অনলাইন ডেস্ক : বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরী কানাডার মাটিতে সমাহিত হলেন। গত ৫ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার রাত তিনটায় তিনি টরন্টোর অশোয়ার লেক রিজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরের দিন শুক্রবার বাদ জুম্মা কবির নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় টরন্টোর নাগেট মসজিদে। জানাযার পর কবির মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর জন্য মসজিদের অভ্যন্তরে আধা ঘন্টা রাখা হয়। পরে সেই দিন বিকেলে কবির মরদেহ পিকারিং ডাফিন মেডোজে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
কবি আসাদ চৌধুরীর মৃত্যুতে টরন্টোর বাঙালিদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রায় এক দশক এই শহরে বসবাস করা আসাদ চৌধুরী সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের কাছে খুবই প্রিয় এক মানুষ ছিলেন। টরন্টোর বাংলাদেশীদের যে কোন অনুষ্ঠানে তিনি হাসি মুখে হাজির হতেন এবং তাঁর উপস্থিতি সবাইকে ভালো কাজে উদ্দীপ্ত করতো। তাঁর কথা সবার কাছে এক পরম অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করতো। টরন্টোর সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে তিনি ছিলেন প্রধানতম অভিভাবক। তাঁর প্রাণ খোলা হাসি, সবাইকে নিমিষেই আপন করে নেবার ক্ষমতা, মানবিকতা এবং অসাধারণ কথা বলার ক্ষমতা সব সময় তাঁকে আপামর জনসাধারণের কাছে শ্রদ্ধার আসনে রাখবে।
আসাদ চৌধুরী ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আবৃত্তিকার। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি তিনি। সাহিত্যে তিনি ছিলেন গণমুখী, নান্দনিক ও রোমান্টিক। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলার লোকায়ত জীবন সবই তাঁর লেখায় তিনি স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের কবি আসাদ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র কাব্য ভাষা তৈরি করে নিজস্বতা অর্জন করেছেন। শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত। তিনি কালের সীমা অতিক্রম করে হয়েছেন কালোত্তীর্ণ। আসাদ চৌধুরীর সাহিত্য সম্ভার সব ধরনের মানুষের পছন্দ। প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পান’ এ পরিচিতি পান কবি আসাদ চৌধুরী।
কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছেন মানুষের মনে কবি আসাদ চৌধুরী। তাঁর বাচনভঙ্গি, টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও উপস্থাপনার জন্যও সর্বমহলে পরিচিত তিনি। মৌলিক কবিতা ছাড়াও তিনি শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ও অনুবাদ করেছেন। ১৯৮৩ সালে তাঁর রচিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া একই বছর তিনি সম্পাদনা করেন বঙ্গবন্ধুর জীবনী ভিত্তিক গ্রন্থ ‘সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু’। কবি আসাদ চৌধুরীর বাবা আরিফ চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন । বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সখ্যতা ছিল।
কবি আসাদ চৌধুরী ১৯৫৭ সালে আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি কলেজে অধ্যাপনার মধ্য চাকরি জীবন শুরু করেন। তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরে ঢাকায় থিতু হয়ে তিনি বিভিন্ন খবরের কাগজে সাংবদিকতা করেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি ‘ভয়েস অব জার্মানি’র বাংলাদেশ সংবাদ দাতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে যোগদান করে দীর্ঘকাল চাকরির পর প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে অবসর নেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হচ্ছে, ‘তবক দেওয়া পান’ (১৯৭৫), ‘বিত্ত নাই বেসাত নাই’ (১৯৭৬), ‘প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়’ (১৯৭৬), ‘জলের মধ্যে লেখাজোখা’ (১৯৮২), ‘যে পারে পারুক’ (১৯৮৩), ‘মধ্য মাঠ থেকে’ (১৯৮৪), ‘মেঘের জুলুম পাখির জুলুম’ (১৯৮৫), ‘আমার কবিতা’ (১৯৮৫), ‘ভালোবাসার কবিতা’ (১৯৮৫), ‘প্রেমের কবিতা’ (১৯৮৫), ‘দুঃখীরা গল্প করে’ (১৯৮৭), ‘নদীও বিবস্ত্র হয়’ (১৯৯২), ‘টান ভালোবাসার কবিতা’ (১৯৯৭), ‘বাতাস যেমন পরিচিত’ (১৯৯৮), ‘বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই’ (১৯৯৮), ‘কবিতা-সমগ্র’ (২০০২), ‘কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি’ (২০০৩), এবং ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’ (২০০৬)।
বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভ‚ষিত হয়েছেন কবি আসাদ চৌধুরী। তিনি আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫), অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭), অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০০৬), বঙ্গবন্ধু সম্মাননা ১৪১৮ ও একুশে পদকে (২০১৩) ভ‚ষিত হন।
কবির সাহিত্যকর্ম ইংরেজি, ফরাসী, জার্মান, হিন্দী, উর্দু, এবং মালায়লাম ভাষায় অনুদিত হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া তাঁর লিখিত গ্রন্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত এবং পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যুকালে কবি আসাদ চৌধুরী স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান। কবি পরিবারের সবাই বর্তমানে কানাডায় বসবাস করেন।
কবি আসাদ চৌধুরীর মৃত্যুতে কানাডার বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ কবির স্মরণে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ‘বাংলা কাগজ’ পরিবার কবির মৃত্যুতে গভীরভাবে শোক প্রকাশ করে।