অনলাইন ডেস্ক : আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ট্যারিফ ভ্যালু (সরকার কর্তৃক মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া) না থাকায় কাপড়ের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দরে আমদানি দেখাচ্ছে একশ্রেণির আমদানিকারক। এর ফলে একদিকে সরকার ন্যায্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় বস্ত্রশিল্প অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে।
এছাড়া ওভেন (শার্ট ও প্যান্ট জাতীয় পোশাকের কাপড়) ফেব্রিকের বিশ্বব্যাপী পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবে মিটার ব্যবহার করা হলেও বাংলাদেশে তা মূল্যায়িত হয় কেজিতে। আর এই সুযোগেও কারসাজি করেন একশ্রেণির আমদানিকারক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কম মূল্য দেখানোর পর বাদবাকি অর্থ অবৈধ উপায়ে হুন্ডি কিংবা কোনো কোনো ব্যাংকের যোগসাজশে রপ্তানিকারকের কাছে পাঠানো হয়, যা অর্থপাচার হিসেবে বিবেচিত। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন একশ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট দেশের রপ্তানিকারকও।
বস্ত্র শিল্প মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইস্যুটি নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্য সম্প্রতি ট্যারিফ কমিশনকে নির্দেশ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিষয়টি পর্যালোচনা করে গত ১০ ডিসেম্বর ট্যারিফ কমিশন দুটি সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এগুলো হলো, আমদানিকৃত কাপড়ের ট্যারিফ মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারদরের ভিত্তিতে ঠিক করা এবং ওভেন কাপড় পরিমাপের মানদণ্ড কেজির পরিবর্তে মিটারে নির্ধারণ করা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনিশ বলেন, সুপারিশ তিনি এখনো হাতে পাননি। বিস্তারিত পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তী উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এদিকে স্থানীয় বাজার পর্যবেক্ষণেও এসব কাপড়ের ট্যারিফ ভ্যালু আর খুচরা পর্যায়ে বিক্রয়মূল্যের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত্। পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের জবাবদিহিতা না থাকায় রাজস্ব বিভাগ, স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের পাশাপাশি ক্রেতাও ঠকছেন। অস্বাভাবিক মুনাফা নিচ্ছে কেবল আমদানিকারক ও বিক্রেতা। অন্যদিকে রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা (বন্ড সুবিধা) কাপড়ও মিশে যাচ্ছে এসব কাপড়ের সঙ্গে।
দেশে ওভেন ও নিটওয়্যারের ভিন্ন ভিন্ন এইচ এস কোডের (পণ্য পরিচিতি নম্বর) আওতায় সাত ধরনের কাপড় বেশি আমদানি হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসব কাপড় আমদানির পরিমাণ ছিলো ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৩ মেট্রিক টন। এর মধ্যে রপ্তানির জন্য আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ১৯৯ মেট্রিক টন। এসব কাপড় শুল্কমুক্ত সুবিধায় আসে, যা বন্ড সুবিধা নামে পরিচিত। আর বাদবাকি ৩৮ হাজার ৫৯৪ মেট্রিক টন কাপড় এসেছে বাণিজ্যিক আমদানি হিসেবে। এসব কাপড়ের ওপর শুল্ককরের পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশ।