মোহাম্মদ সাকিবুর রহমান খান, ম্যানিটোবা : সামার আসছে কানাডাতে। ঠান্ডার এই দেশটিতে অফিশিয়ালি সামার শুরু হবে ২০ জুন থেকে আর থাকবে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এখন চলছে করোনাকাল। এই দেশের মানুষ মূলত করোনাভীতির কথা চিন্তা করতে শুরু করে গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে। এখন করোনার প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমলেও পুরোপুরি থামেনি। আসলে এই সামারে মানুষকে ঘরে রাখা কষ্টের হয়ে যাবে সরকারের জন্য।

ঠান্ডার কারণে কানাডার অধিকাংশ মানুষ গত বছরের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঘরে বন্দী। তাঁরা সামারের এই তিন মাস ঘরে বসে কাটাতে চান না। সে কারণে কানাডার বিভিন্ন প্রভিন্সিয়াল সরকার লকডাউন এবং মানুষের জমায়েত শিথিল করেছে। যেমন ম্যানিটোবা প্রভিন্সে একসঙ্গে বাইরে ৫০ জন অনুষ্ঠান করতে পারবেন। ঘরে এটা ২০ জন। ফলে কানাডার ট্যুরিস্ট স্পটগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। মানুষ এক প্রভিন্স থেকে অন্য প্রভিন্সে না গেলেও নিজেদের প্রভিন্সে ঘুরছে।গত ৩০ মে গিয়েছিলাম আমরা আরেকটি পরিবার মিলে ম্যানিটোবা প্রভিন্সের রাজধানী উইনিপেগ থেকে উত্তর দিকে ‘স্টিপ রক’–এ। কানাডার ভেতরের কিংবা এই দেশের বাইরের পর্যটকদের কাছে জায়গাটি খুবই আকর্ষণীয়।

এখানকার শান্ত–নিরিবিলি পরিবেশ মানুষকে আকর্ষণ করে। আমাদের বাসা থেকে স্টিপ রক ২৫৪ কিলোমিটার। কানাডায় যদি কোথাও আপনি ঘুরতে যান, তাহলে বাংলাদেশের মতো অনেক কিছুই চিন্তা করতে হয় না। শুধু গাড়িতে জ্বালানি তেল আর বাসা থেকে কিছু রান্না করে নিলেই হয়। সঙ্গে যদি একটি পোর্টেবল বারবিকিউ মেশিন ও বড়শি নিয়ে যান, তাহলে আর কোনো চিন্তা নেই। বিভিন্ন লেক থেকে মাছ ধরে সেখানে রান্না করে খেতে পারবেন। সে কথা যাক, সকাল ১০টায় আমরা রওনা দিলাম বাসা থেকে। উইনিপেগ থেকে উত্তর দিকে।

উইনিপেগের সবচেয়ে উত্তরের শহর ‘থমসন’ যেতে পথে পড়ে স্টিপ রক। উত্তরে থমসন ছাড়া আর কোনো জনবসতি না থাকায় রাস্তা একেবারে খালি। রাস্তায় গাড়ির স্পিড লিমিট ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। এখানকার রাস্তায় মাঝেমধ্যে পুলিশ ক্যামেরা নিয়ে বসে থাকে। তাই স্পিড লিমিটের বাইরে গাড়ি জোরে চালানোর কোনো সুযোগ নেই। মাঝখানে একটা ১৫ মিনিটের বিরতি নিয়ে দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম স্টিপ রকে। জায়গাটা প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি। বিশাল জলরাশিকে আটকে রেখেছে ক্লিফ (পাথরের খাড়া প্রাকৃতিক বাঁধ)।

এই ক্লিফ থেকে আমরা নিচে নেমে গিয়ে পানির কাছে গেলাম। সূর্যের আলোর বাড়া-কমার সঙ্গে পরিবর্তন হয় পানির রং। এখানে পানির রং কখনো নীল আবার কখনো সাদা। সবচেয়ে মজা আর রোমাঞ্চকর এক ক্লিফ থেকে আরেক ক্লিফে যাওয়া। মাঝেমধ্যে পাথরগুলো পিচ্ছিল। তাই পথ চলতে হয় খুব সাবধানে।

এখানে আরেকটি বিনোদন হচ্ছে ক্লিফের ওপরে জঙ্গলের মধ্যে পথ খুঁজে ট্র্যাকিং করা। এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। আমরা পার্সোনাল ওয়াকিটকি নিয়ে যাইনি, তাই আর বেশি দূর না এগিয়ে ফিরে এলাম। এখানে অনেক পার্সোনাল বিচ রয়েছে। অনেকে অনলাইনে বুকিং দিয়ে কয়েকটা রাত কাটিয়ে যান। আর খোলা বিচে বসে খাবারের জন্য বা বসার জন্য বেঞ্চ ও টেবিল আছে।

আমরা দেখলাম অনেকে বোটিং করছে, কেউ আবার এই বিশাল নীল জলরাশিতে স্পিডবোটে ঘুরছে। কানাডার প্রকৃত ভ্রমণপিপাসুদের নিজেদের স্পিডবোট এবং কায়াক (ডিঙি নৌকা) আছে। তারা গাড়ির পেছনে নিয়ে লেকে ঘুরতে যান। তবে এখানে বোট এবং স্পিডবোট ভাড়া পাওয়া যায়। কায়াক প্রতি ঘণ্টায় ১০ ডলার আর স্পিডবোট ঘণ্টায় ৮০ ডলার।

সাঁতারের জন্য জায়গাটা ভালো। আপনি যদি ক্লিফ রাইডিংয়ের অভিজ্ঞতা নিতে চান, তাহলে এটি একটি সুন্দর জায়গা। আগেই বলেছিলাম, আমরা নিজেরা বাসা থেকে খাওয়া নিয়ে এসেছিলাম। কয়েক ঘণ্টা ঘুরে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম। স্টিপ রকের বিচে মাত্র একটি আইসক্রিমের দোকান পেয়েছিলাম। তবে সেটি বন্ধ কোভিড-১৯ থাকার কারণে। এখানে ৫০-৬০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো খাবারের দোকান নেই।

যাঁরা বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে এই জায়গাটা দেখে যেতে চান, তাঁদের জন্য একটি বিষয় তা হলো, কানাডায় বাংলাদেশের মতো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অর্থাৎ বাস, ট্রেন বা প্লেন সব জায়গায় যায় না। আপনি আসতে চাইলে উইনিপেগে এসে কারও সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে। এই সময় ম্যানিটোবাটে সূর্য ডোবে নয়টার পর। তাই আমরা সন্ধ্যা ছয়টার দিকে স্টিপ রক থেকে রওনা দিয়ে দিনের আলো থাকতে থাকতে চলে এলাম বাসায়।
*mdsakibur73@gmail.com