সাজ্জাদ আলী : তা বছর পনেরো আগের কথা। বাসার ব্যাকইয়ার্ডে একটা গার্ডেন শেড বানাতে হবে। কাঠমিস্ত্রি খুঁজছি। এ দেশের কার্পেন্টাররা তো আবার প্রফেশনাল। রীতিমতো স্কুল কলেজে পড়াশুনা করে পেরেক ঠোকার লাইসেন্স নিতে হয়। আমাদের মহাদেব দাদু বা অনাথ কাকুর মতো হাতুড়ে না এরা। ফোনের ডাইরেক্টরি ঘেটে এক মিস্ত্রির নম্বরে ফোন করলাম। মহিলা কন্ঠস্বর। আমার প্রয়োজনটা বললাম তাকে। সে বলল, আমার নাম জ্যাকুলিন। আমি তোমার শেড বানিয়ে দিতে পারবো। কাজটা কবে নাগাদ শুরু করতে চাও?
তুমি কি কার্পেন্টার যে শেড বানাবে, আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তাকে।

ইয়েস, কার্পেন্টার উইথ ফোর ইয়ার্স এক্সপেরিয়েন্স। আমি লাইসেন্সড এবং ফুল কাভারেজ ইন্সুরেন্স আছে।
জ্যাকুলিন, তুমি শিওর যে আমার কাজটা করতে পারবে?

দেখ, আমি হোম বিল্ডারদের সাথে কাজ করি। মিলিয়ন ডলারের বাড়িঘরের কাঠের স্ট্রাকচার তৈরি করি। আমার স্কিল নিয়ে ভেবো না প্লিজ। আই উইল ডু অ্যা গুড জব ফর ইউ।
তুমি কিছু মনে করো না জ্যাকুলিন। আমি কখনও নারী কার্পেন্টার দেখিনি তো, তাই এমনটা বলেছি। আচ্ছা বলতো কাজটা করতে তুমি কত ডলার নেবে?

সেটা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। আগে তোমার ব্যাকইয়ার্ডটা আমি দেখতে চাই। কাল সকাল সাড়ে নয়টায় আসতে পারি। তুমি কি তখন বাড়িতে থাকবে?

বড়সড় সাইজের একখানা কনষ্ট্রাকশন ভ্যান চালিয়ে জ্যাকুলিন এলো। ২৫/২৬ বছরের সাদা চামড়ার যুবতী। তাকে সুন্দরী বলতে কারোর মনে দ্বিধা আসার কথা না। পরনে হাফ প্যান্ট, গায়ে টি-শার্ট। ধুলোবালি থেকে রক্ষার জন্য প্রমাণ সাইজের এপ্রোন পরেছে। হাত পায়ের মাংসপেশীগুলো শক্তপোক্ত। ঠিক নারী সদৃশ তুলতুলে না। কাঠমিস্ত্রির সাথে মানানসই। বিশেষভাবে তৈরি একটি ¯িøপিং ব্যাগে ভরে দুতিন মাসের একটি শিশুকে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছে। মায়ের পিঠে শিশুটি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। এতদিন জানা ছিল যে শিশুরা মায়ের কোলে ঘুমায়। আজ দেখলাম পিঠে ঘুমাতেও তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। জ্যাকুলিনকে দেখার পরে মনে হলো যে এই নারী কাঠমিস্ত্রি হবার যোগ্যতা রাখে।

সেই থেকে জ্যাকুলিনকে চিনি। আমার কাষ্টমারদের যার যখন কাঠের কাজ করানোর দরকার পড়ে, জ্যাকি তা করে দেয়। বিগত বছরগুলোতে তাকে লক্ষ ডলারের ওপরে ব্যবসা পাইয়ে দিয়েছি। আমার প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। প্রায়ই কার্টেসি ফোন কল করে। বছরে অন্তত একবার ডিনার খাওয়ায়। বুঝেসুঝেই সেই ঘুষটা খাই। তার সঙ্গ আমি উপভোগ করি। জ্যাকি একজন লড়াকু মানুষ। ওর সাথে সময় কাটিয়ে নিজে লড়তে শিখি। সেই প্রথম দিন থেকেই তাকে আমার নারী মনে হয়নি, বরং একজন মানুষ বলেই মনে হয়েছে।

