মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।
পনের.
এলিয়েস ও ফোরা ডিজনির পরিবারটি শিকাগো থেকে মিসৌরীর মার্সোলিনে আসার পর থেকেই ছয় বছরের ওয়াল্টের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। নতুন জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দ্রর্য পূর্বের জায়গায় চেয়ে আরো সুন্দ্রর। এই সৌন্দ্রর্যের মধ্যে ওয়াল্ট ডিজনি কি যেন মুগ্ধ হয়ে দেখে আর নিজের ড্রইং খাতায় সবকিছু আঁকানোর চেষ্টা করে। পাঁচ সন্তানের এই পরিবারটির একমাত্র কন্যা সন্তানটির বয়স তখন কেবল আট। রুথ নামের এই বোনটার প্রতি ডিজনির প্রীতি সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিদিনই বোনের কাছে তার গল্প শুনতেই হবে। ছোট্ট রুথও আরো ছোট্ট ভাইটিকে মনের আনন্দ্রে বানিয়ে বানিয়েই গল্প শোনাতে ভালোবাসতো। হয়তো তার কল্পনার মানস জগতে যে কাহিনী ঘুরপাক করতো সেটাই সে তার প্রাণপ্রিয় ছোট ভাইকে শুনিয়ে চলতো যাতে ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে কিছুটা সমীহ পাওয়া যায়। আট বছরের রুথ ছোট বেলা থেকেই ইঁদুর দেখেছে, কিন্তু কিছুদিন আগে পুডিং-এর থালার পাশে ঘুর ঘুর করা ইঁদুরটাকে দেখে সে বিস্মিত হয়ে পড়ে। হয়তো রুথ ছোট বলেই ইঁদুরটা একটুও ভয় পায়নি। টেবিল থেকে চেয়ার তারপর আলমারীর ওপরে নীচে ছুটোছুটি করা ইঁদুরটাকে দেখে তার মনে হয়েছিল ইদুরটি তাকে নাচ দেখাচ্ছে। সে চিৎকার করে পাশের ঘর থেকে ডিজনিকে ডাকার পরও ইঁদুরটা কোন ভয় পায়নি। রুথ-এর সাথে ডিজনিও তন্ময় হয়ে ইঁদুরের ছুটোছুটি দেখতে থাকে। তাদের মনে হয়েছিল, মনের আনন্দ্রে ইঁদুরটি নাচানাচি করছে আর ছোট্ট দুই ভাইবোনকে নাচ দেখাচ্ছে। এই অপূর্ব দৃশ্যে যখন দু’জনই বিমোহিত সে মুহূর্তে তাদের মা আসার ফলে ইঁদুরটি উধাও হয়ে যায়। তারপর দুই ভাইবোনের গল্প, আলোচনা আর কল্পনা ছিল ইঁদুরদের নিয়ে। ইঁদুরের বুদ্ধি, ইঁদুরের ছুটোছুটি আর নাচ দেখে তাদের মনে হয়েছিল ইঁদুরই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান প্রাণী।
সাত বছর বয়সে ওয়াল্ট যে ছবিগুলো আঁকতে শুরু করলো, সেগুলো রীতিমত সবাইকে অবাক করে দিত। অদ্ভুত বিষয়, পাড়ার তার বয়সের ছেলেমেয়েরা ওয়াল্টের কাছে আসতো তার আঁকা ছবিগুলো কিনে নিতে। হয়তোবা চকলেট বা রং পেন্সিলের বিনিময়ে। বিশেষ করে কারো জন্মদিনে ঘর সাজানোর জন্যতো ওয়াল্টের আঁকানো ইঁদুর আর বিভিন্ন ছবি ছাড়া চলতো না। সেই সময়ই ওয়াল্ট তার আঁকানো বুদ্ধিদীপ্ত ইঁদুর মশাইয়ের নাম রেখেছিল মিকি মাউস।
বিশ্ব চলচ্চিত্রে যদি দুটি চরিত্রের কথা উল্লেখ করা হয় যারা প্রায় এক শতাব্দী ধরে বিশ্বের চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়। তাদের মধ্যে নিঃসন্দ্রেহে প্রথমে চলে আসে ভবঘুরে চার্লি চ্যাপলিনের নাম, আর তার পরেই কার্টুন মিকি মাউসের ছটফটে ছোট্ট বুদ্ধিমান ইঁদুরটি রক্ত মাংসের কোন প্রাণী নয়। কিন্তু গভীর আগ্রহে দীর্ঘদিন ধরে ছেলে বুড়ো সবাইকে সে আনন্দ্র দিয়ে আসছে। এই ইঁদুরটির স্রষ্টা ও অ্যানিমেটেড কার্টুন ছবির পথিকৃৎ ওয়াল্টার এলিয়েস