মুরশাদ সুবহানী : জ্ঞানী-প্রাজ্ঞজনদের শিরোমণি, প্লেটো যাঁকে বলেছেন, “বিজ্ঞতার প্রতিমূর্তি” সেই মহামতি আরিস্টটল বলেছেন, কাব্যকলা হলো অনুকরণ কলা। মহামতি আরিস্টটলের অনেক আগে হোমর এবং হেসিয়ড কাব্যকে ‘ঐশ্বরিক প্রেরণার ফল বলে মনে করতেন।’ হোমর মনে করতেন, কাব্যের উদ্দেশ্য হল আনন্দ দান করা। হেসিয়ডের মতে, সংগীতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কবির মধ্যে যে বাণীর সঞ্চরণ ঘটিয়েছেন তা লোক সমাজে প্রকাশ করে দেওয়াই কবিতার কাজ।’
মহামতি দার্শনিক আরিস্টটলের মতের যুক্তি আছে। পূর্বসূরীকে অনুকরণ করে কাব্যকলা নির্মিত হয়। আমরা বলি অনুকরণ, অনুশীলন আর চর্চা মানুষের ভাবনা-চিন্তার সাথে মিশে গিয়ে শিল্প-সাহিত্যের সৃষ্টি করে। ঐশ্বরকি বিষয়কে বিয়োজন করা যায় না। বিভিন্ন দেশে অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষ শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তাঁদের অনেকে কোন পাঠশালায় যাননি, কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় ডিগ্রী অর্জন করেননি। কিন্তু সাহিত্য-শিল্পে যা দিয়েছেন, তাঁর উপর গবেষণা করে অনেক ডক্টরেট ডিগ্রী নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। আমাদের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন শাহ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মীর মোশারোফ হোসেন, এ রকম বহু প্রতিভাবান মানুষের কথা বলা যায়। যাঁদের শিক্ষায়তন থেকে বড় কোন ডিগ্রী ছিল না। সাহিত্যে যা দিয়েছেন, তা অমর সৃষ্টি। তাঁদের আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া ছিল না ঠিকই, কিন্তু লেখা-পড়া ছিল। তাঁরা ঐশ্বরিকদান থেকে আহরণ করেছেন। সারা বিশ্বে এই রকম প্রতিভাবান মানুষ অতীতে ছিলেন, বর্তমানে আছেন এবং ভবিষতেও থাকবেন।
মহামতি আরিস্টটল অনুকরণ বলতে, ‘বিশেষ উদ্দেশ্যে বা ইচ্ছা প্রণোদিত অথচ কর্মরত মানুষের জীবন চিত্রায়নের কথা বুঝাতে চেয়েছেন।’ মানুষ প্রতিনিয়ত অনুকরণ করে তার চারপাশের অন্য মানুষ, তাদের আচরণ, পারিপার্শ্বিক বস্তু, নানা দৃশ্য। সব কিছুই মানুষের অনুকরণের মধ্যে।এই অনুকরণশীল প্রক্রিয়া চলমান। আমরা সব সময় দেখি। সব অনুকরণ থেকে কবিতার উপজীব্য পাওয়া যাবে তা নয়। আবার এমনও হতে পারে, দৃশ্যমান বিষয়টি কবিতা হচ্ছে না; একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে। কিন্তু কবি তাঁর কাব্য দৃষ্টি মেলে ধরে সেটাকে শব্দের ভাষায় গতি দিলে আমাদের হৃদয় আন্দোলিত হয়। সেটা হয়ে উঠে কবিতা।
‘একটি আসন ও রেলগাড়ির মাঝে/
কালো ধোঁয়ার উড়ন্ত সেতু/
ট্রেনের চাকারা কতোবার ঘুরে ঘুরে
তোমাকে জানায় সম্বর্ধনা;
দু’পাশের ছুটন্ত দৃশ্যরা…
প্লাটফমের উপর ঝুঁকে পড়া যাত্রাপালা;..
