বাংলা কাগজ : বিংশ শতাব্দীর পাঁচ দশক থেকে একবিংশ শতাব্দীর দুই দশক পর্যন্ত সারা বিশ্বের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গত ৮ই সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার কানাডার রাষ্ট্রপ্রধান ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৯৬ বছর বয়সে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তিনি ছিলেন ডিউক অব ইয়র্ক এবং রাজা পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় পুত্র আলবার্ট বা ষষ্ঠ জর্জের প্রথম সন্তান। তাঁর বাবা ১৯৩৬ সালে নিজের ভাই রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের পরে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। আর সেই সময় থেকেই এলিজাবেথ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা গেলে তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। রানি এলিজাবেথ বাড়িতে ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষিত হয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নারী বিভাগ অগজিলিয়ারি টেরটোরিয়াল সার্ভিসে (Auxiliary Territorial Service) কর্মরত থেকে জনসাধারণের জন্য দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি গ্রিক ও ডেনমার্কের প্রাক্তন রাজপুত্র ডিউক অফ এডিনবরা ফিলিপকে বিয়ে করেন।

এলিজাবেথ-ফিলিপ দম্পতির চারটি সন্তান হয়। তাঁরা হচ্ছেন, বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লস, রাজকুমারী অ্যান, ইয়র্কের ডিউক যুবরাজ অ্যান্ড্রু, এবং ওয়েসেক্সের আর্ল যুবরাজ এডওয়ার্ড।

মাত্র ২৫ বছর বয়সে ব্রিটিশ রাজত্বের দায়িত্ব গ্রহণকারী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৭০ বছরের রাজকার্য পরিচালনা পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে থাকবে। যুক্তরাজ্য ছাড়াও তিনি ছিলেন ১৪টি দেশের রানি। তিনি ৫৪ সদস্যের জোট কমনওয়েলথের প্রধান, যে দেশগুলোর অধিকাংশই অতীতে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। এক কথায় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন বিশ্বের সর্বাধিক পরিচিত রাজতন্ত্রের প্রতিভূ। ১৯৪৭ সালের ২১শে এপ্রিল তাঁর ২১ তম জন্মদিনে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের সবার সামনে ঘোষণা করছি, আমার পুরো জীবন, তা দীর্ঘ হোক বা ছোট হোক, আপনাদের সেবায় এবং আমাদের মহান রাজপরিবারের সেবায় নিবেদিত হব, যার সাথে আমরা সকলেই যুক্ত।’

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ হয়তো সে সময় ধারণা করেন নি যে তিন-চতুর্থাংশ শতাব্দী পরে এসে তিনি তাঁর শপথে বলা সেই অঙ্গীকারটি পালন করে যেতে পারবেন তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। রানি কমনওয়েলথকে একত্র করার জন্য তাঁর কাজের ওপর খুব জোর দিয়েছিলেন। কারণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে কঠিন কাজ। অনেক দেশ ব্রিটিশ উপনিবেশমুক্ত হয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। তবে কমনওয়েলথকে সত্যিকারের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন। গত ৭০ বছরে বিশ্বজুড়ে নানা রকম উত্থান-পতন ঘটেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রযুক্তি তাড়িত জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে। এত কিছুর মধ্যেও ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রানি এলিজাবেথ এক অভূতপূর্ব দক্ষতায় সব ঢেউ সামাল দিয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন।

৯৬ বছর আগে যখন এলিজাবেথের জন্ম, তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি সম্পর্কে বলা হতো, ওই সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য ডোবে না। ৬০ কোটি মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল সে সাম্রাজ্যের। কিন্তু তিনি রাজসিংহাসনে আসীন হওয়ার পাঁচ বছর আগেই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়। অবশ্য তখনো আফ্রিকার বিরাট অংশজুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ বজায় ছিল। যার প্রায় সব কটি পরে স্বাধীন হয়েছে। তাঁর রাজত্বকালে প্রথম স্বাধীন হয় ঘানা, ১৯৫৭ সালে। আর জীবদ্দশায় শেষ প্রজাতন্ত্র হয় ক্যারিবীয় দেশ বার্বাডোজ, গত বছরের নভেম্বরে। ওই সব রাষ্ট্রের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিকতায় রানি নিজে উপস্থিত থাকেন নি, কিন্তু রাজপরিবারের প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন, যাদের উপস্থিতিতে ব্রিটিশ পতাকা নামানো হয়েছে। তবে এসব রাষ্ট্র স্বাধীন হলেও প্রায় সবাই কমনওয়েলথ জোটের সদস্যপদ গ্রহণ করে রানির একটি আলংকারিক অভিভাবকত্ব মেনে নিয়েছে। কমনওয়েলথের নেতাদের আনুষ্ঠানিক শোকবার্তায় রানির ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং বিভিন্ন সময়ের সহযোগিতার উষ্ণতার কথা উঠে এসেছে। তিনি কমনওয়েলথের প্রায় সব কটি দেশ সফর করেছেন এবং এক ধরনের যোগসূত্র ধরে রেখেছেন। কমনওয়েলথের বাইরে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনেতারাও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।
রানি হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথ যে শুধু রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন, তা নয়, তিনি ছিলেন খ্রিষ্টধর্মের প্রোটেস্ট্যান্ট শাখার প্রধান। সুয়েজ সংকট, শীতল যুদ্ধ, বার্লিন দেয়ালের পতন, ফকল্যান্ড যুদ্ধ, নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলা ও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ ও কোভিড মহামারি—এসবই তাঁর জীবদ্দশায় ঘটেছে। তাঁর সময়েই যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়েছে। এসব রাজনৈতিক বিষয়ে রানি কখনোই কোনো পক্ষ অবলম্বন করেননি, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়েছে পার্লামেন্টে। তাঁর শাসনামলে শুধু যুক্তরাজ্যেই ১৬ জন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন, তাই নয়, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডায়ও প্রায় সমসংখ্যক প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে। তিনি ওই দেশগুলোরও রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।

