শুভ্র দেব : করোনা আক্রান্ত হয়ে বাসায় মৃত্যু বাড়ছে। প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী বাসায় মারা যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১০ই জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মোট ৪০৫ জন। যার মধ্যে ২৭৩ জন মারা যান হাসপাতালে আর ১৩২ জনের মৃত্যু হয় বাড়িতে। শুরুর দিকে বাসার মৃত্যুর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথ্য প্রকাশ না করলেও সম্প্রতি এ সংখ্যা জানানো হচ্ছে নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ও সংক্রমণ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাসায় যারা মারা যাচ্ছেন তারা হয় হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন না। আর না হয় হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যাবে না এমনটা ভেবে বাসায় থেকেই চিকিৎসা দেন। এছাড়া সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে হয়তো কেউ কেউ আক্রান্ত হওয়ার তথ্য গোপন করে বাসায় থাকছেন।
স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সক্রিয় করে তুলতে হবে। সেবার মান বাড়াতে হবে এবং সেবা জনসহায়ক হবে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশপাশি বাসায় থেকেও যেসকল রোগী চিকিৎসা নিবেন তাদেরকে চিকিৎসকরে ফলোআপে রাখতে হবে। যাতে করে আরো বেশি জীবন রক্ষা করা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১০ই জুন সারা দেশে ৩৭ জন করোনা আক্রান্ত মারা যান। এর মধ্যে হাসপাতালে ২৫ জন ও বাড়িতে ১২ জন। ১১ই জুন ৩৭ জন মৃত ব্যক্তির ২৮ জন হাসপাতালে ও বাড়িতে ৯ জন মারা যান। ১২ই জুন ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৩২ জন হাসপাতালে ও ১৪ জন বাড়িতে মারা যান। ১৩ই জুন মৃত্যুবরণ করেছেন ৪৪ জন। যার মধ্যে ২৭ জন হাসপাতালে ও ১৪ জন বাড়িতে মারা যান। ১৪ই জুন মৃত ৩২ জনের মধ্যে ২০ জন হাসপাতালে ও ১১জন বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। ১৫ই জুন মৃত ৩৮ জনের মধ্যে ২৫ জন হাসপাতালে ১১ জন বাড়িতে মারা যান। ১৬ই জুন সর্বোচ্চ ৫৩ জনের মৃত্যু হয়, এর মধ্যে ৩৪ জন হাসপাতালে ও ১৮ জন বাড়িতে মারা যান। ১৭ ই জুন মৃত্যুবরণ করেছেন ৪৩জন। এর মধ্যে ২৭ জন বাড়িতে ও হাসপাতালে ১৫ জন মারা যান। আর ১৮ই জুন ৩৮ মৃত ব্যক্তির ২৪ জন হাসপাতালে ও বাড়িতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, ১৩ই জুন থেকে ১৭ই জুন পর্যন্ত ৫ দিনে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে ৮ ব্যক্তিকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজস্টি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা পরীক্ষার পর যদি পজিটিভ রেজাল্ট আসে তবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে আইসোলেশনে নিয়ে যেতে হবে। এবং যার পজিটিভ তার সংস্পর্শে যারা আসবে তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যেতে হবে। যাদের শরীরে শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য লক্ষণ থাকবে তাদেরকে অবশ্যই হাসপাতালে পাঠাতে হবে। যদি শারীরিক সমস্যা সামান্যতম থাকে তবেই সে বাসায় থাকবে। যারা বাসায় মারা যাচ্ছে তারা সঠিক চিকিৎসা না পেয়েই মারা যাচ্ছে। হয়তো তারা বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ভর্তি না পেয়ে বাধ্য হয়ে বাসায় অবস্থান করছে। বাড়িতে নানান জনের নানান পরামর্শে এটা ওটা খাওয়াতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সরকারের দুর্বলতা। কেন রোগীরা ভর্তি হতে পারছে না। প্রয়োজন হলে অবশ্যই তারা হাসপাতালে ভর্তি হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, করোনা রোগীর পাশাপাশি নন করোনা রোগীও বাড়ছে। যাদের অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না। ঠিকমত