…………………………………
ধোঁয়ার উড়ন্ত সেতু
ফের কালোর ভেতর ধাবমান।’
(কালোসেতু, ‘ভূ-বারান্দা’ পৃ: ১৩)
রেল গাড়ি/ট্রেনে আমরা কমবেশী সবাই চলাফেরা করি। নিত্যদিন দেখি ট্রেনের আসা যাওয়া।
কবি নাভিল মানদার ট্রেনকে অনুকরণ করলেন কাব্য নির্মাণে। তিনি কয়লার ইঞ্জিন চালিত কালো ধোঁয়া ছড়ানো ট্রেনের দৃশ্যপট আঁকলেন কবিতায়। রেল লাইনের লোহার পথকে ট্রেন ঘুরে ঘুরে সম্বধনা জানাচ্ছে চলার সময়। ট্রেনে চড়লে তারপাশে দৃশ্যগুলোকেও ছুটন্ত মনে হয়। আসলে তাঁরা স্থির। ছুটছে ট্রেন। গতিতত্বের তত্ব হলো, ছুটন্ত কোন বস্তুতে বসে থাকলে পাশের সব কিছুকে মনে হবে সেগুলোও ধাবমান। আসলে তারা স্থির। গতিবিদ্যার তত্ব। বৈজ্ঞানিক তত্বকে কাব্যিক ভাষায় নির্মাণ করেছেন নাভিল মানদার। তাঁর এই কবিতা সমসাময়িক সময়ের নিরেট আধুনিক গদ্যছন্দে কবিতা। এই কবিতা আমাদের মনকে নাড়া দিয়েছে। তাঁর এই কবিতায় ধোঁয়ার উড়ন্ত সেতু বলতে আমাদের মনে হচ্ছে তিনি ট্রেনকেই বুঝিয়েছেন। সেই ‘ধোঁয়ার উড়ন্ত সেতু/ ফের কালোর ভেতর ধাবমান।’ উপমার ব্যবহার প্রশংসার দাবি রাখে।
মানুষ কাব্য সৃষ্টি করে। এর পেছনে নিহিত তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ কৈশোর কালের আগে থেকেই তার মধ্যে সহজাত প্রবৃত্তি কাজ করে। মানুষ অন্যসব প্রাণীর চেয়ে আলাদা কারণ মানুষ বৃদ্ধিমান এই জন্যে। কাব্যকলা বিনির্মাণে তার পর্যবেক্ষণ যাকে বলা যায় অনুকরণ। সে সব কিছু দেখে। এই দেখা থেকে সৃষ্টি করে সাহিত্যের নানা শাখা। যার মধ্যে কবিতা একটি। গান, নৃত্য, নাটক, উপন্যাস সব কিছুর মধ্যে ব্যঞ্জনা আছে। আছে সুর, লয় তাল। কবিতার তাল হলো ছন্দ। আমাদের জানা মতে, চার ছন্দের যে কোন একটি ছন্দে অথবা ৩টির সংমিশ্রণে কবিতা সৃষ্টি হতে পারে। একটি ছন্দকে বাদ দিয়ে বলছি এই কারণে যে, অমিত্রাক্ষর ছন্দ। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই ছন্দের দাতা। এই ছন্দে সনেট লেখা হয়। তিনি বাংলা সনেটের জনক । সাধারনত আমরা আলাদাভাবে সনেট কবিতা সৃষ্টি করি। এর আলাদা মাত্রা আছে। সনেট কবিতাতেও অনুকরণ ক্রিয়াশীল।আমরা কবি নাভিল মানদারের ‘ভূ-বারান্দা’ কাব্যগ্রন্থ পড়ে এর মধ্যে সনেট কবিতা পাইনি। কোন কোন কবিতায় অক্ষরবৃত্ত,মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত ছন্দ দেখতে পেয়েছি। আমরা কবি নাভিল মানদারের কবিতায় ছন্দ নিয়ে আলোকপাত করছি না। একবারে বলে দিলাম, তার ‘ভূ-বারন্দা’ কাব্যগ্রন্থে তিনটি ছন্দের সমাহার রয়েছে। আমাদের প্রক্ষেপণ তাঁর কবিতার অনুকরণের উপর। আমরা দেখাতে চেষ্টা করবো একটি কবিতায় কবি কি কি বিষয় অনুকরণ করে তার উপর একটি কবিতা নির্মাণ করেছেন।
‘তোমার খাটের তলদেশে
যে হাসপাতাল বসবাস করে
মেঘা আকাশের সূর্য এসে ভর্তি হলো;
জানি পেটেব্যথা পৃথিবীর আদি রোগ
যেহেতু মেঘের পেট ফেটে
ভিজে যায় মৃত্তিকার মাটি..
