নাদিরা তাবাসসুম : গত রাতে দেশের বাড়িতে বাবা-মায়ের সাথে ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কলে কথা বলেছে দীপিকা। কথা বলার সময় বাবা মেয়েদের (রেবা এবং রেশা) দেখতে চায়। বাবা বলে ‘কই তোমার মেয়েরা? আমরা ওদের দেখছি না যে’।
দীপিকা- আর বলো না বাবা। ওরা আইপ্যাড আর মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। রেবা রেশা কোথায় তোমরা এদিকে এসো; নানাভাই ও নান-মনির সাথে কথা বলো।
বাবা- কই ভিডিওতে ওদের দেখাও।
রেবা এবং রেশা দৌড়ে এলো কিন্তু ‘হাই’ হ্যালো’ বলে আবার দৌড়ে চলে গেলো। দীপিকা তাদের কাছে ফোনটা নিয়ে বলে ‘এই যে এবার কথা বলো’ কেমন আছেন জিজ্ঞেস করো ‘বড় মেয়ে রেবা বলে হাউ আর ইউ নানু’ কিন্তু ছোট মেয়ে রেশা দৌড়ে অন্যদিকে লুকিয়ে যায়।
দীপিকা- বাবা ওরা খুব লজ্জা পায় আর ভালো বাংলা বলতে পারে না।
বাবা ওদিক থেকে খুউব মন খারাপ করে বলে, ‘এটা কোন কৃতিত্বের কথা নয়। তোমরা মেয়েদের বিদেশে নিয়ে শুধু ইংরেজি শিখিয়েছ, বিদেশী বানিয়েছ। বাংলা ভাষা ঘরে শেখাওনি কেন? তোমরা বাঙালি বাবা-মা হিসেবে তোমরা এজন্য দায়ী।
দীপিকা- ওদের স্কুল এবং ঘরের বাইরে অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে সব সময় ইংরেজিতে কথা বলতে হয় তাই ওতেই ওরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
বাবা- এ কথা ঠিক নয় প্রকৃতপক্ষে তোমরা নিজেরাই উদাসীন। ওদের মুখে ইংরেজি শুনতে তোমাদেরও ভালো লাগে। আজ তোমরা যদি ঘরে নিজেরা ওদের সাথে বাংলায় কথা বলতে এবং আদব কায়দা শেখাতে কিভাবে বড়দের সম্মান দেখাতে হয় তাহলে তারা কত সহজ ভাবে আমাদের সাথে কথা বলতে পারতো।
এই বলে বাবা ফোনে ভিডিও কল কেটে দেয়। এরপর থেকে দীপিকা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে মেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে। শিশু বয়স থেকে মেয়েদুটো শুধু মোবাইল, আইপ্যাড আর কম্পিউটার নিয়ে সময় কাটাতে পছন্দ করে এমন কি কখনও কখনও খাওয়া দাওয়া লেখাপড়া সব কিছু ভুলে যায়। বাইরে গেলেও তাদের হাতে মোবাইল দিতে হয়। সারাক্ষণ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিভাবে এ অভ্যাস থেকে তাদের বিরত রাখবে চেষ্টা করেও কোন কাজ হয়নি।
রাশেদ স্ত্রী দীপিকাকে খুব চিন্তিত দেখে বলে- কি হয়েছে তোমার? বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি তুমি কথা বলছো না; চুপচাপ বসে কি ভাবছো।
দীপিকা পুরো ঘটনা রাশেদকে খুলে বলে- বাবা মা আমাদেরকে ভেবেছে যে আমরা ইচ্ছে করেই বাংলা শিক্ষা দেইনি।
রাশেদ- তুমি বুঝিয়ে বলতে পারতে যে, আমরা দুজনেই বাইরে কাজে যাই। সত্যি বলতে, ওদের সাথে যে সময় দেওয়া দরকার তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর সমাজে মোবাইল, কম্পিউটার ও টেলিভিশন সবার ঘরে ঘরে থাকে যেগুলোর প্রয়োজনও রয়েছে। আমরা যখন বাইরে কাজে চলে যাই, ওদের একা একা বাসায় বন্দীমতো থাকতে হয় তখন ওরা ওসব ব্যবহার করে। আর এভাবেই ওরা আসক্ত হয়ে পড়েছে। এখন করোনা মহামারীতে তোমার কাজে যেতে হচ্ছে না। আমিও আগের চেয়ে বাসায় বেশি সময় দেই।