চিকিৎসা পাচ্ছেনা। তাই অনেকেই বাসায় মারা যাচ্ছে। নন করোনা রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি প্রসারিত করা না যায় তবে এমনটা হবে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতেই বেশি সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা হয়। কিন্তু এখন প্রাইভেট হাসপাতালে নন করোনা রোগীরাও সঠিক সেবা পাচ্ছে না। আরা করোনা রোগীরাও হাসপাতালে বেড পাচ্ছে না। আইসিইউ পাচ্ছে না। তাই অনেকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে সেবার পরিধি বাড়াতে হবে। যাতে করে লোকজন সহজেই চিকিৎসা পেতে পারে। পাশপাশি প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে অতি দ্রুত সক্রিয় করতে হবে। এবং আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা জনসহায়ক হতে হবে। উদাহরণ দিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, একজন অসুস্থ হলে তার কিছু খুঁজতে হবে না। বাড়িতে এম্বুলেন্স গিয়ে রোগী নিয়ে আসবে। এরকম যদি একটা মেকানিজম দাঁড় করানো যায় তাহলে লোকজন হাসপাতালমুখী হবে। বাড়িতে মৃত্যুর হার কমবে। এমনকি সামগ্রিক মৃত্যুর হারও কমবে।
বাসায় মৃত্যু কেন বাড়ছে এ নিয়ে জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, প্রথমত, কিছু রোগীরা হয়তো হাসপাতালে যেতে চায়নি বা যায়নি। তারা মনে করেছে বাসায় থাকলে ভালো হবে। তাদের হয়তো সেই সক্ষমতা ছিল। দ্বিতীয়ত, আরো কিছু রোগী হয়তো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেনি। ভর্তি হতে না পেরে হয়তো বাসায় ফেরত গেছে। তৃতীয়ত, যারা বাসায় ছিলেন তাদের শারীরিক অবস্থার হয়তো দ্রুত অবস্থার অবনতি হয়েছে। তাই দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেনি। যারা বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা বাসায় থাকলেও একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। না হলে তারা বুঝতে পারবেন না অবস্থার অবনতি হচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের করোনা আক্রান্ত বা নন করোনা সমস্ত রোগীদের দায়দায়িত্ব সরকারের। মহামারির সময় প্রত্যেকটা রোগী বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাখে। কেউ যদি হাসপাতালে না আসে তবে সরকারকে কোনো না কোনো চিকিৎসক/স্বাস্থ্যকর্মীকে তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিতে হবে। হাসপাতালে আসলে সরকার নিজেই দায়িত্ব পালন করবে। প্রথমদিকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত আইইডিসিআর করেছিলো। কিন্তু পরীক্ষার চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিদপ্তর পরীক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। সেটি ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছিলো। কিন্তু এখন আবার চাহিদা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, রোগীকে ফলোআপ করার জন্য চিকিৎসক ঠিক করে দেয়ার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ছিল তারা সেটি করেননি। তারা শুধু কারো সমস্যা হলে টেলিফোনে পরামর্শ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু একজন প্রান্তিক পর্যায়ের লোকের ক্ষেত্রে সেটি হয়ে উঠেনি। এখন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। তাই জেলায় হলে রোগীকে ফলোআপ করার জন্য সিভিল সার্জনের সঙ্গে উপজেলায় হলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে। তারা প্রতিনিয়ত রোগীদের ফলোআপ করবেন তাহলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যাবে। ইতোমধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের একটি অংশকে হয়তো বাঁচানো যেত। অন্যান্য করোনা আক্রান্ত দেশের তুলনায় আমাদের মৃত্যু কম। সেটাকে আরও কমিয়ে আনা সম্ভব। যদি আমরা সবাই আরও ভালোভাবে দায়িত্ব নেই।