…………………………
আমিও নিছক ছদ্মবেশী রুগী
ভর্তি হোয়েছি খাটের তলদেশে।’
(আরোগ্যতলা, ‘ভূ-বারান্দা’ পৃ: ১৭)
কবি নাভির মানদারের এই কবিতায় যে অনুকরণ ক্রিয়াশীল তা হলো- একজন রোগী হাসপাতালে আছেন। তার ব্যামো হলো পেটের ব্যথা। রোগীর খাটের নিচে শুয়ে আছে হাসপাতাল। অর্থাত একজন রোগী খাটের উপরে আর খাটটি হাসপাতালের মেঝের উপরে। কবি দেখলেন, হাসপাতাল রোগীর খাটের নিচে। মেঘা আকাশের সূর্য এসে পড়েছে। রোগীর রোগ হলো পেটের ব্যথা। কবি এই রোগকে আদি রোগ বলে বর্ণনা করেছেন।‘ মেঘের পেট ফেটে ভিজে যায় মৃত্তিকার মাটি।’ কবি বৃষ্টি-বর্ষণের কথা বলেছেন। এখানে মৃত্তিকা আর মাটি একই অর্থ। তারপরও কবিতা সৃষ্টির প্রয়োজনে মৃত্তিকা মাটি এই দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। আর ‘আমি’ বলতে কবি হাসপাতালকেই বোঝাতে চেয়েছেন বলে আমাদের মনে হয়। খাটের নিচে হাসপাতাল নিজেই ছদ্মবেশী এক রোগী। হাসপাতালকে তিনি রোগাক্রান্ত বলেই আসলে আখ্যায়িত করেছেন।অনুকরণ করেছেন, রুগী, হাসপাতাল, সূর্য, বৃষ্টি-বর্ষণ, ভিজে যাওয়া মাটি, আর অনুকরণের আর এক উপজীব্য হাসপাতাল যা কবির দৃষ্টিতে রোগাক্রান্ত। আমরা যদি বলি নির্মিত অনুকরণের উপাদান থেকে কবি নাভিল মানদার হাসপাতালের এক চিত্র এঁকেছেন। যে হাসপাতাল নিজেই রোগ-শোকে আক্রান্ত। সেই হাসপাতালটি একজন পেট ব্যথার রোগীকে কি করে ভাল করে তুলবে?
কবি নাভিল মানদার তাঁর কাব্যগ্রন্হের নামকরণ করেছেন‘ভূ-বারান্দা।’ ব্যাপক অর্থে বোধ করি তিনি পৃথিবীকে ভূ-বারান্দা হিশেবে দেখেছেন। এই বারান্দার বিচরণ ক্ষেত্রে কবি যতটুকু অনুকরণ করেছেন, সেটি তাঁর অনুশীলন,চর্চা আর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে কবিতা রচনা করেছেন।
‘রে জেনেছি বোবাদের ভাষাই আন্তর্জাতিক
ফলে শেষমেশ বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি
আজ সকালেও ঘুম থেকে জেগে দেখি
আমার পায়ের নিচে প্রকান্ড বারান্দা..
…………………………………
তাকে খুঁজেছি শ্মশানে, জুতোর ভেতর..
…………………………………….
