বনানী বাবলি: সবুজ : হ্যালো? শুভরাত্রি … ঘুমিয়ে গেলে না কি? ফোনের রিং হয় কিন্তু রিসিভ করছো না।
অন্বেষা : সুপ্রভাত … তোমার যতো কথা … ফোন নিয়ে মানুষ সারাক্ষণ হাঁটবে না কি ঘরে?
সবুজ : ফোন পকেটে রাখলেই তো হয় … এই জন্যই তো বলা হয় মোবাইল ফোন।
অন্বেষা : সব দেশের সব মেয়েদের পোশাকে পকেট থাকে না।
সবুজ : তাই তো …আমি যে কী … করলে কী সারাদিন? অফিস তো ছিলো না আজ।
অন্বেষা : স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে যে গানগুলি প্রচার হতো সেইগুলি শুনেছি… আর ঘরের কাজ করলাম গান শুনতে শুনতে-

সবুজ : হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি অংশুমান রায়ের কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গান “শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ” এবং গীতিকার ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার … কী অসাধারণ কথাগুলি … তারপর সেই রক্তে ঝড় তোলা গান “মা … গো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্ত প্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে …” কিংবদন্তি শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অমর গান … মুক্তিযোদ্ধাদের এই গানগুলি কী উদ্দীপ্তই না করেছিল …
অন্বেষা : হ্যাঁ ওটাও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ছিলো। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সেনাবাহিনী ও ভারতের জনগণের অবদান ভুলে যাওয়ার নয় একাত্তরে। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতারের দুই বাংলার শিল্পী, সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, কলাকুশলীর কাজ স্মরণীয় …

সবুজ : ঠিক তাই … স্বাধীন নবীন দেশ বাংলাদেশের মাটিতে পর্দাপন করার আগেই বঙ্গবন্ধু পানাম বিমানবন্দরে ভারতের জনগণ ও ভারতীয় সরকারকে বলেন, “ভারত হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। কৃতজ্ঞতার ভাষা আমার নাই।” তাঁদের অবদান কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়। তাছাড়া দেখো… একজন শিল্পী যখন অন্য একটি মৌলিক গানের শিল্পীর নাম এবং সুরকার, গীতিকারের নাম উল্লেখ করে গান শুরু করেন তখন বেশ ভালো লাগে। কিন্তু তার ব্যতিক্রম যখন হয় তখন মনে হয় এটা ঠিক নয়… এটা অন্যায়…
অন্বেষা : আমি ও তাই মনে করি … এটা অন্য শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি প্রকাশ করা … শুধু জনপ্রিয় গান গাইলে এবং সেই বিখ্যাত গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলে কিন্তু কার গান গাইলে বললে না … এতো ভালো লাগে না যখন তাঁকে স্মরণ করলে না ।
সবুজ : ২০১৯ সালের এক টুইট বার্তায় জানা যায় যে গানের পাখি লতা মুঙ্গেশকর তাঁর বেশ কিছু গানের রয়ালটি লিখে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক ফান্ডে এবং কথা ছিলো যতো দিন মুক্তিযুদ্ধ চলবে ততদিন এই সব গান থেকে প্রাপ্ত অর্থ জমা হবে সেই ফান্ডে… এটা ছাড়াও আরো অনেক অবদান তাঁর ছিলো একাত্তরে…
অন্বেষা : তাই বুঝি? জানতাম না তো এই কিংবদন্তির অবদান…

সবুজ : মনে আছে তো মার্কিন নাগরিক এলেন গিন্সবার্গের কথা? যিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন গান গেয়ে?
অন্বেষা : হ্যাঁ মনে আছে রবি শংকরের কথাও …যাঁর উদ্যোগে জর্জ হ্যারিসন, আল্লা রাখা, আলী আকবর, রিংগােষ্টার গান গেয়েছিলেন।
সবুজ : ছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান ও আরো অনেক শিল্পী … যাঁরা সম্মিলিতভাবে নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ারে কনসার্ট করে ১৯৭১ সালের অগাস্ট মাসের ১ তারিখে … লক্ষ্য ছিলো বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করে অর্থ সংগ্রহ করা।
অন্বেষা : তারপর সেই সংগৃহিত অর্থ টঘওঈঊঋ এর মাধ্যমে ভারতে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সাহায্য করা হয়েছিল … কত ত্যাগের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ একবার ভাবতে পারো?
.. আচ্ছা তোমার মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিনের কথা মনে আছে?
অন্বেষা : না মনে নেই … বলতো কে?

