কবিতায় প্রেম বহুস্বরে ও বহুসুরে আবহমান কাল ধরে পেয়েছি আমরা। প্রেমের অজস্র অনুভ‚তিমালা, প্রেম বিষয়ক পর্যবেক্ষণ জারিরাখা চোখে লেখা কবি কামরুল বাহার কবিতা। ঠোঁট হাসলে, মানবীর সমগ্র সত্তা হেসে ওঠে, এই অবলোকন পেয়ে যাই তাঁর কবিতায়। প্রেমিকার চোখের হাসিতে কবির হৃদয় বেজে ওঠে মৃদঙ্গ হয়ে। চিত্রকল্পকে বাস্তব বিচ্যুত করেন না কবি। কবিতায় প্রেমের ঘরানার সঙ্গে প্রকৃতির ঘরানার সংমিশ্রণ চেতনাবোধের নিবিড়তা আছে। প্রেম আর প্রকৃতি, তার সঙ্গে বাঁচার সংগ্রাম এখানে পরস্পরের পরিপূরক। অনুরণনের ব্যঞ্জনায় বাজছে প্রেম। প্রেমের ভিতরে একাকার হয়েছে সমুদ্র তার বিশালতায়, তেমনি আছে মৃত্যু চেতনা, এই ভেবে যে- মৃত্যুর পথ ঘুরে কবি নবজন্ম নেবেন প্রেমের আরেক রূপে। মৃত্যুকে কামনা করছেন কবি, কিন্তু সমুদ্রে, অন্য কোথাও নয়। মৃত্যুকে সমুদ্র নিয়ে যায় মহাচেতনায়, যেখানে মৃত্যু ইতিবাচক পুনর্জন্মের প্রতীক। সেই প্রতীকটি জীবনের সমস্ত ভাষাজগণ ও মনোজগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই প্রতীকটিকে আমরা পেয়ে যাই পরিষেবার ভিতর, যেখানে এক মানুষ অপর মানুষের সেবায় নেমে পড়ে। যখন কবি হাসপাতালের বিছানায় অঘোর অবস্থায় শায়িত, নার্সের সেবাপূর্ণ হাতটিকে মনে হয় প্রকৃত প্রেমিকার। প্রেমবিষয়ক এই বোধ তখন শুধু চাঁদনী রাতের রোমান্সেই সীমাবদ্ধ থাকে না। কবি প্রেমকে দেখেছেন বিভিন্ন ঘরানায়। কবি বিভিন্ন রঙের সঙ্গে ভালোবাসাকে একাকার করেছেন। রঙে পুড়তে চেয়েছেন। আবহমানের এই চিরন্তন মেজাজ কখন যে পাঠকের মনকে আচ্ছন্ন করে দেয়, তার সময়ও নির্ঘণ্ট না জানলেও চলে।
অলোক বিশ্বাস
কবি, সম্পাদক, কবিতা ক্যাম্পাস
ভারত।
কবি কামরুল বাহার আরিফ এর জন্ম ১৯৬৫ সালের ৭ নভেম্বর, বাংলাদেশের খুলনায়। বেড়ে ওঠা, শিক্ষা জীবন অতঃপর বসবাস রাজশাহীতে। পিতা চিশতী এস. এম. এস. দাহার, মাতা চিশতী জাহান আরা দাহার। হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতকসহ স্নাতকোত্তর। পেশা : উপ-পরিচালক (বাজেট), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
কামরুল বাহার আরিফ কবিতাকে ভালোবেসে কবিতার আলোয় আলোকিত হয়ে বুনে চলেন কবিতার গান। তার গানের সুর আমাদের আশপাশের চির চেনা জগতকে আমাদের চিনিয়ে দেয় নতুন করে আর আমাদের ভাবনায় জাগিয়ে তোলেন এমন এক বোধ যা অনেক সময় আমরা না বুঝে, না উপলব্ধি করে এড়িয়ে চলি। তিনি আমাদের অন্তর-চক্ষুকে উম্মোচিত করে দেন প্রতিনিয়ত।