জ্যাকুলিনের আরো কথা বলবো। তবে তার আগে আমাদের চারপাশের কথা একটু বলেনি। সেই শৈশব থেকে পরিচিত গণ্ডির প্রায় সব নারীকেই পরগাছা হিসেবে দেখছি। তাদের মধ্যে অনেকেই বেশ হৃষ্টপুষ্ট। কিন্তু সে পুষ্টি কোনো না কোনোভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল। দাদার ধনে দাদী দাপট দেখায়। চাচার মনোযোগ পেতে চাচি ব্যস্ত। বোন তার জামাইয়ের ওপরে ভর করে আছে, বৌ আমার ওপরে। এ কথা সত্য যে সমাজের কলকাঠি নারীর পক্ষে না। আবার জ্যাকুলিনের মতো শক্ত সমর্থ নারীর যে বড়ই অভাব, সে কথাও তো মিথ্যা না। কেউ আঁটি বেঁধে জ্যাকুলিনের বাড়িতে “সাফল্য” পৌঁছে দেয়নি! সেটা তার পরিশ্রমের অর্জন। হতে পারে সে একজন কাঠমিস্ত্রি, কিন্তু পরগাছা না। তার পেশীবহুল হাত পুরুষতন্ত্রের কাঁধ খামচে ধরেছে।

আজকাল প্রায়ই দেখি আমাদের বোনেরা অনেকেই নারীর অধিকারের কথা বলেন। নানাজনের নানা ভাষা। কেউ মার্জিত, কেউ-বা উগ্র। তবে মোটা দাগে বলা যায় যে তারা পুরুষতন্ত্রের কাছে তাদের অধিকার ফেরত চায়। শত সহস্র বছরের পরিশ্রমে (বা অপচেষ্টায়) পুরুষ সামাজিক প্রাধান্য কব্জা করেছে। কারো চোখ রাঙানিতে তা হাতছাড়া করবে কেন? আমার মনে হয় “নারী অধিকার” ব্যাপারটা “কেউ দেবে কেউ নেবে”, তা না। জগত সংসারের দিকে তাকিয়ে দেখুন। যে নারী যতটা যোগ্য, ততটা অধিকার তার পায়ের কাছে লুটোপুটি খায়। আর অযোগ্যরা চিল্লাপাল্লা করে।

বোনেরা অনেকেই পুরুষদের তুলোধুনা করে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। বোনগো, সমাজের সব পুরুষই তো নারী বিদ্বেষী না। ভুলে যান কেন ওই পুরুষরাই আপনার বাবা, ছেলে, চাচা, মামা প্রমুখ। আর তাছাড়া নারী স্বাধীনতার ব্যপারটাতো রাজনৈতিক না যে বিদ্রোহ করে তা পাওয়া যেতে পারে। এতো একান্তই আত্মস্বাধীনতা। আপনার আত্মার স্বাধীনতা তো আপনাকেই খাটুনি করে পেতে হবে। বোনদের বলি কী, পুরুষ বিরোধিতায় সময় ব্যয় না করে বরং নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলুন। সেটাই মুক্তির পথ। প্রতিটা ঘরে যদি একজন করে “জ্যাকুলিন” তৈরি করা যায়, তাহলেই কাজ শেষ। পুরুষতন্ত্র পালাবার পথ খুঁজে পাবে না। তবে কী জানেন চেঁচামেচি করে “জ্যাকুলিন” হওয়া যায় না। ওটা পরিশ্রম করে হতে হয়।

ফিরে যাই জ্যাকির কথায়। বছর দেড়েক আগে শেষ তার সাথে ডিনারে বসেছিলাম। সে তার তিন মেয়েকে সাথে এনেছিলো। ১৫ বছর আগে যেটাকে পিঠে বেঁধে আমার বাসায় এসেছিলো, সেটা এখন নবম গ্রেডে পড়ে। পরেরটা সেভেন্থ গ্রেডে, আর গ্যাদাটা বছরখানেকের। রেস্টুরেন্টের টেবিলে বসতে বসতে বললাম, জ্যাকি আমার খাওয়ার বিলটা তুমি দিয়ো। কিন্তু তোমাদের বিলটা আমি দিতে চাই। না কোরো না প্লিজ!
মৃদু হেসে সে সম্মতি দিল।

খেতে খেতে জ্যাকুলিন ওর ব্যবসা এক্সপান্ড করার কথা বলছিল। কম্পানিতে আরো চারজন কার্পেন্টার হায়ার করেছে। একসাথে দুটো প্রজেক্টে কাজ চলছে। কথায় কথায় বললাম, মেয়েদের বাবাকে সঙ্গে আনলে না কেন?
হেসে বলে, তা সম্ভব না। তারা সবাই নিজেদের সেটআপে থাকে।

