Home কলাম কে এই নূপুর শর্মা? কেন এই নূপুর শর্মা?

কে এই নূপুর শর্মা? কেন এই নূপুর শর্মা?

ভজন সরকার : বলুন তো, এই সময়ে সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ কে? সবাই বলবো, নূপুর শর্মা। অথচ আমিসহ কেউ দুইদিন আগেও জানতাম না কে এই নূপুর শর্মা? বিশ্বাস করুণ আমি এখনো জানি না, কে এই নুপূর শর্মা এবং কী-ই বা নুপূর শর্মা বলেছে? যখন ভারত বাংলাদেশ-পাকিস্তান-মধ্যপ্রাচ্য সবখানে প্রতিবাদ হচ্ছে, তখন ভাবলাম ব্যাপারটা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। গুগল সার্চে “নূপু” লিখতেই আমার কাছে সাজেশন আসলো “নূপুর শর্মা কি বলেছে”। অর্থাৎ আমার মতো লাখ-কোটি সার্চ হয়েছে “নূপুর শর্মা কি বলেছে”।
কোথাকার কোন নূপুর শর্মা কোন অখ্যাত টিভি শো তে একটা কথা বলে দিলো। গোটা দুনিয়া তোলপাড় হয়ে গেল। মিছিল-মিটিং হলো। মানুষ মরলো। ঘর-বাড়ি-দোকানপাট-গাড়ি পুড়লো। মানুষ আহত-নিহত হলো। রাতারাতি নূপুর শর্মা বিখ্যাত হয়ে গেল।

অথচ এখনো শত শত কোটি মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস করে। দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে বসে কোন এক নূপুর শর্মা কিংবা মুহম্মদ জোবায়ের কী বললো, তা’তেই সব কিছু শেষ হয়ে গেল? খুব অবাক লাগে, প্রচলিত ধর্মগুলো কি এতোই ঠুনকো ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে?

আসলে, এ সবের পেছনে আছে রাজনীতি, স্বার্থ এবং একের প্রতি অন্যের ঘৃণা। রাজনীতিসহ এই উপাদানগুলো এভাবেই ধর্মীয় ভাবাবেগ নিয়ে খেলা করে; অতীতে করেছে, বর্তমানে করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। কে যেন বলেছিলেন, প্রচলিত সব ধর্মের প্রায় সবই ভাবাবেগ। আবেগ তাড়িত মানুষ বাস্তবতাহীন হয়ে কান্ডজ্ঞানহীন কাজ করে ফেলে।
আর কেউ না জানুক, ধর্মের এই কান্ডজ্ঞানহীন বাস্তবতাটুকু রাজনীতিবিদরা খুব ভালো বোঝেন। তাই তো বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের মানুষ একই সময়ে ধর্মের আবেগে উত্তাল হয়। বলতে বাধা নেই এই উত্তাল সময়গুলো আসে রাজনীতিবিদদের সুবিধে মতোই। এই সুবিধে মতো সময়ে নূপুর শর্মা কিংবা তাদের প্রতিপক্ষরা সক্রিয় হয়।

দেশেদেশে যুগেযুগে এভাবেই ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসার হয়েছে, ধর্মীয় মৌলবাদীরা ক্ষমতাসীন হয়েছে। স্বার্থান্বেষীরা বুঝলেও ধার্মিকরা এই “খেলা” বোঝেন না। তাই তো এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি মারমুখী হয়ে উঠেন; কেউ একটু বেশী, কেউ একটু কম।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “গোরা” উপন্যাসটি যতবার পড়ি নতুন করে চিন্তার খোরাক পাই।
গোরা যখন বলেন,”আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খৃস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন”।
কিংবা উপন্যাসের পরিশিষ্টে গোরা যখন আনন্দময়ীকে বলেন,“মা, তুমিই আমার মা। যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসে ছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই- শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ”।
তখন মনে হয় গোরার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ নিজেও এ রকম একটি ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র ছ’বছর পরে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমানের মিলিত যে ভারতবর্ষ দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁর স্বপ্ন-ভংগের চিতাভস্ম তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু অনাহার-দারিদ্র্য ও হিন্দু-মুসলমানের বিভেদের পদধ্বনি তিনি জীবিত থাকতেই দেখে গেছেন। তাঁর শেষ প্রবন্ধ “সভ্যতার সঙ্কট”-এ সে হতাশার কথা বলেও গেছেন।

পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁর “জেলখানার ডায়েরি”-তে সে কথাই লিখেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে,” এ বোধহয় ভালই হ’ল যে রবীন্দ্রনাথ মারা গেলেন; ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্ব জুড়ে যে ভয়াবহ ঘটনাগুলি নেমে আসার অপেক্ষায়,তাঁকে তা আর দেখে যেতে হল না। তিনি যা দেখে গেলেন তা-ই যথেষ্ঠ। অপরিমেয় বিষাদ ও মনোবেদনা তিনি ভোগ করে গেলেন”।

১৯৪৭ দেখতে হয়নি রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথকে দেখে যেতে হয়নি ১৯৭১-এর মৃত্যু-উপত্যকা এ বাংলাদেশকেও। দেখতে হয়নি তাঁরই বর্ণিত”মানুষ না হওয়া বাঙালি”-দের মধ্যে কিছু সংখ্যক পিশাচের বর্বরোচিত মানবতাবিরোধী অপরাধের নৃশংসতা।
রবীন্দ্রনাথকে দেখে যেতে হয়নি ধর্মীয় সংখ্যালঘুর নামে বাংলাদেশ-ভারতসহ নানাপ্রান্তের ঘটে যাওয়া নির্মমতাও!

অথচ এই ২০২২ সালেও ভারত উপমহাদেশের মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে আছে। মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সব কিছু ছাপিয়ে মানুষ একটু মানবিক হয়ে উঠুক। ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে মানুষ একে অপরের পাশে থাকুক।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)

Exit mobile version