আজিজুল হক : গৌরচন্দ্রিকা: করাচী থেকে দুবাই হয়ে সিডনির পথে যাত্রা।

এপ্রিল মাস থেকে এই দিনটির অপেক্ষায় আমরা-আমি এবং আমার স্ত্রী তামান্না। বন্ধ থাকা ফ্লাইটগুলো একে একে খুলতে শুরু করলো জুন মাসের বিশ তারিখের দিকে। সাথে সাথে জুলাইর দশ তারিখের জন্য টিকিট কেটে ফেললাম। কিন্তু বিধি বাম-কয়েকদিনের মধ্যেই তা আবার বন্ধ হয়ে গেলো। কারণ, করাচী থেকে হংকং যাওয়া প্রায় বিশ জন যাত্রীর শরীরে করোনা জীবাণু সনাক্ত হয়েছে। ফলে এর সমাধান বের না করা পর্যন্ত সব ফ্লাইট বাতিল। আমাদেরটিও।

জুলাই মাসের শুরুতে জানানো হলো, ফ্লাইটে উঠার বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে নির্দিষ্ট সেন্টারে। করোনা পরীক্ষা করে তার সনদ এমিরেটস এয়ারলাইনে যাত্রার চব্বিশ ঘন্টা আগে সরাসরি পৌঁছাতে হবে সেই নির্দিষ্ট সেন্টার থেকে। তবেই মিলবে বিমানে আরোহনের অনুমতি। টিকিটের দাম আকাশচুম্বী। তার মধ্যেই সময়ের হিসেব নিকেশ করে চৌদ্দই জুলাই’র। টিকিট কাটা হলো। তবে বড় দুটি সংশয় ভর করছে মনে-করোনা পরীক্ষা পাশ করবো তো? আর দ্বিতীয় বারের মত কোন না কোন কারণে ফ্লাইট আবার বাতিল হবে না তো?

দুরু দুরু বুকে বার তারিখ সক্কাল বেলা হাজির হলাম টেস্ট সেন্টারে। নমুনা নেয়া শেষে জানানো হলো যে সাধারণত চব্বিশ ঘন্টা পর রিপোর্ট দেয়া হলেও, সকাল সকাল আসার কারণে এমনকি আজ সন্ধ্যায়ও তা মিলতে পারে। ঘরে ফিরলাম। দুজনের মাথায় ফলাফলের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এমনকি একজনের কোন গন্ডগোল হলেই তো কর্ম সাবাড়! অস্বস্তির প্রহর শেষ হলো সন্ধ্যা ছয়টার দিকে। ক্ষুদেবার্তা জানান দিলো রিপোর্ট তৈরী-সাথের লিংক চাপতেই রিপোর্ট দেখা গেলো- “নেগেটিভ’। স্বস্তি, আনন্দ আর উত্তেজনার মিশেল এক অসাধারণ অনুভব।

নির্দিষ্ট দিনে দু-ঘন্টার কম উড়াল পথে দুবাই বিমানবন্দর। কত অসংখ্যবার এই বিমানবন্দর দিয়ে যাওয়া আসা করেছি। কিন্তু এবার নেমে দেখলাম এ যেন এক সম্পূর্ণ অচেনা যায়গা। সারি সারি আকাশযান বিমানবন্দরের গেট কিংবা রানওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই- কিন্তু সেগুলো অন্ধকার। টারমাকে নেই কোন প্রাণচাঞ্চল্য! বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দরগুলোর একটি এই দুবাই-এর আকাশে বিভিন্ন উচ্চতায় লেগে থাকে আগমনী বিমানের সারি। আজ তেমন কিছু নেই-আমাদের বিমানটি যেন অনেকটা নিঃস্বঙ্গ মৌনতায় এয়ার ব্রিজ-এর কিনারায় যেয়ে ভিড়লো। বিমানবন্দরের ভেতরেও একই অবস্থা। সিকিউরিটি চেকে নিত্য দিনের ভীড় নেই। টার্মিনালের ভেতর সারি সারি শূন্য বোর্ডিং গেট-দিনের যে কোন সময়ে যেগুলো থাকতো মানুষের পদভার আর কলকাকলিতে ব্যস্ত। আকর্ষণীয় ডিউটি ফ্রি দোকানগুলোতে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতাই কেবল চোখে পড়ে।