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, বন্ড সুবিধার আওতায় রপ্তানিকারকরা ৮৫ শতাংশ তুলায় উত্পাদিত ওভেন কাপড় প্রতি কেজি আমদানি করেছেন ৭৪২ টাকায়। অথচ একই কাপড় বাণিজ্যিক (শুল্ক প্রযোজ্য) আমদানিকারকরা আমদানি মূল্য দেখিয়েছেন প্রতি কেজি মাত্র ২৭৬ টাকা! এটির ট্যারিফ ভ্যালু তিন মার্কিন ডলার বা প্রায় ২৫৫ টাকা। একই ভাবে সিনথেটিক ফিলামেন্ট ইয়ার্নের কাপড় প্রতি কেজি রপ্তানিকারকরা গড়ে ৭০৬ টাকায় আমদানি করলেও বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা দেখিয়েছেন ২৭২ টাকা। এর ট্যারিফ ভ্যালু প্রতি কেজিতে চার ডলার বা ৩৪০ টাকা। শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আনা আর্টিফিশিয়াল স্টেপল ফাইবারের কাপড়ের কেজিপ্রতি গড় আমদানি মূল্য ৬৯৮ টাকা আর বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা দেখিয়েছেন ২৬৯ টাকা। অন্যান্য কাপড়ের দামের ক্ষেত্রেও একইভাবে শুল্কযোগ্য কাপড়ের মূল্য খুবই কমিয়ে দেখানো হচ্ছে।
স্থানীয় বস্ত্র শিল্পের উদ্যোক্তা ও এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু রপ্তানির জন্য আনা কাপড়ে কোন শুল্ক নেই, এজন্য তাদের মূল্য কম দেখানোর দরকার নেই। অর্থাত্ কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাদের আমদানিকৃত গড় মূল্যই আন্তর্জাতিক বাজারে কাপড়ের দামের মানদণ্ড। এর নিচে যে দর দেখানো হচ্ছে, ঐ পরিমাণ আমদানি মূল্য কম দেখানো হচ্ছে। এটি কৌশলে সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া ট্যারিফ ভ্যালুর কাছাকাছি দেখানো হয়। আমদানি মূল্য যাই হোক, ট্যারিফ ভ্যালুর ওপরই শুল্ককর নির্ধারণ হয়। ফলে এই সুযোগটি নিচ্ছে বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা।
প্রায় একই কথা বলছে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনও। সেখানে বলা হয়, ‘বন্ডের মাধ্যমে আমদানিতে কোনো প্রকার শুল্ক না থাকায় আমদানি মূল্যকে ফেব্রিকের আন্তর্জাতিক মূল্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। অপরদিকে বাণিজ্যিক আমদানিতে অধিকহারে শুল্ক থাকায় আমদানি মূল্য অনেক কম দেখা যাচ্ছে। মূলত শুল্কের কারণে ফেব্রিকের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অপেক্ষা কম মূল্যে আমদানিকৃত কাপড় শুল্কায়িত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। স্থানীয় আমদানিতে সরকার যে হারে ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করেছে, তা আন্তর্জাতিক বাজার ও স্থানীয় উত্পাদন মূল্য অপেক্ষা অনেক কম বলে প্রতীয়মান। এর ফলে স্থানীয় উত্পাদনকারীরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছেন।’ প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মুন্সি শাহাবুদ্দিন কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সাবেক পরিচালক ও লিটল গ্রুপের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম মনে করেন, ট্যারিফ ভ্যালু কম থাকায় বছরের পর বছর ধরে এই অনিয়ম করে আসছে একশ্রেণির আমদানিকারক। ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে এবং স্থানীয় শিল্প মালিকরা প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে ব্যবসা থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ট্যারিফ ভ্যালু ছাড়াও কেজিতে ওভেন ফেব্রিকের শুল্কায়ন করার সুবিধা থাকায় এতে বিরাট কারসাজি হচ্ছে। অথচ বিশ্বব্যাপী কোথাও ওভেন কাপড় কেজির হিসাবে শুল্কায়ন করা হয় না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, কম দাম দেখিয়ে বাকি টাকা ‘অন্যভাবে’ পাঠানো হচ্ছে।
দামের তারতম্য দেখিয়ে জালিয়াতের এ বিষয়টি এনবিআরের শুল্ক বিভাগেরও অজানা নয় বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের শুল্ক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমাদের কাছে পাঠালে আমরা যাচাই করে যৌক্তিক ট্যারিফ ভ্যালু নির্ধারণের উদ্যোগ নেব।