তামীম রায়হান, কাতার : করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার কাতারে চলতি বছর বাংলাদেশ আসা কর্মীর সংখ্যা চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে আসা কর্মীর সংখ্যার তুলনায় এবার ৯০ ভাগ কমে গেছে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) কাতারে বাংলাদেশে কর্মী এসেছে মাত্র তিন হাজার ৫০৩ জন। অথচ গত বছরের এই সময়ে কাতারে এসেছিলেন ৩৬ হাজার ৭০ জন বাংলাদেশি কর্মী, যা গত বছরের তুলনায় মাত্র ৯.৭১ শতাংশ।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলের ছয়টি দেশ সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, বাহরাইন ও কুয়েত। এসব দেশের মধ্যে সৌদি আরব ও ওমানের পর কাতারে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি কর্মী আসে।
চলতি বছর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থান কমেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের ছয়টি দেশে চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে গেছেন মোট এক লাখ ৫৭ হাজার ৪৯৪ জন কর্মী। অথচ গত বছরের এই সময়ে এসব দেশে গেছেন দু লাখ ৩২ হাজার ৯০৭ জন কর্মী।
কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়ে করোনার প্রভাব পড়ছে, কাতারও এর বাইরে নয়। ফলে কর্মীসংখ্যা কমে আসাটা স্বাভাবিক। তবে কাতারে সাম্প্রতিক সময়ে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমেছে, এটি সত্য। বিপরীতে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা বাড়ছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘কাতারে বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশি দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে কাজ করছি আমরা। বিশেষত, বাংলাদেশ থেকে নার্স-ডাক্তার ও প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার লোকেরা যাতে কাতারে আসতে পারেন, সেটি আমাদের লক্ষ্য। পাশাপাশি আইটি ও মার্কেটিংসহ অন্যান্য খাতেও যেসব সম্ভাবনা রয়েছে, তা আমরা দেখছি।’
অন্যদিকে, এ বছর কাজের ভিসায় বাহরাইনে গেছেন মাত্র একজন বাংলাদেশি কর্মী। দেশটিতে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে কোনো কর্মী যাওয়ার সুযোগ পাননি। শুধু মার্চ মাসে স দেশে একজন কর্মী গেছেন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরোর প্রকাশিত অর্ধবার্ষিক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, অবশ্য সংখ্যার বিচারে চলতি বছরও সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। দেশটিতে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গেছেন এক লাখ ৩৩ হাজার ৯৯৭ জন। আরব আমিরাতে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে গেছেন ৮৫৩ জন, কুয়েতে গেছেন এক হাজার ৭৪৩ জন, ওমানে গেছেন ১৭ হাজার ৩৯৮ জন বাংলাদেশি কর্মী।
তবে এঁদের সবাই জানুয়ারি-মার্চ সময়ে এসব দেশে পৌঁছেছেন। এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো নতুন কর্মী উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে যেতে পারেননি।
কাতারে ২০২২ সালে অনুষ্ঠিতব্য ফুটবল বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলায় গত কয়েক বছরে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী কাতারে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে তিনটি স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ শেষ, বাকি আরও দুটি শেষের পথে। ফলে কাতারে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ব্যাপক হারে কমে আসছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনাসংকট। এই দুর্যোগে কাজ হারিয়েছেন অনেকে।
কাতার কর্তৃপক্ষ বলছে, কাতার থেকে অনেক শ্রমিকের দেশে ফেরার সঙ্গে করোনাকালীন সংকটের সম্পর্ক মুখ্য নয়। কারণ, করোনা না থাকলেও বিশ্বকাপের জন্য নির্মাণাধীন স্টেডিয়ামগুলোর কাজ শেষ হলে অনেক শ্রমিককে এই সময়ে চলে যেতে হতো এবং শ্রমিকের চাহিদা কমে আসত।
অবশ্য কাতারে করোনাকালে যারা চাকরি হারিয়েছেন, তাদের জন্য কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছে কাতার শ্রম মন্ত্রণালয় ও কাতার চেম্বার। ইতিমধ্যে কাতার চেম্বারের ওয়েবসাইটে একটি লিংক দেওয়া হয়েছে চাকরি হারানো কর্মীদের নিবন্ধনের জন্য। ফলে যেসব কোম্পানি বিদেশ থেকে নতুন কর্মীর জন্য ভিসার আবেদন করছে, তাদের কাতারে থাকা কর্মহীন কর্মীদের মধ্য থেকে লোক নিয়োগ দিতে বলা হচ্ছে।
বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে গত বছরের প্রথম ছয় মাসে গেছেন ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৪৭ বাংলাদেশি কর্মী। বাকি দেশগুলোর মধ্যে আরব আমিরাতে ১ হাজার ৬৫৮, কুয়েতে ৫ হাজার ১৪৩, বাহরাইনে সাতজন এবং ওমানে ৩৭ হাজার ৩৫২ জন কর্মী গেছেন।
আরব অঞ্চলের বাকি দেশগুলোর মধ্যে চলতি বছর লেবাননে গেছেন ৪৭৯ কর্মী। জর্ডানে গেছেন তিন হাজার ৬৮ এবং সুদানে দুজন।
বিগত ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কাতারে এসেছেন ৫০ হাজার ২৯২ বাংলাদেশি কর্মী। ওই বছর সৌদি আরবে গেছেন মোট তিন লাখ ৯৯ হাজার বাংলাদেশি। অন্য দেশগুলোর মধ্যে আরব আমিরাতে তিন হাজার ২১৮, কুয়েতে ১২ হাজার ২৯৮, ওমানে ৭২ হাজার ৬৫৪ কর্মী গেছেন।