কবি কামরুল বাহার আরিফ এর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে : ১. সূর্যের ম্যাপ ছুঁয়ে (২০০৮), ২. গোধূলির পাণ্ডু নীলিমায় (২০১২), ৩. কে ডাকে আগুনপথে (২০১৩), ৪. বর্ষা তো জলের বর্ণ (২০১৫), ৫. রাঙারোদ ছুঁয়েছে পৌষের শরীর (২০১৫), দ্বিতীয় সংস্করণ (২০১৬, বইমেলা), ৬. প্রেমবৃত্তে জল ও নারী (২০১৭), ৭. কে ওড়ে নদীপারের নায়ে (২০১৭), ৮. পাখিটি আর জলে নামেনি (২০১৯), ৯. পাতার ওপর লেখা আছে আমার কিছু (২০১৯) ১০. ও সর্বনাশ এসো (২০২০), ১১. ইজেলে উঠুক চড়ে ইনানী মেয়ে (২০২১), ১২. তুমি জেগে রবে, জেগে রহো- (২০২১) ১৩. নদীতে ছুঁয়ে দেয় ঠোঁট।
কবি কামরুল বাহার আরিফ ‘মৃদঙ্গ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করে আসছেন প্রায় দুই দশক ধরে। কবিতার জন্য তিনি কান্তকবি মেলা, রাজশাহী (২০১৬) উচ্চারক আবৃত্তি কুঞ্জ, চট্টগ্রাম (২০২০) সম্মাননা পেয়েছেন।
mridonggo@yahoo.com
তোমাকে ছুঁয়েছে হাত
ওগো বৃক্ষ
শীত বাতাসের ঝরাপাতা বৃক্ষ
এবার জাগো, জেগে ওঠো। পল্লবিত করো শাখা প্রশাখা
দেখো, তোমাকে ছুঁয়েছে হাত বসন্তের দেবী- জাগানিয়া পাখি।
তুমি বসন্তের বিছানে শুয়ে এখনো শীত কাতরায় জড়সড়
তোমার ঝরানো পাতার বোঁটায় বিরহের দাগ
বসন্তের পাখি তোমাকে ডেকেছে- জেগে ওঠো!
পত্র পল্লবে ছেয়ে দাও বসন্তের রঙ
আয়োজন করো পাখিদের কনসার্ট। আমন্ত্রণ করো ইথারের অন্তর্জালে
জাগানিয়া পাখি সাজাবে মঞ্চ- তোমার ডাল থেকে ডালে।
পাখিদের এই কনসার্ট থেকে মানবেরা শিখে নিবে গান
শিখে নিবে বসন্ত শিহরণ
পাখি প্রেম, প্রেমের প্রণয়
তারপর তাড়িয়ে যত শীত মানুষও জেগে উঠবে ফের।
ওগো বৃক্ষ
বসন্তের পাখি তোমাকে ডেকেছে।
তুমিও মানুষকে ডাকো- দেখো
মানুষও ত চিহ্ন মুছে
শীতের বিরহ কাতরতা ভুলে জাগবে ফের।
জন্ম দিবে সুরের মানুষ,
শাখাতে কাণ্ডে মানুষ ফুটাবে মানবিক ফুল।
এবার জাগো এবং জাগাও- পল্লবিত করো
বসন্তের দেবী- জাগানিয়া পাখি
ছুঁয়েছে যে তোমার হাত।
পরী হাসলে তার গালে টোল পড়ে
আকাশ থেকে শান্ত ডানায়
পানকৌড়ি নামলো পরীদের পুকুরে।
এদিক ওদিক দেখে নিয়ে জলে টোল ফেলে
টুপ করে ডুব দিয়ে পানকৌড়ি হারিয়ে গেলো
জলের টোলের ঢেউ বৃত্তাকারে পাড় পেরিয়ে
আমাকে দুলিয়ে দিলো!
খানিক বাদে পানকৌড়িটা জলের ঝাপটায়
একটা রুপালি মাছ মুখে উপরে উঠে এলো
তারপর উড়ে গেলো…
পরী হাসলে তার গালে টোল পড়ে
অথচ পরীর কোনো দুপুর নেই।
পরীর কী জ্যোত্স্না আছে? দিন বা রাত?
পরীদের একটা পুকুর আছে।
প্রতিদিন সে পানকৌড়ি হয়ে জলে টোল ফেলে
আবার জল ঝাপটিয়ে হারিয়ে যায়… ডানা মেলে।
অলকানন্দা
তুমি যখনই হাসো
তখনই অলকানন্দার মত
গালের ওপর সুদৃশ্য
একটা টোল পড়ে।
আমার ঠোঁট তখন
কাঠঠোকরার এক আদুরে
ঠোঁট হয়ে যায়।
তোমার টোলে আদরে আদরে
আমাদের প্রেমের নিবাস গড়ি।
পপাত
আলোর ধর্মে যদি পপাত থাকে
যদি উড়ো চুল বেয়ে
বেণীর ভাঁজে নেমে আসে আলো
তবে হাতের চুড়ির হাসিতে
দোষ কেনো আর?
