মানাউবী সিংহ, সিলেট : দেশে ফিরে কিংবা প্রবাসে থেকে, কোথাও এবার ঈদ ভালো কাটেনি সিলেটের প্রবাসীদের। যাঁরা দেশে ফিরেছিলেন, তাঁদের ফিরতে হচ্ছে বাড়তি দামে বিমানের টিকিট কেটে। আবার টিকিট করার পর করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ হলে বাতিল করতে হচ্ছে সেই টিকিট। এত ঝামেলার মধ্যে কেটেছে তাঁদের ঈদ। আর যাঁরা প্রবাসে আছেন, সেখানে আয় কমে যাওয়ায় তাঁরাও তেমন টাকাপয়সা পাঠাতে পারনেনি। ফলে অনেক প্রবাসী পরিবারের সদস্যরাও স্বস্তিতে ঈদ করতে পারেননি।
স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দাদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট জেলায় অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে প্রবাসে রয়েছেন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, দুবাই, ব্রুনাই, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে তাঁরা রয়েছেন। এর ফলে এখানকার অর্থনৈতিক কাঠামোর অনেকটাই প্রবাসী আয়নির্ভর। দেশে থাকা অনেক পরিবারের সদস্যরাও প্রবাসীদের পাঠানো টাকা থেকেই জীবন যাপন করে থাকেন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা (রেমিট্যান্স) এসেছে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার ২১ দশমিক ৫৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত এসেছে ৫৯ হাজার ২৯৫ দশমিক ৭০ কোটি টাকা। তবে প্রতিবছর জেলাওয়ারি কত আসে, এ ধরনের কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে নেই। একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত প্রবাসীকল্যাণ সংস্থা বাংলাদেশ ওভারসিজ সেন্টার সিলেটের পদাধিকার বলে চেয়ারম্যান জেলা প্রশাসক। এ সংস্থাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ প্রবাসী রয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট রয়েছেন ৪৫ থেকে ৫০ লাখ। বাংলাদেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে, জেলাওয়ারি এর পরিসংখ্যান না থাকলেও এর বৃহৎ একটা অংশ সিলেট বিভাগের চার জেলার প্রবাসীরা পাঠান। তবে অন্যান্য বছর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনকে প্রবাসীরা টাকা পাঠালেও এবার সেটি অনেক কম ছিল।
সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় থাকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা ও সৌদিপ্রবাসীদের পরিবারের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের কারণে প্রবাসেও কাজ বন্ধ রয়েছে। সবাই ঘরবন্দী জীবন যাপন করছেন। তাই অধিকাংশ প্রবাসীই বিগত বছরগুলোর মতো কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে দেশে টাকা পাঠাতে পারেননি। এ অবস্থায় অনেক প্রবাসীর পরিবার এককভাবে কোরবানি দিতে পারেননি। অনেক প্রবাসীর পরিবার এবার যৌথভাবে অন্যদের সঙ্গে মিলে কোরবানি দিয়েছেন। অথচ তাঁরা প্রতিবছর এককভাবেই গরু কোরবানি দিতেন।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মাহিদুল আলম জানিয়েছেন, তাঁর দুই ভাই সৌদি আরবে থাকেন। করোনাকাল শুরু হওয়ার পর আয় বন্ধ হয়ে পড়ায় তাঁরা বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছেন না। তাই দেশে থাকা পরিবারের সদস্যরা বিপাকে পড়েছেন। টাকার অভাবে এবার এককভাবে কোরবানি দিতে পারেননি।
সিলেটের বিয়ানীবাজারের বাসিন্দা সালাউদ্দিন চৌধুরী সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছিলেন গত জানুয়ারি মাসে। কথা ছিল, তিন মাস পর ফের সৌদিতে ফিরবেন। বিমানের টিকিটও করে রেখেছিলেন। কিন্তু মার্চ মাস থেকে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির পর যাওয়া হয়নি। দেশেই কাটিয়েছেন দুই ঈদ। প্রবাসে যে টাকা আয় করেছেন, এত দিনে সেগুলো শেষ পর্যায়ে। প্রতিবছর ৭০ থেকে এক লাখ টাকা দামের গরু কিনে কোরবানি দিলেও এবার কয়েকজন মিলে কোরবানি করেছেন। এখন বিমানের টিকিটের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যাংকে কিছু জমানো টাকা ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে টিকিট করার চেষ্টা করছেন। টিকিট করার পর আবার করোনার পরীক্ষা করাতে হয়। পজিটিভ হলে সিলেটের বিয়ানীবাজারের সালাউদ্দিন চৌধুরীকে টিকিট বাতিল করতে হবে।
সালাউদ্দিনের মতো দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বাসিন্দা ফ্রান্সপ্রবাসী সাইদুল ইসলামকেও নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে দেশে আসেন। কথা ছিল দুই মাসের মধ্যে স্ত্রীকে নিয়ে ফ্রান্সে চলে যাবেন। কিন্তু করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির পর পাঁচ মাস দেশে অবস্থান করে গত শনিবার রাতে ফ্রান্সের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এর আগে কথা হয় প্রথম আলোর সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথম দফায় জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে প্রায় দুই লাখ টাকা দিয়ে বিমানের টিকিট করিয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী দুজনের করোনা পরীক্ষা করানো হয়। স্ত্রীর পজিটিভ ফল আসে। এতে টিকিট বাতিল করতে হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকার পর ফের প্রায় তিন লাখ টাকা দিয়ে ১ আগস্টের বিমানের টিকিট করানো হয়। পরে গত ২৯ জুলাই ঢাকায় গিয়ে প্রবাসীদের করোনা পরীক্ষাগারের নির্ধারিত নিয়মে পরীক্ষা করায় এতে ‘নেগেটিভ’ ফল আসে।
সাইদুল ইসলাম বলেন, দেশে দীর্ঘ দিন অবস্থান করার প্রস্তুতি ছিল না। করোনার কারণে প্রায় পাঁচ মাস দেশে অবস্থান করতে হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ঈদ কাটিয়েছেন। দেশে দীর্ঘ দিন অবস্থান করায় হাতে টাকাপয়সা ছিল না। এ জন্য ঈদ ভালো হয়নি। তিনি বলেন, ‘প্রায় দুই লাখ টাকার টিকিট বাতিলও করেছি। যা টাকা ছিল, প্রায় সবই শেষ। দ্বিতীয় টিকিট বাতিল করলে বেশ বেকায়দায় পড়তে হতো। টিকিট করার আগে প্রবাসীদের যদি করোনা পরীক্ষা করানোর সুযোগ থাকত, তাহলে পরীক্ষার করানোর পর নেগেটিভ ফল এলে সেদিন থেকে আইসোলেশনে থাকা যেত। সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন টিকিট কাটার পর অনেক প্রবাসীর পজিটিভ ফল আসছে। এতে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে।’
ফ্রান্সে অবস্থান করা সিলেটের কদমতলী এলাকার বাসিন্দা শাহনেওয়াজ হোসেন বলেন, ‘রোজার ঈদের আগে পুরো সময় এখানে লকডাউনে কাটাতে হয়েছে। সে সময় দেশে টাকা পাঠাতে পারিনি। এ সময় কাজকর্ম বন্ধ ছিল না। কোরবানির ঈদের কিছুদিন আগে কাজে যেতে শুরু করেছি। হাতে টাকাপয়সা তেমন ছিল না। এ জন্য কোরবানির ঈদে তেমন টাকা পাঠাতে পারিনি। করোনা মহামারির কারণে প্রবাসী অনেকের আয়-রোজগার কমেছে। দেশে আগের মতো কেউ টাকা পাঠাতে পারেনি।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ওভারসিজ সেন্টার সিলেটের ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তা মো. আবদুল মছব্বির সম্প্রতি জানান, বাংলাদেশে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার মধ্যে সর্বোচ্চ হারের ভিত্তিতে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্য রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির ৯৫ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির ৫৫ শতাংশ এবং সৌদি আরবের ২৫ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে ৪০ শতাংশ সিলেটি। সে হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সিলেটে আসছে বলে ধারণা করা যায়। তবে করোনা পরিস্থিতিতে টাকা পাঠানোর হার কমে গেছে।
বাংলাদেশ ওভারসিজ সেন্টার সিলেটের সাবেক প্রধান নির্বাহী শামসুল আলম বলেন, সাধারণত কোরবানি ঈদকে উপলক্ষ করে অনেক প্রবাসী দেশে প্রচুর টাকা পাঠান। এবার এর অনেকটাই ব্যতিক্রম ঘটল।