মুরশাদ সুবহানী : বিশ্ব জুড়ে প্রতিভাবান কাব্যিক মনের মানুষ কবিতা রচনা করেছেন এবং করছেন। আসলে কবিতা কি? এই প্রশ্ন আসতেই পারে এবং আসে। কবিতার সার্বজনিন কোন সংজ্ঞা নেই। কবিতা হলো, একজন সৃষ্টিশীল মানুষের মনের অভিব্যক্তির গ্রন্থিত বাক্য। যা তিনি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেন। একজনের কবিতা আর একজনের কাছে পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু যিনি কবিতা রচনা করেন তার কাছে তাঁর রচিত কবিতা প্রিয়। অন্যরা কি বললেন, অনেকে এটার তোয়াক্কা করেন না। তারপরও সমালোচকের মতামতের গুরুত্ব রয়েছে। আলোচক-সমালোচক ইচ্ছা করলে পাঠকের কাছে একটি অখাদ্য কবিতাকে খাদ্য করে তুলতে পারেন। আমরা বলি বাহ, চমৎকার। বিরূপ মন্তব্য হলে, রচয়িতা ব্যধিত হন। তার মনে নতুন উদ্যমে আরও ভাল কিছু সৃজনশীলকর্ম করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। অঙ্কুরে বিনষ্ট হয় তার প্রতিভার কলি। যাঁরা নিন্দুক জাতীয় সমালোচকদের কোনো তোয়াক্কা করেন না, তারা নিজ প্রতিভার শক্তির উপর ভর করে সাহস নিয়ে এগিয়ে যান। তাদের অনেকেই সফল হয়েছেন। আমরা বাঙালা-ভাষাভাষী যাকে নিয়ে গর্ব করি, তারাও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, নোবেল বিজয়ী কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যাঁরা তাঁদের লেখার বিরূপ মন্তব্য করে ছিলেন, তাঁরা মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল হতে পারেননি। হতে পারেননি হয়তো উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, কবি অক্টাভিওপাজ, পাবলো নেরুদা, টি এস এলিয়ট, রুডইয়ার্ড কিপলিং । অনেক খ্যাতমান কবি-সাহিত্যিকের নাম করা যায়। দেশের-বিদেশের কবি-সাহিত্যেকদের নোবেল বিজয়কে ঠেকাতে পারেননি, নিন্দুক সমালোচকগণ। তবে অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, নিন্দুকরা এই সকল প্রতিভাবান মানুষদের নিন্দা করে উপকরাই করেছেন, তাঁদেরকে আলোচনার বিষয়বস্তু করে তুলেছেন। নিন্দুকরা পিছিয়ে গেছেন; খ্যাতির শীর্ষে উঠে গেছেন নিরলস পরিশ্রমি কবি-সাহিত্যিকগণ।

কবি হবেন, একজন স্বাধীন চেতা মানুষ। নিন্দুক, সমালোচকদের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যাবেন নিজ প্রতিভার উপর নির্ভর করে।
সৃজনশীল কর্মকে উপাসনা হিসেবে নিয়ে কাজ করলে এক সময় ভালফল অবশ্যই পাবেন।
আমি সেই মানুষের কথা প্রায়ই বলি, যার জ্ঞান এখনো আমাদের মাঝে ছড়িয়ে যাচ্ছে আলো। তিনি হলেন, মহামতি আরিস্টটল। গ্রীসের এই মহাজ্ঞানী বলেছেন, ‘কাব্য হলো অনুকরণ কলা।’

আমরা চারদিকে যা দেখি সেটাই অনুকরণ করার চেষ্টা করি। অনুকরণ মানুষের সহজাত একটি প্রবৃত্তি।
“মানুষ যে অন্য প্রাণী থেকে পৃথক তা এই জন্যই যে সে হচ্ছে সবচেয়ে অনুকরণশীল জীব এবং জীবনের সর্ব প্রথম পাঠ নেয় অনুকরণেরই মাধ্যমে।” (মহামতি আরিস্টটল থেকে নিয়ে এই কথা বলেছেন, শ্রী সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, তাঁর অনুবাদ গ্রন্থে।