তোমার গচ্ছিত একটা বিস্কুট ভেঙে ভেঙে
রাতের আহার যুগিয়েছি কুকুরের
তারপর কুকুরের সাথে ঘুমিয়ে পড়েছি বারান্দায়..
………………………………………
অবিরাম উড়ে যাওয়া পাখির ডানা
প্রতিদিন পরিষ্কার করে ময়লা আকাশ..
জন্মদ্বারের বিশুদ্ধ কারাগার
বিনত ভাষায় বোবার ক্রন্দন
সফল জলের মতো নির্বিকার।
(ভূ-বারান্দা, ‘ভূ-বারান্দা’ পৃ: ৩৩)
যাদের কথা বলার শক্তি নেই। প্রতিবাদের ভাষা নেই; সেই সব বোবাদের ভাষাকে তিনি আন্তর্জাতিক ভাষা বলে আখ্যায়িত করেছেন । বিশুদ্ধ প্রতিবাদী কবিতা না হলেও এই কবিতার মধ্যে প্রতিবাদ আছে।সবশেষ তিনটি পংক্তিতে কবি জন্মদ্বারকে বিশুদ্ধ কারাগার বলেছেন। জননী বোবাকে বিশুদ্ধ জাঠরে রেখেছেন । বলা যায় ভূমিষ্ঠ হওয়া পর‘বিনত ভাষার ক্রন্দন সফল জলের মতো নির্বিকার।মুখ ফুটে আওয়াজ তুলে প্রতিবাদ করতে না পারলেও বোবাদের ‘বিনত ভাষায় ক্রন্দনকে তিনি প্রতিবাদ বলতে চেয়েছেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি শুধু অনুকরণ নয় এর সাথে মানুষের উদ্ভাবনী চিন্তা শক্তি কাজ করে। এই শক্তি সে পায় অনুশীলন এবং চর্চা থেকেই ।প্রতিনিয়ত আমরা অনুকরণ করি। আগেই বলেছি, সব মানুষের মধ্যে কাব্য প্রতিভা আছে। উদ্ভাবনের চিন্তা না করায় প্রতিভা প্রষ্ফুটিত হয় না।অনুকরণ, অনুশীলন, চর্চা আর উদ্ভাবনী প্রতিভার সমন্বয়ে কবি নাভিল মানদার তাঁর‘ভূ-বারান্দা’ কাব্যগ্রন্হে যে কবিতা গুলো উপস্থাপন করেছেন, আমাদের বিবেচনায় শিল্পসম্মত উপস্থাপনা হয়েছে।তার কবিতার প্রকাশ ভঙ্গি আধুনিক সময়ের এবং পাঠককে বিমুগ্ধ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
কবি নাভিল মানদার জন্মেছেন, একটি স্বর্ণযুগের স্রষ্টা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জেলায়। বাংলাদেশের যশোরে। যশোর ক্যান্টমেন্ট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর পড়াশোনা করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবি নাভিল মানদার কাজ করেন, লিটল ম্যাগ নিয়ে। ‘ভূ-বারান্দা’ তার চতুর্থ কাব্য গ্রন্থ।এই লিটল ম্যাগ কাব্যগ্রন্থ ভূ-বারান্দায় মোট ৪৮টি কবিতা আছে। প্রকাশকাল: ফাল্গুন ১৪২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। প্রকাশক: উলুখড়, ৩২, অলিম্পিয়া বি-৯,লেকসার্কাস, কলাবাগান, ঢাকা ১২০৫। প্রচ্ছদ এঁকেছেন, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মোজাই জীবন সফরী। পরিবেশক: পাঠক সমাবেশ, ১৭ আজিজ সুপার মার্কেট(নিচতলা),শাহবাগ,ঢাকা এবং ধ্যানবিন্দু, বøক৪, স্টল নং ৫-৬, কলেজ স্কোয়ার (ইস্ট),বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট, কলকাতা ৭৩। মূল্য: ১০০ টাকা।
লেখক : সাহিত্যের সেবক, এ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, পাবনা, বাংলাদেশ। বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী)