওইসব যাত্রীকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। অন্যদিকে যাদের কাছে এই সনদ থাকে না, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে রাজধানীর আশকোনা ও দিয়াবাড়ীতে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে। অনেকে আবার ডাক্তারি সনদ নিয়ে আসে যে তার করোনা হয়নি। তবে এ ধরনের ডাক্তারি সনদ গ্রহণযোগ্য নয়।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌস বলেন, যাদের কোভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ রয়েছে, তাদের হোম কোয়ারেন্টিনের জন্য ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। কাল থেকে দেশের সব সিভিল সার্জনদের এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়া হবে যে, কোন কোন পাসপোর্টধারী কোন জেলায় যাচ্ছে, তাদের যেন হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়। আর যাদের কোভিড নেগেটিভ সনদ নেই, তাদের সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হচ্ছে। শিগগিরই তিনি স্থলবন্দর কার্যক্রম পরিদর্শনে যাবেন বলেও জানান।