সাজ্জাদ আলী : জন্মাবধি আমরা যে মৃত্যুর অপেক্ষায় আছি, সে সত্য কে না জানি? তবে কথা হলো ক’জনে তা মানতে পারি? মৃত্যু যখন দুরাক্রান্ত তখন তা খবর; আর নিকটাগত হলেই সে হয়ে উঠে বেদনা! চীনারা যখন করোনায় আক্রান্ত হলো, ভাবলাম ওটা দুরান্তরের সমস্যা, এ নিয়ে আমার না ভাবলেও চলবে। ক’দিন বাদেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়লো ইউরোপ এবং আমেরিকায়। স্বার্থান্বেষী মন এবার নড়েচড়ে বসলো; কারণ ওসব দেশে স্বজন, আত্মীয়, বন্ধুরা অনেকেই থাকেন। কিন্তু ব্যাক্কেল মনটি তখনও এমনটাই বিশ্বাস করতে চায় যে, রোগটি পরের উপর দিয়েই যাবে; আপনারজনদের কিছুই হবে না। ও মা আরো ক’দিন বাদেই শুনি আমার শহর টরন্টো, এমনকি বাংলাদেশও আক্রান্ত! খানিকটা “আক্কেল” যেন ফিরলো এবারে। ভেবেছিলাম দূরাগতরা আগুনে পুড়লেও, আমরা স্বজনেরা শুধুই সেঁক্ নিতে থাকবো। তবে তা বোধ হয় এবারটায় আর হচ্ছে না।
ফোনের টুংটাং শব্দে দিনে দুচারবার অনুজপ্রতীম সজীবের পাঠানো টেক্সট মেসেজগুলো পাই। কুশল জিজ্ঞাসা, যৌথ কাজের কথা, কখনও বা কোন খবর/গানের লিংক ইত্যাদি ধরণের টুকরো বার্তাই সজীবের থেকে আসে। ওর সেদিনের বার্তাটি মহাব্যতিক্রমী, মর্মান্তিক এবং আমার জন্য অবিশ্বাস্য রকমের বেদনাবিধুর! শরীফ আব্দুস সালাম, টরন্টো’র সজ্জন, সুহূদ মানুষটি করোনার ছোবলে চির বিদায় নিয়েছেন। শরীফ সাহেবের ¯েœহ পেয়েছি, তাঁর অভিভাবকত্বও অজান্তেই মেনে নিয়েছিলাম। এ দুঃসংবাদে স্তব্ধ আমি, যেন নিথর হয়ে পড়েছি, বাকরুদ্ধ আমার! তাঁর সাথে আমার সম্পর্কের একটা পরম্পরা আছে। কিন্তু সে বিবরণী আমার জানা ছিলো না। জানলাম, তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিনটিতে। আর সেই থেকেই শরীফ সাহেব অনায়াসেই “সালাম ভাই” বনে গেলেন।
সে ২০০৭ সালের গ্রীস্মকালের কথা, আমি তখন বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র অন্যতম একজন স্বেচ্ছাকর্মী। আমাদের ব্রডকাস্ট পার্টনার রজার্স মিডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্যাক রস সে সময়ে মাল্টিলিঙ্গুয়াল প্রডাকশনগুলো দেখভাল করতেন। হঠাৎ করেই জ্যাক নির্দেশনা পাঠালেন যে, প্রত্যেক ভাষার অনুষ্ঠানের জন্য ট্রাফিক আইনের উপর জনসচেতনামূলক ২০ মিনিটের একটি টেলিভিশন প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। সে তো বলে খালাস! কিন্তু আমি তো মহা ঝামেলায়! ট্রাফিক আইনের উপরে বাংলা ভাষায় বয়ান করার লোক পাই কোথায়? পরিচিত দু একজন ব্যারিস্টারের সাথে যোগাযোগ করে নিরাশ হলাম। তাঁরা ট্রাফিক আইনের উপর প্রাকটিস করেন না। আমার এহেন বেগতিক অবস্থার “গতি” করে দিলেন সাপ্তাহিক বাংলা কাগজের প্রকাশক এম. আর. জাহাঙ্গীর সাহেব। ফোন নম্বরটি লিখে দিয়ে বললেন, সালাম শরীফ নিখাদ ভদ্রলোক, তাঁর সাথে কাজ করতে আপনার সুবিধাই হবে।
শুধু সেই কাজটি কেন? তারপর থেকে সালাম ভাইয়ের সাথে আরো অনেক কাজের সুবিধাই লুটে নিয়েছি। ওই টিভি অনুষ্ঠানটির রেকর্ডিংয়ের দিনে স্টুডিওতে তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাতের ক্ষণটি মনের পাতায় আজও গেঁথে আছে। অনুষ্ঠান ধারণের শুরুতে আমি স্ক্রীপ্টটা তাঁকে বুঝিয়ে বলছিলাম। এক ফাঁকে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাংলাদেশের কোথায় বাড়ী আপনার? বললাম গোপালগঞ্জ, শুনেই খুশিতে যেন নেচে উঠলেন! আরে বলেন কি সাজ্জাদ, আমার বাড়ীওতো গোপালগঞ্জ। এদিকে আমি স্ক্রীপ্ট পড়েই যাচ্ছি, কিন্তু তাঁর তো শোনায় মন নেই! গোপালগঞ্জের কোন গাঁয়ে বাড়ী আমার, কার ছেলে আমি, কতদিন থেকে আছি টরন্টোতে, ইত্যাদি একগাদা প্রশ্ন এক সাথে ছুঁড়ে দিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন? বাড়ী আর আব্বার নাম বলতেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন।