ষাটের দশকে রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের আনুগত্যে কিছুটা বদল আসতে শুরু করে। হ্যারল্ড ম্যাকমিলান ১৯৬৩ সালে পদত্যাগ করার পর একটা সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয় এবং রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসেন রানি এলিজাবেথ। সেই সময় রানি ও রাজতন্ত্রকে সরকারের দৈনন্দিন কার্যকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রানিও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলান। রানির দায়িত্ব সীমিত থাকে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন, দেশের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত থাকা এবং সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার মধ্যে।
এরপর নব্বইয়ের দশক ছিল রাজপরিবারের জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়। রাজপরিবারে নানা ধরনের কেলেঙ্কারি ও দুর্যোগের ঘটনা শুরু হয়। রানির দ্বিতীয় ছেলে ডিউক অব ইয়র্ক ও স্ত্রী সারা আলাদা হয়ে যান। মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান ও স্বামী মার্ক ফিলিপসের বিয়ে ভেঙে যায়। প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানা বিয়েতে যে গভীরভাবে অসুখী, তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। রানির প্রিয় বাসভবন উইন্ডসর ক্যাসলে ওই বছরই বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। ওই ভবন মেরামতের খরচ সরকার বহন করবে, নাকি রানির নিজের সম্পদ থেকে ব্যয় করা উচিত, তা নিয়ে চলে তুমুল বিতর্ক। জনমনে এ রকম বিতর্কের মধ্যেও যখন রানি রাজপরিবারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট, তখন প্রিন্সেস ডায়ানার আকস্মিক মৃত্যু ব্রিটেনের রাজপরিবারের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা হয়ে আসে।

মানুষের উত্তাল সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত রানিকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে পুত্রবধূ ডায়ানার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং রাজপরিবার শিক্ষা গ্রহণ করবে বলে ঘোষণা করেন।

তবে স¤প্রতি রানির আরেক পুত্র রাজকুমার এন্ড্রæর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা নিয়ে কেলেঙ্কারি ফাঁস হলে তা রানির জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করে। রানি প্রিন্স এন্ড্রুর সামরিক মর্যাদা কেড়ে নেন এবং রাজকীয় দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। একইভাবে রানির পৌত্র প্রিন্স হ্যারির অশ্বেতাঙ্গ প্রেমিকাকে বিয়ে করা নিয়ে রাজপরিবারের ভেতরের অনেক অপ্রিয় কথা হ্যারি ও স্ত্রী মেগান মেরকেল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করে দেওয়ায় বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি হয়।

এসব বিতর্ক রাজতন্ত্রের জন্য সাময়িক চ্যালেঞ্জ তৈরি করলেও রানি তা বেশ ভালোভাবেই মোকাবিলা করেন। তাঁর রাজ্যশাসনের ৭০ বছর পূর্তির উৎসবে রাজপরিবারের প্রতি অবিশ্বাস্য রকম সমর্থনের প্রতিফলন ঘটে।

মৃত্যুর মাত্র দুই দিন আগে গত মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর এ বালমোরাল প্রাসাদে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি লিজ ট্রাসকে যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনুমোদন দেন।
১৯ সেপ্টেম্বর সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে। বাকিংহাম প্যালেস স্থানীয় সময় শনিবার বিকেলে একথা নিশ্চিত করেছে। বাকিংহাম প্যালেস জানিয়েছে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে রানির মরদেহ চার দিন শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। বাকিংহাম প্যালেস জানিয়েছে, শেষকৃত্যের আগে রানির একমাত্র মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান স্কটল্যান্ড থেকে কফিন নিয়ে লন্ডনে যাবেন। কফিনটি মঙ্গলবার এডিনবরা বিমানবন্দরে নেওয়া হবে। পরে রানির একমাত্র কন্যা বিমানবাহিনীর বিমানে করে কফিন লন্ডনে নিয়ে যাবেন। বাকিংহাম প্যালেসে রাজা চার্লস তৃতীয় এবং তার স্ত্রী কুইন কনসোর্ট ক্যামিলা কফিন গ্রহণ করবেন। বুধবার রানির মরদেহ বাকিংহাম প্যালেস থেকে ওয়েস্টমিনস্টার হলে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে কফিনটিকে একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মে রাখা হবে। কফিনটি রাজকীয় পতাকায় মোড়ানো হবে এবং তার ওপর মুকুট, রাজকীয় প্রতীক এবং রাজদণ্ড রাখা হবে। সাধারণ মানুষ তখন রানিকে সার বেধে শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন। ঐতিহাসিক গির্জা ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতেই ব্রিটেনের রাজা এবং রানিদের অভিষেক করানো হয়। এখানেই ১৯৪৭ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের বিয়ে হয়েছিল।
কানাডার গভর্ণর জেনারেল ম্যারি সিমন এবং প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রæডো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর অন্তোস্টিক্রিয়ায় অংশ নিবেন।