মানুষের বুদ্ধি বৃত্তি বিকাশের সাথে সাথে সাথে মানুষ তার অনুকরণ থেকেই প্ররোচিত হয়ে শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা সমাজকে দেখি। নানাজন নানাভাবে দেখেন। দেখার দৃষ্টি ভঙ্গির মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। কবি-সাহিত্যিক দেখেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে। সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর দেখার পার্থক্য এখানে। এই দেখাটা হলো অনুকরণ। আর বই পুস্তক পাঠ করে আমরা নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করি, শিখি ছন্দের নানা মাত্রা। বাক্য গঠনে-চলনের নানান কলা কৌশল।

এই অনুকরণ থেকে স্বীয় প্রতিভার সমন্বয় আর ছন্দের মাত্রা যুক্ত করে একজন কবি কবিতা রচনা করেন। এভাবেই ক্রমবিকশিত হয়েছে কবিতার জগত এবং এখনও হচ্ছে। বুদ্ধি প্রসূত কলা কৌশলের মাধ্যমে একজন মানুষ কবি সত্তায় পরিণত হন। এই কাব্য সৃষ্টির প্রাথমিক সূচনা হয়েছে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই অনুকরণ থেকে। মানুষ কবে থেকে কবিতা লিখছেন, তা গবেষণার বিষয়। বলা যায়; বুদ্ধি-বৃত্তির সাথে সাথেই সাহিত্য কলার সূচনা হয়েছে। সাহিত্যের অনেক শক্তিশালী মাধ্যম আছে। তার মধ্যে শক্তিশালী একটি মাধ্যম হলো কবিতা। অনেকের মতে, কবিতার বিকাশ হয়েছে, মানুষের কল্পনা শক্তি থেকে। এই কথা অস্বীকার করা যায় না, কল্পনা শক্তি না থাকলে অনুকরণ থেকে একজন মানুষ কাব্য-কলা সৃষ্টি করতে পারতেন না। শুধু কল্পনা নয় এর সাথে সংমিশ্রণ হয় বাস্তব চিত্র। বাস্তবকে একজন কবি অনুকরণ করেন। একজন কবি বহমান নদী দেখলেন। বহমান নদী বাস্তব চিত্র। এর সাথে কল্পনার যোগ সূত্র করে তিনি একটি কবিতা লিখতে পারেন।

সরাসরি বলি, কবিতা শুধুই মানব-মানবীর চিরন্তন প্রেম ভালোবাসার প্রকাশ নয়। একটি সুনির্মিত কবিতা সমাজের অনেক প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। সমাজের নানা অনাচার দূর করতে কবিতা সমাজ বিপ্লব সংগঠিত করার ক্ষমতা রাখে। কবির জন্য কোন রাজনৈতিক মঞ্চের প্রয়োজন নেই। একটি কবিতা হতে পারে হাজারো রাজনৈতিক মঞ্চ। সমাজ থেকে দূরাচার, স্বৈরাচার বিতাড়িত করতে সাহসী হয়েছেন; কবিরা। তাদের লেখনী সমাজ পরিবর্তনরে হাতিয়ার হয়েছে। রুশ, বিপ্লব, ভারত বর্ষে বৃটিশ উপনেবিশিক শাসনের অবসানে, বাংলাদেশে স্বাধীনতায় পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে কবি-সাহিত্যিকরা সোচ্চার হয়েছেন।

যুগে যুগে কবি-সাহিত্যকরা এগিয়ে এসেছেন, অনাচার দূর করতে দূত হিসেবে। বলা যায় কবিতায় কবি একজন দূত। কবি হলেন সেই মানুষ যিনি সমাজকে অনুকরণ করেন, অনুশীলন করেন এবং একজন দূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আর কবিতা হলো সেই দূতের বার্তা। #
লেখক : শিল্প- সাহিত্যের সেবক, অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, পাবনা । ফ্লোরিডা, ইউএস প্রবাসী।