আমাদের প্রায় বাইশ ঘন্টার ট্রানজিট। তাই আগে থেকে এয়ারপোর্ট-এর ভেতরে হোটেল বুকিং করেছিলাম বার ঘন্টার জন্য। গোসল, ঘুম শেষে লাউজে বসে বাকি সময় কাটিয়ে দিলাম। এবার চৌদ্দ ঘন্টার উড়াল কাংখিত গন্তব্যে। যদিও এ ক্ষেত্রে তা হবে “পৌঁছাইয়াও হইলো না। পৌঁছা”-চৌদ্দ দিনের দীর্ঘ কোয়ারেন্টাইন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

(১) তৃতীয় চব্বিশ ঘন্টার প্রহর চলছে। এত দূর পথ এসেও ছেলেটির সাথে দেখা হচ্ছে না। তাই আমার চেয়েও মায়ের মনটি যে আরো উতলা থাকবে, এমনটাই স্বাভাবিক। সেই সাথে আরো বড় অনিশ্চয়তা আমাদের মেয়ের সাথে কবে দেখা হবে। সে থাকে মেলবোর্ন-এ। সেখানে সা¤প্রতিক কালে দুই শত-র কাছাকাছি নতুন করোনা রোগী সনাক্ত হওয়ায় রাজ্য সরকার অনেক কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। সেই সাথে অন্য সব রাজ্যের সাথে প্রবেশ ও নির্গমন হয়েছে বন্ধ। সেটি কবে যে শেষ হবে আর তূর্ণার সাথে দেখা হবে, তা একেবারেই অনিশ্চিত।

আমাদের চৌদ্দ দিনের কেয়ারেন্টিন যে হোটেলটিতে, তার দশম তলায় আমাদের রুম থেকে সিডনি শহরকেন্দ্রের একটি ব্যস্ত সড়ক আর দালান দেখা যায়। এ মূহূর্তে বাইরের জগতের সাথে আমাদের সংযোগের মাধ্যম রুমের একমাত্র জানালাটি। কখনো আমি, কখনো তামান্না, কখনোবা দুজনে মিলেই সেই জানালা দিয়ে বাইরের এক টুকরো জগত দেখি। শুধু যে আমরা, তা নয়। উল্টো দিকের জানালাগুলোতেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় আমাদের মতই চৌদ্দ দিনের জন্য অবরুদ্ধ অন্যান্যদের।

আজ শনিবার-আমাদের ছেলে তূর্য’র অফিস নেই। তাই ঠিক হলো, চোখের দেখার তৃষ্ণা মেটানোর জন্য সে আসবে হোটেলের সামনে।

রাস্তায় এসে দাঁড়ালো তুর্য। উপর থেকে হাত নেড়ে আমাদের অবস্থান নিশ্চিত করা হলো। দেখা তো যাচ্ছে, তবে কথা হবে কি করে? দশ তালা থেকে চোখের দেখা আর টেলিফোনে কণ্ঠ মিলিয়ে কিছুটা হলেও, একরকম স্বান্তনা মিললো।

(২) আজ বিকেলে দ্বিতীয় করোনা টেস্ট করা হলো। তার মানে আজ আমাদের হোটেল কোয়ারেন্টিনের দশম দিন।

হোটেলে প্রবেশের প্রথম দিনই রুমে কিছু নির্দেশনা রাখা ছিলো। সেটিতেই লেখা ছিলো দুটি পরীক্ষার কথা – প্রথমটি দ্বিতীয় দিন এবং পরেরটি দশম দিনে। এ দুটি পরীক্ষা উৎরাতে পারলে তেরতম দিনে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে বিকেল চারটার পর ছাড়া পাওয়া যাবে চৌদ্দতম দিবসে-আসবে বহু আকাংখিত “কারা মুক্তি দিবস!”

এই দশ দিনে বন্ধ জানালা ছাড়া বাইরের আলো-বাতাসের সাথে কোন সংযোগ নেই। ঘরের দরজা খোলা যাবে দিনে মাত্র তিন বার-দরজার বাইরে রেখে যাওয়া খাবার ভেতরে আনার জন্য।

একটি কাগজের ব্যাগে করে প্রায় ঘড়ির কাঁটা ধরে খাবার রেখে যাওয়া হয়-সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে সকালের নাস্তা, দুপুর বারটা থেকে সাড়ে বারটার মধ্যে দুপুরের খাবার এবং সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে রাতের খাবার।

খাবারের আয়োজনে বৈচিত্রের দিকে খেয়াল রাখা হয়েছে। প্রথম চার দিনের খাদ্য তালিকা পূর্ব নির্ধারিত। পঞ্চম দিন থেকে শুরু করে চৌদ্দতম দিন পর্যন্ত ছাপানো তালিকা দেয়া হয়েছে। সেখানে প্রতিদিনের প্রতি বেলার জন্য দুইটি কিংবা তিনটি চয়েস রয়েছে। সেটিতে টিক দিয়ে বাইরে রেখে দিতে হবে তৃতীয় দিনের মধ্যে। তামান্না আর আমার খাবারের পছন্দের মধ্যে ফারাক আছে। খাবার পছন্দের সময় আমি খাবারের পুষ্টিমান নিয়ে চিন্তা করি না। স্বাদটাই আমার কাছে মুখ্য। তাই তামান্নাকেই ছাড় দিতে হলো। দুজনে মিলে ঐক্যমতের তালিকা দরজার বাইরে রেখে আসলাম সময় মত।

পশ্চিমা রীতি অনুযায়ী খাবার সরবরাহের সময়সূচি। নাস্তার সময়টি তবুও চলে। দুপুরটাও না হয় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু রাতের খাবারের সময়টি আমাদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। একে তো সময়টি চা-পানি খাবার। আর এই সময় যদি খেয়েই ফেলি তো আরো যে দীর্ঘ রাত্রি পড়ে রয়েছে, তার কি হবে? কিন্তু রাতে দেয়া হয় গরম খাবার। এই শীতের রাতে সেটিকে ঠান্ডা হতে দেয়া যায় না। আগত্যা খেতে বসতে হয়।

মানুষ অভ্যাসের দাস। গত দু-তিন দিন ধরে ছয়টা বাজলেই কান পেতে থাকি দরজায়।

(৩) আমাদের এই হোটেল ভবনটি অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতির। হোটেলের কামরাগুলো শুরু হয়েছে ছয় তলা থেকে। পঞ্চম তলায় বিভিন্ন রেস্তোরাঁ-এখন সেগুলো ফাঁকা পড়ে রয়েছে-যেমনটি রয়েছে মাঝখানে খোলা আকাশের নীচে সাজানো বাগান আর বেঞ্চগুলো।
যে কোন রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে উল্টো দিকের কক্ষগুলো দেখা যায়। সেখানে নীচের তিনটি তলার কামরাগুলোর বারান্দা আছে। অসীম ঈর্ষা নিয়ে মাঝে মাঝে দেখি সেখানে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে খোলা বাতাসে শ্বাস নেয়। কিন্তু তার উপরের আটটি তলার আমাদের সকলের একই অবস্থা। সকাল হলেই দেখা যায় জানালায় বিভিন্ন ভংগীতে বিভিন্ন প্রকারের মানুষ। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে, কেউবা ল্যাপটপ বা আইপ্যাড হাতে।
মানসিক সুস্থ্যতা এসব দেশে বেশ বড় ব্যাপার। প্রতিদিন নার্স একবার ফোন করেন। আমরা ঠিক আছি কিনা-কোভিডের কোন লক্ষণ দেখা দিচ্ছে কিনা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই প্রশ্ন। একেবারে শেষে জিজ্ঞেস করেন মানসিক অবস্থার কথা-মনে করিয়ে দেন যে মানসিকভাবে অবসন্ন বোধ করলে, তাঁদের এখানে চব্বিশ ঘন্টাই মেন্টাল হেলথ কাউন্সিলার আছেন-প্রয়োজন হলে যেন। আমরা তাঁর স্মরণাপন্ন হই।

দ্বিতীয় দিন থেকে এক এক করে বিভিন্ন বদ্ধ কক্ষের জানালায় দেখা মিলতে শুরু করলো অদৃশ্য শৃংখলে বাঁধা পড়া মানুষের বাইরের জগতের সাথে সংযোগ স্থাপনের আকুতি। কেউ কেউ এক। টুকরো কাগজে “হ্যালো লিখেছেন-কেউবা এঁকেছেন “স্মাইলি” বা হাঁসি মুখ। যদিও আমার কাছে সেটি বন্দীতার কষ্ট ছাপিয়ে নিজেকে প্রফুল্ল রাখার আকুতিই মনে হয়েছে।