তাঁর সেদিনকার সেই হাতের পরশন আমার ¯œায়ুর রন্ধ্রে প্রবেশ করেছিলো। বহুদিন পরে আমি যেন কারো অভিভাবকত্বের ছোঁয়া অনুভব করেছিলাম! ঘটনার আকস্মিকতায় সেদিন আমি ছিলাম আচ্ছন্ন, আর তিনি আপ্লুত! একটু ধাতস্থ হয়ে আমাকে বাহুবন্ধন থেকে ছেড়ে দিয়ে নিজ আসনে বসতে বসতে বললেন, তোমার আব্বা যখন আমাদের মহাকুমায় আওয়ামী লীগের একজন নেতৃস্থানীয়, আমি তখন গোপালগঞ্জ কায়েদে আজম কলেজের (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কলেজ নামকরণ হয়) ছাত্রলীগের শীর্ষ কর্মী।
তুমি আমার রাজনৈতিক অগ্রজের ছেলে। কি যে ভাল লাগছে তোমার দেখা পেয়ে, কেমনে তা বোঝাই বলোতো! কি জান, তোমার আব্বা প্রতি সপ্তাহেই নানা কাজে গোপালগঞ্জ শহরে আসতেন। গ্রীন হোটেলের দোতলার ব্যালকনিওয়ালা কোণার কক্ষটি তাঁর অস্থায়ী আবাস ছিলো। উনি শহরে থাকলে ছাত্রলীগের ছেলেদের সাথে সকালের নাস্তা খেতেন। আর ওই ক’দিন আমাদের বিড়িসিগারেটের টাকা নিয়েও কোন চিন্তা করতে হতো না। সাজ্জাদ তুমি কিনা তাঁরই ছেলে! চোখ বন্ধ রেখে সেদিন স্মৃতিচারণ করেছিলেন সালাম ভাই।
নানা কারণেই মানুষটিকে আমার পছন্দ হতো। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন এবং প্রকৃত অর্থেই সেই যুদ্ধের কার্যকারণ তিনি বুঝতেন। আর সেরূপ রাজনৈতিক চেতনাও অন্তরে পোষণ করতেন। “হাম বড়োমিয়া” ভাবটি একেবারেই ছিলোনা তাঁর। তিনি ছিলেন ইংরেজীতে যাকে বলে “ডাউন টু দ্যা আর্থ”। বই পড়ার ভারী আগ্রহ ছিলো। কিছু একটা পড়ে যদি মনে করতেন যে সেটা আমারও জানা উচিৎ, তবে ফোন করে বলতেন; একখানা বই রেখেছি তোমার জন্য, এদিকে এলে নিয়ে যেও। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের সমচিন্তার রাজনৈতিক দলটি গত দশক জুড়ে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন। কিন্তু সেই দলীয় সরকারের কোন অপকীর্তিকে তিনি কখনওই অন্ধ সমর্থন দেননি। আর সেজন্যেই বোধকরি সারাটা জীবন আওয়ামী লীগ করেও তথাকথিত আওয়ামী শিবিরের “গুডবুকে” থাকতে পারেনি কখনও।
জীবের জন্মক্ষণেই তার মৃত্যুও নির্ধারণ হয়ে যায়। এটা অনিবার্য সত্য। সে সত্য পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা মানবের সাধ্য নয়। কিন্তু স্বজনদের মৃত্যু-সত্যে আমরা সহমর্মী তো হতেই পারি। মনস্তাপের বিষয় হলো এই করোনা ভাইরাসের তান্ডবে আমরা শরীফ সাহেবের শেষ সময়ে তাঁর প্রতি সমানুভবীও হতে পারিনি। আক্রান্ত হয়ে তিনি দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু তাঁর রোগটি এমনই ক্রূরমতি যে তাঁর শয্যাপার্শ্বে কারো যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। করোনা’র ভয়াল উপস্থিতির জন্য সম্ভব হয়নি তাঁর শেষকৃত্যে স্বতঃস্ফুর্ত যোগদানের। গৃহবন্দি তাঁর পরিবার, বন্ধুজন, স্বজনদের অন্তরাত্মায় কেবল বেদনার সুরটিই বেঁজেছে। সেদিন অতি নিভৃতে মুক্তিযোদ্ধা শরীফ সালামের কফিনটি বাংলাদেশের গর্বিত জাতীয় পতাকায় আবৃত হয়ে টরন্টো’র মাটিতে সমাহিত হয়েছে।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)