মেরুনরঙা টিপ
আড়ালে অপেক্ষার সময় পেরিয়ে
অভিসারের দরজায় খিল এঁটে দিলে
অভিসারের পপাত শুরু হয়
নোনাসাগরের ঢেউবোনা অসীম চাদরে।
পপাতেরও পপাত থাকে-
বৃষ্টির বৃক্ষ প্রেম থেকে নেয়া যায় সেই পাঠ।
কোন রাধা জলে নামে বেহুলা নামে
পানপাত্রে তৃষ্ণা বাড়ছে
লালজলের তৃষ্ণা
লালজলের মায়াবী ফেনার তৃষ্ণা
পাশে সঙ্গীহীন শূন্যতা
তৃষ্ণা বাড়ছে তারও
তৃষ্ণার যুগলে রাত বাড়ছে আরও
রাতজলের উজানে দাঁড় টানছে
জল ডাকছে মাতাল ঘনত্বে
তৃষ্ণার সুতা ছুটছে সাগরের জলে
লালজলে মাছেদের মিথুন-
কৃষ্ণের বাঁশির সুরে
কোন রাধা জলে নামে বেহুলা নামে?
ফেনায় ফেনায় বাড়ছে নেশা
একটু একটু করে রাত সুতো ছিঁড়ছে
লালজলে স্নান শেষে তৃষার্ত পানপাত্র
উজানের উল্টোস্রোতে আঁচলের পাল তুলে
বেহুলার বুকে বুদ হয়ে
চলে যাচ্ছে স্বর্গের দিকে…
জাতিরাষ্ট্র দিবে না সুপেয় জল
নির্জন এক জলেপূর্ণ পুকুর আরও অধিক বেদনায়
নিশ্চুপ হয়ে যখন সন্ধ্যাকে ডেকে নিলো নৈঃশব্দ্যে
তখনই একটা মাছ ঘাই মেরে জলের নৈঃশব্দ্য ভেঙে
সশব্দে জানিয়ে দিলো- আফগান কিংবা ফিলিস্তিনের
মৃত্যু আতঙ্কিত শিশুদের বিপন্ন মুখের রক্তাক্ত চেহারা।
সমুদ্র গভীরের ভাসানচরে সজ্জিত আবাসের মানবিকতায়
আপাতত কিছু রোহিঙ্গা শিশু পেয়েছে মুক্তির নিঃশ্বাস
পৃথিবীর সকল মানবিক সূচক, সকল জাতিরাষ্ট্র আজ
ঐ জলেপূর্ণ নির্জন নিস্তব্ধ পুকুরটার মত।
মাঝে মাঝে দুএকটা মাছ ঘাই মেরে নাড়িয়ে দেয় শুধু।
এ এমন এক পৃথিবী যা মানুষের অগোচরে বেঁচে আছে
চারিদিকে জল, চোখের অসীমতায় নোনাজলের নহর
তারই মাঝে ভাসানচরে নতুন করে
শিশুদের কোলাহল আর আনন্দ-উত্ফুল্লতা
তাদের শেকড় কখনো মাটির মমতা পাবে না
শিখরে উঠবে না তাদের বেধে দেয়া বনসাইস্বপ্ন
জাতিরাষ্ট্র তাদের নিবে না, দিবে না সুপেয় জল
গভীর সমুদ্রের মানবিক ভাসানে শিশুদের কোলাহল যেনো
সেই আবদ্ধ পুকুরের গভীর জলের নির্বোধ বুকে
এক একটা মাছের একটা একটা নির্মম ঘাই।
হেনাচত্বর
শ্রদ্ধা : জাতীয় নেতা শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামান হেনা
একটা স্মৃতিস্তম্ভ, আকাশছোঁয়া
চারিদিকে গোলবেদী, জলের ঝরনা
ঠাণ্ডা মায়াময়।
বেদীর ঘূর্ণিপথে নানা বিভক্তিপথ দিক-দিগন্তে
পথে পথে ব্যস্ত বাহন
বাহনের ভিন্নতায় পথেরও ভিন্নতা
যাত্রীদের ভিন্নতায় পথও ভিন্ন।
পথিক কখনো দর্শক নয়, দর্শকও পথিক নয়
আবার একই পথিক দর্শক হয়,
একই দর্শক পথিক- ভিন্ন ভিন্ন সময়ে
পথিকের চোখ থাকে না, উঁচিয়ে থাকা গলাও না
শুধু ছুটে চলা গতি থাকে তার!