(৪) আজ রাত পোহালে কাল মুক্তি! সকাল দশটার দিকে দরজায় টোকা পড়লো-মুক্তি পূর্ব শেষ শারীরিক পরীক্ষা। নার্স কপালে তাপমাত্রা নিলেন আমাদের দুজনেরই। এরপর যথারীতি আরো কিছু প্রশ্ন-করোনার অন্য কোন উপসর্গ নেই, তা নিশ্চিত করা। সন্তুষ্ট হবার পর দুজনের কব্জিতে পরিয়ে দেয়া হলো দুটি লাল রঙের ব্যান্ড-যেমনটি দেয়া হয় হাসপাতালের রুগীদের। এর একদিকে লেখা রয়েছে কর্তৃপক্ষের নাম “কোভিড-১৯ নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য”, অপরদিকে লেখা “বুধবার অপরাহ্ন”-প্রথম দিন থেকেই জানা ছিলো যে আমরা ছাড়া পাবো ওই দিন বিকেল চারটা থেকে ছয়টার মধ্যে।

এবার নার্স হস্তান্তর করলেন কোভিড পরীক্ষা পাসের সনদ। সেই সাথে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তা হস্তান্তর করলেন রাজ্যের পুলিশ কমিশনারের পক্ষ থেকে কোয়ারেন্টাইন পূর্ণ করার সনদপত্র। অস্ট্রেলিয়াতে করোনা সংক্রমণ খুবই সীমিত আকারে হলেও, এখনও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে চলাচল নিষিদ্ধ। ক্যানবেরা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিট্যাল টেরিটরী (এ-সি-টি) নামক রাজ্য, যেটি নিউ সাউথ ওয়েলস (যার রাজধানী সিডনি) থেকে ভিন্ন। যদিও এ দুটি রাজ্যের মধ্যে। চলাচলের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, তবুও রাজ্য সীমান্তে প্রশ্নের মুখামুখি হবার সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই তা বলা যায় না। যদি তেমনটি হয়, তাহলে এই সনদগুলো খুবই কাজে আসবে। কাল জেল মুক্তি দিবস। সভ্য দেশে আশা করছি জেল গেটে আর কোন মামলা ধরিয়ে দেয়া হবে না।

(৫) বিকেল চারটায় মুক্তি মেলার কথা। দুইটা থেকে আমরা সব গুছিয়ে প্রস্তুত। তিনটা বাজতেই রিসেপ্সনে ফোন করে বললাম-আমরা তৈরী, নীচে নেমে আসবো কি? জবাব মিললো-অপেক্ষা কর। শীঘ্রি পুলিশ অফিসার তোমাদের রুমে আসবেন।

প্রতীক্ষার প্রহর ফুরায় না-দু একবার দরজার বাইরে উঁকি দেই-কেউ আসে না। এর মাঝে বাইরে শব্দ শুনি অন্য কক্ষের দরজা খোলা আর বন্ধ হবার- সেই সাথে কিছু উচ্ছ¡সিত কোলাহল। বুঝলাম, কোন এক দিক থেকে মুক্তির পালা শুরু হয়েছে। আমাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।

ঘড়ির কাঁটা চারটা চল্লিশ-এ আমাদের দরজায় টোকা পড়লো। দরজায় দাঁড়ানো পুলিশ অফিসার মেয়েটি সহাস্যে বললেন-তোমাদের জন্য সুসংবাদ-আজ তোমরা ছাড়া পাচ্ছো! জিজ্ঞেস করলেন-কেমন কাটলো তোমাদের সময়? আমি বললাম-গত চৌদ্দ দিনে তত কষ্ট হয়নি যতটা হয়েছে গত চল্লিশ মিনিটে!

নীচে নেমে আসতেই তূর্যর দেখা মিললো। চৌদ্দ দিন পর ছেলেকে স্পর্শের আনন্দ! আমাদের সদা পরোপকারী রায়হান ভাই অনির্দিষ্ট কালের জন্য তাঁর সদ্য কেনা গাড়িটি দিয়ে দিয়েছেন আমাদের জন্য। সেটিতে অনায়েসেই এঁটে গেলো আমাদের সব ব্যাগ আর স্যুটকেস-দেরী না করে সরাসরি রওয়ানা করলাম ক্যানবেরার পথে।

তিন ঘন্টার পথ পেরিয়ে ক্যানবেরায় প্রথমে রাজনের বাসায় রাতের খাবারের আয়োজন। আমার খালাতো ভাই রাজন ও তার পরিবারের আতিথেয়তার উপাখ্যান বলে শেষ করার নয়। সে উপাখ্যান তোলা রইলো আরেক দিনের জন্য।