সবুজ : তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের অভিপ্রায়ে এদেশের একটি সাংস্কৃতিক দলের শরণাপন্ন হয়ে তাদের সাথে যুক্ত হন। তখন বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করে যেতো। এই শিল্পীদের সাথে থেকে লেভিন প্রায় ২০ ঘন্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান কারণ আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি সেই ডকুমেন্টারি তৈরি করে যেতে অক্ষম হন।
অন্বেষা : তারপর?
সবুজ : তারপর প্রায় দুই দশক পর ১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের কাছ থেকে এই ফুটেজ সংগ্রহ করেন একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে। এই দম্পতি আরো বিভিন্ন উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা সংরক্ষিত উপাদান সংগ্রহ করেন।
অন্বেষা : ও আচ্ছা এটাই তাহলে সেই মুক্তির গান নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র। এটি মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। পরবর্তীতে এই প্রামাণ্যচিত্রটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়। এই দেশপ্রেমিক প্রতিভাবান তারেক মাসুদের অকাল প্রয়াণ দেশের জন্য একটা বিরাট ক্ষতি হয়েছে …
সবুজ : সেটাই … তাঁর হয়তো আরো অনেক সমৃদ্ধশালী কাজ থেকে দেশ তথা দেশের মানুষ বঞ্চিত হলো।
অন্বেষা : ঠিক বলেছো … তারেক মাসুদ বেঁচে থাকলে দেশকে নিয়ে ওঁর চিন্তা ভাবনাগুলির প্রকাশ হতো … জহির রায়হানের ডকুমেন্টারী Stop Genocide নিশ্চয়ই দেখেছো?
সবুজ : নিশ্চয়ই …আরো দেখেছি Children of War, Investigation 360 (Documentary) মাটির ময়না (তারেক মাসুদ), ওরা এগারো জন, আমার বন্ধু রাশেদ …
অন্বেষা : বাহ্ বেশ বেশ …
সবুজ : এখন আর জহির রায়হানদের মতো মুক্তিযুদ্ধের উপরে কাউকে কাজ করতে দেখা যায় না … কারণ কী?
অন্বেষা : ভাবনার গভীরে চিন্তনের মন্থনে নূতনত্বের অমৃত উঠে আসে … মধ্যবিত্তরাই তো ভাবে এসব … তারা আজ এক হতাশার সাগরে ডুবে আছে .. যে দেশের মানুষের মেধার দাম নেই সেখানে নুতন মেধার সৃষ্টি সাধারণত সুপ্ত থাকে … অথবা বিলীন হয়ে যায় কালের গর্ভে …

সবুজ : বাঙালিকে আবার একটা প্রচন্ড এক জাগরণের মধ্য দিয়ে যেতে হবে …এইভাবে একটি দেশ চলতে পারে না … হয়তো আবার কোনো মুজিবের যদি জন্ম হয় …
অন্বেষা : হ্যাঁ… আবার যদি কোনো মুজিবের বজ্রকণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম” …. শঙ্খ কর ভোমিকের রচনা, সুর ও কণ্ঠে তাপস মৌলিকের গান শুনো …আচ্ছা ভালো থেকো।
সবুজ : “আওয়াজ ওঠাই… পদ্য ছুটাই…শব্দ ফোটাই..” আওয়াজ বুঝাই … টনক নড়াই… শব্দে লড়াই … চেতনা যোগাই কথা হবে পরে …এবার তবে যাই।