পথিক একদিন গতি থামিয়ে ব্যস্ত পথ ছেড়ে দিয়ে
পাশের কবরখানায় বৃক্ষ স্মারকরূপে দর্শক হয়।
তাদের গলা তখন অনেক উচ্চতার বাঁশঝাড়
অনেক উচ্চতার মেহগনি, জারুল, পারুল, শিমুল
আর পলাশের লালফুলে শান্ত শালিকের চোখের বিস্তৃতি।
এরপর বৃক্ষস্মারকেরা,
বাতাসের নত হওয়ার প্রণতিতে দুলতে দুলতে পরম আয়েশে
স্মৃতিস্তম্ভের গোলচক্করের ছুটন্ত পথিকদের দেখতে থাকে
দেখে, আকাশের মায়ামাখা সুদীর্ঘ বেদী থেকে
বৃষ্টির মত অজস্র আশীর্বাদ নেমে আসে পথিক ও পথে!
উপক‚লের আশ্রয়
তোমার টিপ
মেরুন, সবুজ, গোলাপি বা লাল যে রঙেরই হোক
তোমার কপালে
তা যেনো বিশাল আকাশে আলোর জ্যোতিষ্করূপ!
তোমার চোখ-
মায়ার অবিরত ঢেউ-এ এক অসীম সাগর
আর কপাল-
টিপের রঙে রঙিন দীর্ঘ উপক‚ল- প্রশ্রয়ের আশ্রয়।
আমি যখনই তোমার চোখে ডুবতে ডুবতে
জলসমাধির দিকে এগিয়ে যাই
তখনই তোমার কপালের নানা বর্ণের টিপগুলো
অদৃশ্য সূতোয় টেনে নিয়ে আমাকে
তোমার কপালের দীর্ঘ উপক‚লে আশ্রয় দিয়ে
উত্কণ্ঠার মায়ার শাসনে বলো,
এভাবে চোখের মায়াজলে ডুবে গেলে
উপক‚লে তো বৃক্ষ জন্মাবে না আর!
কেমন করে ফুটবে নানা রঙের ফুল?
টিপ তো ফুলের প্রতিরূপে আকাশের জ্যোতিষ্ক।
মনে রেখো,
‘ডুবতে ডুবতে কখনো উপক‚লের দৃষ্টিসীমা হারাতে নেই।’
মমি সাদৃশ্যে
একটা অদৃশ্য হাত ঘরের ভিতরে ঘুরছিল
আমি অনুভব করছি আর ভীষণ ঘামছি
শুনলাম টাশ করে সুইচটা অন হলো
মাথার উপরের ফ্যানটা ঘুরতে শুরু করলো
লাইটটাও বন্ধ হলে হাতটা স্পষ্ট হলো
হাতটা মশারির ভিতরে অনায়াসে ঢুকে গেলে
আমি ঘামের নদীতে ভেসে যেতে থাকলাম
ধীরে ধীরে হাতটা সরীসৃপ শীতলতায়
আমাকে জড়িয়ে নিয়ে প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে গেলো
আমি এখন হিমালয় হিমে হারিয়ে যাচ্ছি
যারা মমি সাদৃশ্যে কোনোদিন ঘরটাকে দেখবেন
তাদের চোখে ভাসবে এক প্রেমিকার মায়াবিনী হাত।
বনৌষধি
যখন আমার প্রেমিকার মুখটাকে একটা ফলন্ত আতাগাছ মনে হয়, তখন দৃষ্টির আদরের চোখ সেই মুখে বিলিয়ে দেয় অজস্র সুখ। এ আমার নিদারুণ অসুখ! এ অসুখের প্রতিষেধক চিকিত্সাবিদেরা জানে না। প্রেমিকের এমন অজস্র অসুখের সুচিকিত্সা কেবল ফলন্ত আতাফলের নিবিড় গবেষণায় লুপ্ত থাকে। আমি আতাফল জাগ দিয়েছি হৃদয় উনুনে। এবার আতাফল থেকে জন্মাবে যে বৃক্ষ তার জারক সুস্বাদ রসে তৈরি হবে সুখ অসুখের বনৌষধি। আদরের চোখে আমি তো অতল সুখ বিলিয়ে যাই কাল নিরবধি।