দীপিকা- কিন্তু এখন তো দেরী হয়ে গেছে। ওরা আসক্ত প্রায় হয়ে গেছে। কিভাবে যে ওদের এ থেকে বের করে আনবো জানি না। কারণ প্রায় সকল অভিভাবক-এর বাচ্চাদের নিয়ে একই সমস্যা। সেদিন দেখলে না তোমার বন্ধু নিজাম ও সালিমা ভাবীর বাসায় যে দাওয়াতে গেলাম। সেখানে প্রায় প্রত্যেক বাচ্চার হাতে মোবাইল নাহয় আইপ্যাড একটা আছে। বড়রা সবাই গল্প গুজবে হৈ চৈ করছে কিন্তু বাচ্চারা মগ্ন হয়ে আছে মোবাইল আর আইপ্যাডে। মিলু ভাবীকে দেখে আমি সালাম দিলাম আর তোমার মেয়ে রেবাকে বললাম ‘আন্টিকে সালাম দাও’। রেবা না শুনে বরং অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মিলু ভাবী বিষয়টা বুঝতে পেরে আমাকে বললো- বুঝলে দীপিকা আজকাল প্রায় বাচ্চারা যন্ত্র নির্ভর হয়ে গেছে। লেখাপড়া খাওয়া দাওয়া সবই যেন ওখানে। ছোটদের কথা কি বলবো বড়রা তো আরও বেশি যন্ত্র নির্ভর। আমার সাহেব অফিস শেষে বাসায় ফিরে আগে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হবে তারপর খাওয়া দাওয়া শেষ হলেই টেলিভিশন-এর সামনে গিয়ে বসবে। একটার পর একটা খবর বাংলা ইংরেজি সব। এরপর বাংলা নাটক একটার পর একটা অনেক রাত পর্যন্ত। আমি ভাই এত রাত পর্যন্ত জাগতে পারি না। ছেলেমেয়েদের সাথে আমিও ঘুমাতে চলে যাই। হঠাত সালিমা ভাবী এসে কথায় যোগ দিয়ে বললো- যুগে যুগে কালে কালে আরও যে কি হতে চলেছে। আগের যুগের মানুষেরা একে তাই শেষ জামানা বলে। আমরা এত কিছু দেখে শুনে নিজেরা যেমন ‘কনফিউজড’ হয়ে গেছি তেমনি বাচ্চারাও ‘কনফিউজড’ হয়ে গেছে। ঘরে আমরা অভিভাবকেরা একভাবে বাচ্চাদের শিক্ষা দিতে চাই এবং দিতে চেষ্টা করি কিন্ত স্কুলে গিয়ে দেখে এবং শেখে আরেক রকম। নানা দ্বিধাদ্ব›েদ্বর মাঝে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে চলতে পারা বাচ্চাদের জন্য অনেক কঠিন একটা বিষয়।
মিলু ভাবী আবার এসে বলে- আমার কি মনে হয় জানো, ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ঘরে নৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শে গড়ে তোলা ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থার উপায় নেই- আর এজন্য প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন। দেখবে বাচ্চারা আজকাল ‘আদব কায়দা’ বা ‘শিষ্টাচার’ কি জিনিষ তার কিছুই বুঝতে পারে না। অথচ ‘আদব কায়দা’ বা ‘ শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ মানব গুণের একটি বিশেষ দিক। সৃষ্টির সেরা মানুষ যখন সৌজন্যহীন এবং শিষ্টাচারহীন হয়ে পড়ে তখন তারা পশুত্বের পর্যায়ে নেমে যায়। তাছাড়া অসৌজন্যমূলক আচরণকারী মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার কৃপা বা রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। নম্রতা, ভদ্রতা মানুষকে উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যায়। বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান এবং ছোটদের স্নেহ করা সকল মানুষেরই কর্তব্য। এ বিষয়গুলো ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের শিখিয়ে দেওয়া উচিত। সালিমা ভাবীও বলে- অনেক সুন্দর এবং সত্য বলেছেন।