সেরীন ফেরদৌস : গত এক বছরে কভিড-১৯-এর ভাইরাস যেমন বারবার নিজেদের পরিবর্তন ঘটিয়ে নানা ধরনের রূপ নিয়েছে, এর সংক্রমণ প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষকরাও নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত হাজির করেছেন। এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। যেগুলো যুক্তিযুক্ত সেগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ স¤প্রতি প্রকাশিত একটি তথ্য নিয়েও নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে এবারের আলোচনায় তর্ক-বিতর্কের চেয়ে আতঙ্ক বেশি ছড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
কানাডা, আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্যের কয়েকজন বিজ্ঞানী তাদের যৌথ গবেষণায় দাবি করেছেন, মানুষ যখন কথা বলে, নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বা কাশি দেয় তখন তার সঙ্গে যে ক্ষুদ্র ‘এয়ারবর্ন পার্টিকলস’ বেরোয় তার মাধ্যমে করোনার বিস্তারের যথেষ্ট প্রমাণ তারা পেয়েছেন। তাদের এই গবেষণাটি ল্যানসেটে প্রকাশিত হওয়ার পর তার ভাষান্তরিত বার্তায় ‘করোনাভাইরাস বাতাসে ছড়ায়’ এমন একটি কথা প্রচার পেয়েছে। আর ‘বাতাসে ছড়ায়’ এই বক্তব্যটিই সাধারণভাবে মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন তাহলে করোনাভাইরাস কি বাতাসে ভাসতে ভাসতে মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে? ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত গবেষণায়ও কিন্তু সেই রকম কোনো কথা বলা হয়নি। বরং বলা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাব্য যেসব উপায়ের কথা অনেক আগেই বলে রেখেছে তার একটিকেই তারা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে মাত্র।
করোনার সংক্রমণ কীভাবে ছড়ায় এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যের মধ্যে এ তথ্যটিও রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ‘Aerosol transmission can occur in specific settings, particularly in indoor, crowded and inadequately ventilated spaces, where infected person(s) spend long periods of time with others, such as restaurants, choir practices, fitness classes, nightclubs, offices and/or places of worship. More studies are underway to better understand the conditions in which aerosol transmission is occurring outside of medical facilities where specific medical procedures, called aerosol generating procedures, are conducted.’ ল্যানসেটের গবেষণায় ঠিক এ কথাগুলোই আরও বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে।
বায়ু চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা বদ্ধঘরে ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি যদি অন্যের সঙ্গে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে তাহলে সেখানে ‘অ্যারোসোল সংক্রমণ’ ঘটতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ তালিকায় রেস্তোরাঁ, ফিটনেস ক্লাব, নাইট ক্লাব, প্রার্থনার স্থানকেও রেখেছে।
‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত গবেষণাটিতে ক্রুজ জাহাজ, কসাইখানা, সংশোধনী কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ, চার্চসহ বদ্ধ ঘরে প্রচলিত ধারণার চেয়ে বেশি দূরত্বে ভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনার উল্লেখ করে দাবি করেছে, বাতাসের মাধ্যমে (এয়ারবর্ন) এসব স্থানে সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে তারা প্রমাণ পেয়েছেন।
ল্যানসেটের নিবন্ধে যে জায়গাগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার সবকটিই মূলত জনবহুল স্থান। অর্থাৎ এ জায়গাগুলোতে স্বল্প স্থানে অনেক মানুষ একই সময়ে অবস্থান করে। কোয়ারেন্টাইনের জন্য নির্ধারিত হোটেলে পাশাপাশি রুমে অবস্থানের পরও সংক্রমণের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে এ গবেষণায়।
গবেষণাটি আসলে বেশকিছু অবস্থাকে (সিচুয়েশন) অবলম্বন করে সেসব জায়গায় পাওয়া তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। অন্য বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে একটি উপসংহারে যাতে পৌঁছতে পারেন সেজন্যই এ তথ্যগুলোর উপস্থাপন। মূলত ড্রপলেট আর এয়ারবর্ন এ দুই শব্দের তত্ত¡গত পার্থক্য নিয়েই চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে বেশি।
এ প্রসঙ্গে বোস্টনের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বাংলাদেশি আমেরিকান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ড. রুহুল আবিদ পরিষ্কারভাবে বলেছেন, করোনাভাইরাসকে যে বাতাসবাহিত বলা হচ্ছে, তার মানে এই নয় যে ভাইরাসটি একা একা বাতাসে ভেসে ভেসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে কাউকে আক্রান্ত করে ফেলছে! এ গবেষণায় যে ‘বাতাসবাহিত’ বলা হচ্ছে সেটি আসলে ভাইরাসটি বদ্ধপরিবেশে বাতাসে বেশকিছু সময়, প্রায় তিন ঘণ্টা থাকতে পারে। সেই সময় ওই ঘরে থাকা বা আসা অন্য কেউ সংক্রমণের শিকার হতে পারেন।
টরন্টোর বহুজাতিক একটি কোম্পানিতে কর্মরত বাংলাদেশি কানাডিয়ান অণুজীববিজ্ঞানী নিবেদিতা বিশ্বাস কভিডের প্রথম সময়কার নানা গুঞ্জনের কথা তুলে ধরে বলেন, প্রথম দিকে মানুষ মনে করত বাতাসে এটি ভেসে আসে এবং অনেকেই দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখত। অথচ ক্রস ভ্যান্টিলেশনের সুযোগ থাকলে বরং ভাইরাস কম সময় সেখানে থাকতে পারে এবং মানুষের সংক্রমণের আশঙ্কা কমে যায়।
ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণাটির মূল আলোচনার জায়গাটি আসলে করোনার সংক্রমণরোধে ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের তাগিদ। যদি শুধু ‘ড্রপলেট’-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, অর্থাৎ সরাসরি হাঁচি-কাশি এবং দুই মিটারের দূরত্ব বজায় রাখাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত হওয়া যাবে না। ভাইরাসটি যে বাতাসেও কিছুক্ষণ থাকে বা থাকতে পারে, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। আক্রান্ত বা ভাইরাস বহন করা কোনো ব্যক্তি একটি বদ্ধপরিবেশে কথা বললে, গান গাইলে ভাইরাসটি বাতাসে কিছুক্ষণ থাকবে। ফলে সেই বাতাস নিঃশ্বাসে নিয়ে অন্য কেউ আক্রান্ত হতে পারবে এ বিষয়টি মাথায় রাখার তাগিদই দিচ্ছে এ গবেষণা।
করোনা নিয়ে ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত গবেষণাটি তথ্য হিসেবে সেই অর্থে নতুন নয়, বরং স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার প্রয়োজনীয়তাকেই নতুনভাবে মনে করিয়ে দিয়েছে। বেশি লোকের সমাগম আছে এমন বদ্ধঘরে, অন্য লোকের কাছ থেকে দুই মিটার দূরত্বে থাকা সম্ভব হচ্ছে না এমনসব জায়গায় মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তাটাই নতুন করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। কাজেই আতঙ্ক নয়, স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারেই সবার উদ্যোগী হওয়া দরকার।
লেখক কানাডায় কর্মরত নার্স ও প্রবাসী সাংবাদিক