নাদিরা তাবাস্সুম : রূপা পার্কের বড় বড় ঘন সবুজ পাতাভরা গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বিমোহিত সুরে বলে – আহা এই অপরূপ সুন্দর গাছগুলো কিছুদিন আগেও যখন পাতাহীন শুষ্ক মরার মতো দাঁড়িয়ে থাকতো কী মায়া যে লাগতো – অথচ এখন যেন ভরা যৌবন এসেছে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।
রিতা জবাবে বলে – যৌবনকাল সবার কাছেই কত সুখ আর আনন্দের সময়। যৌবনের জয়গান তাই সবার প্রাণে। কিন্তু এই সময়টা এত স্বল্পকালীন হয় যে এর মর্মার্থ বুঝে ওঠার আগেই শেষ হয়ে যায়। আর সুখের স্থায়িত্ব কম বলেই তো এর এতো চাহিদা। ‘সুখ’ ‘সুখ’ বলে কেন করো হাহুতাশ,সুখ তো পাবে না কোথা বৃথা সে সুখের আশ – কবির ভাষায় বলা যায় সুখের সন্ধান কিংবা সুখের আশা করা বৃথা। কিন্তু আমরা সকলেই সুখ চাই। এটা যদিও নির্ভর করে ব্যক্তিগত পছন্দের উপর – যে যা চায় তার প্রাপ্তিতে। আজ এই সুন্দর বিকেলে খোলা আকাশের নীচে পাতাভরা সবুজ গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা যে সুখ ও আনন্দ অনুভব করছি সেটাও একটা প্রাপ্তি, সেটাও একটা সুখ।
রূপাÑ এজন্যেই আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন, “মানুষ ততটুকুই সুখী ঠিক যতটুকু নিজেকে সুখী বলে মনে করে। সুখ একটা মানসিক অবস্থা, একটা অনুভূতি যা ধন সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তির উপর নির্ভরশীল নয়”। লোইস লেভি –এর মতে “সুখের আবাস আমাদের অন্তরে। বাইরের জগতে সুখের সন্ধান করাটা মস্ত এক বোকামী।” যেহেতু সুখের সৃষ্টি করি আমরা আমাদের মনের মাঝে, তাই অন্যত্র অনুসন্ধান করে কখনো সুখের মুখ দেখা যায় না ‘like swimming, riding, writing or golf playing, happiness can be learned!
রিতা- এটা সত্য যে, সুখ একটা মানসিক আবেগময় অবস্থা যা অবশ্যই পছন্দের, আনন্দের এবং সন্তুষ্টির আর এটা যেহেতু মানসিক একটা অবস্থা, সেহেতু ভালো মন্দ যে কোন পরিস্থিতিতে অল্প কিছু পেয়েও আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি এবং আমরা সুখ পেতে পারি। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় সীমাহীন চাহিদা, প্রতিযোগিতামূলক জীবনযাত্রা, বিলাসবহুল জীবনযাপনের প্রতি আকর্ষণের মাঝে আমরা সুখ খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। বাস্তবিক ক্ষেত্রে এগুলো সুখ তো আনেই না বরং এগুলো আমাদের জীবনে দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
রূপা- আমার মনে হয়, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো যেমন –খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা যদি পূরণ হয়ে যায় তাতেই একজন মানুষ সন্তুষ্ট ও সুখ অনুভব করতে পারে।
রিতা- এজন্য আমি মনে করি, এর সাথে সুখী জীবনের জন্য যে ৩টি জিনিষ থাকা আবশ্যক তা হলো-পরিবার পরিজন এবং বন্ধু বান্ধবের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, সুষম খাদ্য গ্রহণ করা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা।
রূপা- ঠিকই বলেছো। কিন্তু আমি চিন্তা করছি আর একটা বিষয়। আর সেটা হলো – প্রকৃতি ও বাইরের জগত থেকে যে অবারিত সুখ ও আনন্দ আমরা পাই তার সবই তো চোখ দিয়ে দেখি, কান দিয়ে শুনি আর অন্তর দিয়ে অনুভব করি। কিন্তু কেউ যদি বলে যে, পৃথিবীতে আমরা যা কিছু দেখি, শুনি আর অনুভব করি তার কোন কিছুই সত্য নয়। আমাদের মাঝে যে সচেতনতা আছে তা তারই সৃষ্টি তাহলে কেমন শোনাবে বলো? বস্তুবাদী বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবীতে বিদ্যমান যা আমরা দেখি সব কিছুই সত্য কিন্তু ভাববাদী বিজ্ঞানীরা আবার মনে করেন যাকিছু আমরা দেখি সব সত্য নয় আমাদের সচেতনতা কর্তৃক সৃষ্ট। আর সচেতনতা মনে বা ব্রেইনে থাকে যা দেখা যায় না। যে কোন বস্তু তার সর্ব ক্ষুদ্র পর্যায়ে যখন থাকে তখন আমরা তা খালিচোখে দেখতে পাইনা। এমন অনেক বস্তু আছে যা আমরা দেখি না। আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড হফম্যান -এর মতে “Reality does not exist।” এ সম্পর্কে তিনি বিখ্যাত বই “The case against reality” লিখেছন।
রিতা- বাস্তবে আমরা যা দেখি শুনি সব সত্য নয়, আমরা জানি তবুও আমরা প্রতি মুহূর্তে এ পৃথিবীর সুখ ও নানাবিধ পাওয়া না পাওয়ার হিসাব করতে থাকি। অথচ সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে মহান সৃষ্টিকর্তা পবিত্র কোরআনে পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন “তোমরা ভালোভাবে জেনে রাখ, পার্থিব জীবন তো কেবল খেল তামাশা, এটা বাহ্যিক সোন্দৌর্য, পরস্পর দম্ভ এবং ধন ও সন্তানের প্রতিযোগীতা মাত্র। যেমন বৃষ্টি, যার দ্বারা উৎপাদিত ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ প্রদান করে, অতঃপর তা শুকিয়ে যায় এবং হ্লুদ হয়ে গিয়ে তা পরিণত হয় খড়ে। আর পার্থিব জীবন তো নিছক ছলনাময় ও ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়” (সূরা ৫৭;আয়াত ২০)।