দেলওয়ার এলাহী : কাজের মধ্যেই এক ফাঁকে ওয়াহেদ ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে স্তম্ভিত হয়ে আছি? আমাদের পৈত্রিক গ্রামের নাম তেতৈয়া। মাঝখানে একটি গ্রামের সামান্যকিছু পার হলেই বাতর রাঙের গাঁও। ওয়াহেদ ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি বাতর রাঙের গাঁও। এদেশে বসবাস করা বাংলাদেশের গ্রামের প্রতিবেশী সূত্রে তিনিই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ।
হবিগঞ্জে পৈত্রিক বাড়ি হলেও, আমি বড় হয়েছি আমার আব্বার কর্মস্থল বিয়ানীবাজারে। বলতে গেলে নাড়ির সূত্র বাদ দিলে বন্ধুত্ব-বোধবুদ্ধি-ভালোবাসা আমার মধ্যে বাসা বেঁধেছে বিয়ানীবাজারের আলো হাওয়ায়। ওয়াহেদ ভাইও দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন। সেখান থেকেই অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ওয়াহেদ ভাই কানাডায় এসেছেন। কানাডায় আসার আগে ওয়াহেদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। কানাডায় এসে তিনি মারহাবা নামে গ্রোসারি ব্যবসা শুরু করেন প্রথমে আমার বাসার পাশে পার্লামেন্ট স্ট্রীটে। তখন থেকেই আমরা যেন এক পরিবারের মানুষ। এরও একটা কারণ আছে। সে গল্পটা বলি।

আমার দাদার চার ভাইয়ের একটিমাত্র বোন। তাদের এই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন বাতর রাঙের গাঁওয়ে। আমার বাপ চাচাদের এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অর্থাৎ আমাদের কাছে বাতর রাঙের গাঁও খুবই প্রিয় একটি গ্রাম। এবং বেড়ানোর জায়গা। আমার আব্বা এবং আব্বার চাচাতো ভাইবোনদের কাছেও বাতর রাঙের গাঁও খুবই প্রিয় জায়গা। এটা শুধু একারণেই নয় যে, তাদের একমাত্র ফুফুর বাড়ি ঐ গ্রামে। আরেকটি বাড়তি কারণ হলো আমার আব্বা, চাচা, ফুফু এবং তাদের চাচাতো ভাইবোনদের ফুফা ছিলেন সুফিবাদী ফকির? তাঁদের বাড়িতে বছরে একবার বেশ ঘটা করে গানবাজনা হতো। বিশাল খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হতো?

আমার আব্বা, চাচা ফুফু ও তাদের চাচাতো ভাইবোনরা আনন্দ ও উৎসব করে এই বাৎসরিক আয়োজনে রাত ব্যাপী গানের আসরে অংশগ্রহণ করতেন। এর পরেও তাদের ফুফাতো ভাইয়ের কাছে আব্বার চাচাতো বোন আমাদের সুফিয়া ফুফুকে বিয়ে দিয়েছেন। একদিকে ফুফাতো ভাই। অন্যদিকে ভগ্নিপতি। বাংলাদেশে থাকতে কিংবা বিদেশ থেকে হবিগঞ্জ গেলে, আমি অন্তত একবার হলেও বাতর রাঙের গাঁও বেড়াতে যেতাম আমার সুফিয়া ফুফুকে দেখতে।

বাতর রাঙের গাঁও গ্রামটি এমন যে, খোয়াই নদীর তীর ঘেঁষে লম্বালম্বি এর অবস্থান। টরন্টোয় ওয়াহেদ ভাইকে দেখলেই বাতর রাঙের গাঁও গ্রামটা চোখের সামনে ভাসতো। আমার সুফিয়া ফুফু [মাত্র দেড় মাস আগে সুফিয়া ফুফুও ইন্তেকাল করেছেন।] ও বন্দেক [বন্দে আলী] ফুফার মুখচ্ছবিটি চোখের সামনে ভাসতো। আর দেশে গিয়ে বাতর রাঙের গাঁও বেড়াতে গেলেও আমার ওয়াহেদ ভাইয়ের মুখচ্ছবিটি সামনে দেখতে পেতাম।

মরহুম মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহিদ

ওয়াহেদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমার সঙ্গে কথা না বলে একটা মিষ্টি মধুর হাসি দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন। যেন নীরবে বলে দিতেন বাতর রাঙের গাঁওয়ের অপরিমেয় মায়ার হাতছানি! বলতেন – ‘তুমিনু এইদেশে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ! আফন মানুষ!’ বলেই, আবার অপলক তাকিয়ে থাকা! আমার বড় অপরাধ বোধ কাজ করতো ওয়াহেদ ভাইকে দেখলে। মনে হতো আমার পূর্ব পুরুষের কোন এক প্রতিনিধি আমাকে দেখছেন। শুধুই দেখছেন না, পায়ে মাড়িয়ে আসা মমতার শিশিরগুলোও যেন কানে কানে এসে বলে যেত সেই মুহূর্তের ভাবনায়- আমাদেরকেও ভুলে গিয়েছো!

এই অনুভব, এই ভাবনা, এই আত্মকোলাহলের তোলপাড় কাউকে দেখাতে বা বুঝাতে পারবো না বলে, আমি ওয়াহেদ ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে থাকতাম! তবুও কদাচিৎ দেখা হলে ওয়াহেদ ভাই হাসিমুখে নির্বাক তাকিয়ে থাকতেন। আমার বড় অস্বস্তি লাগতো! আমি ওয়াহেদ ভাইকে সময় দিইনি, গল্প করার, তার গল্প শোনার!

এই লেখার শেষ কথা : পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা বাংলা। আর বাংলার সবচেয়ে মধুরতম আঞ্চলিক ভাষা হবিগঞ্জের ভাষা। ওয়াহেদ ভাই আমাকে দেখলেই বলতেন -‘আইচ্ছা, এমন কইরা ভুল্লে কেমনে হইবো!’ এই বাক্যটি বলেই ওয়াহেদ ভাই অপলক তাকিয়ে থাকতেন। আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টাই করতাম না। ওয়াহেদ ভাই ঠিকই বুঝতেন, যে দাবী নিয়ে তিনি এই বাক্যটির উত্থাপন করেছেন, এর কাছে আমি অসহায়। পরাজিত। আশ্চর্য, আমিও কোনদিন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য একটা শব্দও বলিনি!

এই টরন্টো শহরে আর কে আমাকে বাতর রাঙের গাঁওয়ের স্বপ্নের ছবিটি এঁকে দেবেন! যার রেখায় রেখায় তিরতির করে বহে চলে শীতে শান্ত ও বর্ষায় ভয়ংকর এক নদী, খোয়াই!