“তারা সবাই” মানেটা কী? মেয়েদের ক’জন বাবা? বোকার মতো চেয়ে আছি জ্যাকির দিকে। আমার বেগতিক অবস্থা দেখে সে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল, ওদের বাবাদের কাউকেই আমি বিয়ে করিনি। বড়টার বাবা নিউইয়র্কে মুভ করেছে প্রায় চৌদ্দ বছর হলো। আমার সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। মেজটার বাবা টরন্টোতেই থাকে। মাঝেমাঝে মেয়েকে দেখতে আসে। আর ছোটটার বাবা এখন আমার বয়ফ্রেন্ড। সে অটোয়াতে একটা কলেজের ম্যাথ টিচার। মাসের শেষ উইকএন্ডে টরন্টোতে আসে।
ও, তাই বলো। তোমার লাইফ অ্যারেঞ্জমেন্ট তো দেখছি ইউনিক। তা ওদের বাবারা নিশ্চয়ই মেয়েদের খোঁজখবর রাখে, ঢোক গিলে বললাম আমি।
খোঁজখবর বলতে কী বুঝাচ্ছ, প্রশ্ন করল জ্যাকি।

এই মানে ওদের লেখাপড়া, ফুড, পোষাক আষাক, বেবি সিটিং ইত্যাদি খরচের কথা বলছিলাম।
আরে না, ওদের থেকে খরচ নেব কেন? মেয়ে আমার, দায়িত্বও আমার। কারো উপরে ভরসা করে তো আমি সন্তান ধারণ করিনি! আমি তো এক্সিডেন্টলি প্রেগনেন্ট হইনি। ভেবেচিন্তে কাজগুলো করেছি। ওদের সবার বাবাকে আমি ভালোবাসি। সচেতনভাবেই প্রত্যেকের সাথে একটা করে সন্তান নিয়েছি। এই মেয়েরা আমার প্রতিটি প্রেমের চিহ্ন!

আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম জ্যাকুলিনের দিকে। ভালোবেসেছে কিন্তু বিয়ে করেনি! সানন্দে সন্তানদের দায়িত্ব নিয়েছে। ভরণপোষণের জন্য ধর্ণা দেয়নি কারো কাছে! মানতেই হবে যে জ্যাকির লাইফ স্টাইলের মধ্যে অদ্ভুত রকমের একটা সাহস আছে। আর চিহ্ন (!) রেখে প্রেম করে সে! ভেতরে ভেতরে কৌতূহল বাড়ল। বললাম, কিছু মনে কোরো না জ্যাকি, বয়ফ্রেন্ডদের এত যে ভালোবেসেছো, কাউকে কখনও বিয়ে করতে মন টানেনি?

খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলে, আমাদের সোসাইটি এখনও প্রেম আর বিয়েকে একটা প্যাকেজ মনে করে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখ, বিয়ের সাথে সাথেই সব প্রেমিক যুগলের প্রেম শেষ। আমি আমার প্রেমগুলোকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রাখতে চাই। তাইতো প্রেমিকেরা আগ্রহ দেখালেও আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসিনি।

জ্যাকুলিনের এহেন জীবন দর্শন অনেকেরই পছন্দ হবে না। কারণ সে সমাজ প্রথার বিপরীতে হাঁটছে। উল্টো পথে হাঁটলেই যে আহামরি কিছু করা হলো, তা বলছি না। তবে নিয়মের বিরুদ্ধে চলতে সামর্থ্য লাগে। স্রোতের অনুকূলে তো কচুরিপানাও ভাসে! জ্যাকির যে সাহস আছে, এ কথা মানতে হবে।

তোমাকে আরো একটা কথা বলি, জ্যাকি আবার বলা শুরু করল, দেখ আমাদের সমাজে নারীরা এখনও ফাইনান্সিয়াল এন্ড স্যোসাল সিকিউরিটির জন্য বিয়ে করে। বিবাহিত পুরুষ স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। আমি বুঝতে পারি প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় নারীদের এই বিয়ে-সুরক্ষার প্রয়োজন আছে। কিন্তু অনেক খাটুনি করে নিজেকে নিরাপদ করেছি। আমি কেন বিয়ে করতে যাবো বলতো?

কিন্তু বিয়ে করলে তোমার তো গোছানো একটা সংসার হতো, মুখ ফসকে কথাটি বেরিয়ে গেল।
বিরক্ত হয়ে জ্যাকি বলে, এটা তোমার পুরুষতান্ত্রিক দুর্বল চিন্তা! কীভাবে বুঝলে যে আমার সংসার অগোছালো? শোন বন্ধু, চমত্কার সাজানো একটি সংসার আছে আমার। সন্তানদের ভবিষ্যত বিনির্মাণের অর্থনৈতিক ভিতও তৈরি করে রেখেছি। তোমরা কজন এমনটা পেরেছ বলো তো? আর তা সম্ভব হয়েছে কাউকে হাসবেন্ড বানাইনি বলেই।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)