ডিজনি চলচ্চিত্র শিল্পে যে নতুন ধারার জন্ম দিলেন তা বর্তমানে না থাকলে এই বিজ্ঞানের ছুটে চলার যুগে শিশুদের জীবন আরো অনেক বেশি নিরাসক্ত ও একঘেঁয়েমিতে ভরে থাকতো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ১৯০১ সালের ৫ই ডিসেম্বর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ওয়াল্ট ডিজনির জন্ম হয়। বাবা এলিয়েস ডিজনির পূর্ব পুরুষ ছিল আইরিশ। আর মা ফোরা কল ডিজনির পূর্ব পুরুষরা আমেরিকায় এসেছিলেন জার্মানী থেকে। ওয়াল্টের শিশু বয়সেই এলিয়েস ফোরা পরিবারটি শিকাগো থেকে মিসৌরীর মার্সোলিইন এ গিয়ে নতুন বসতি গড়ে তুলে। ওয়াল্ট পরিবারের খামার বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে সান্তা ফি রেললাইন। এলিয়েসের ছোট ভাই মাইক মার্টিন ছিলেন রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। মার্টিন বড় বেশি ভালোবাসতো ওয়াল্টকে। ওয়াল্টের প্রতি তাঁর বিশেষ ভালোবাসার জন্ম হয় যখন ইঞ্জিনিয়ার চাচা লক্ষ্য করতেন, তার ভাইয়ের ছেলেটি অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা। মাঝে মধ্যেই দেখা যেত সে রেললাইনে কান পেতে দূরবর্তী ট্রেনের আসা যাওয়ার খবর নিত। বিষয়টি তার কাছে বড় অদ্ভুত লাগতো। সেই সাথে ছোট্ট ওয়াল্ট খামার বাড়ির পাশের ঘন জঙ্গলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখতো খরখোশ, ইঁদুর বা বেজির মত সব ছোট ছোট প্রাণীর চলাফেরা। এই চলাফেরা দেখতে দেখতে সে প্রায়ই প্রকৃতির মধ্যে বসে পড়ে এই সব প্রাণীর চমৎকার ক্যারিক্যাচারের সব ছবি আঁকতো। ওয়াল্ট মেকিংলে হাই স্কুল ভর্তি হলেও একই সঙ্গে রাতের শিফটে ভর্তি হলেন একাডেমী অব ফাইন আর্টসে। উদ্দেশ্য ছিল, ছবি আঁকার দতা বাড়ানো। ১৯১৮ সালে ওয়াল্ট সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একজন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন। ১৯১৯ সালে তিনি যুদ্ধের চাকুরী থেকে ছুটি পান।
বাড়িতে ফিরেই তাঁর মধ্যে ছবি আঁকার নেশা আরো প্রবলভাবে জেঁকে বসে। দীর্ঘদিন যুদ্ধ ক্ষেত্রে তিনি ছবি আঁকা থেকে দূরে ছিলেন। ফলে শুধু নিজে নিজেই ছবি আঁকা নয় বরং ছবি আঁকার খুঁটিনাটি আরো ভালভাবে রপ্ত করার জন্য এবং বিজ্ঞাপন চিত্র আঁকিয়ে জীবিকা অর্জনের স্বপ্নে তিনি ক্যানসাসে ফিরে কমার্সিয়াল আর্টিস্টের শিক্ষানবীশ হিসেবে বিজ্ঞাপন চিত্র আঁকবার ট্রেনিং নিতে থাকেন। এর মধ্যে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে ইউব ওয়ার্কস নামে তাঁরই এক সহপাঠীর সাথে। ইউব ওয়ার্কস সত্যিকার অর্থে ছিলেন একজন প্রতিভাবান এবং পরিশ্রমী শিল্পী। ১৯২২ সালে দুই বন্ধু ক্যানসাস শহরেই একটি বিজ্ঞাপন সংস্থা খুলে বসেন। এ্যানিমেশন জগতে বর্তমানে ইউব ওয়ার্কস এর নাম সাধারণত সাধারণ মানুষজন জানেন না। ওয়াল্ট ডিজনিই শুধু সবার কাছে একটি পরিচিত নাম এবং এই জগতের পথিকৃৎ হিসেবে সম্মানীত। কিন্তু ডিজনির এই সাফল্যের মূলে ছিলেন তাঁর বন্ধু ওয়ার্কস। বলা যেতে পারে, ওয়ার্কাসই ডিজনির সাফল্যের দ্বার খুলে দেন। তখন ক্যানসাস একটি ছোট্ট শহর আর বিজ্ঞাপনও তেমন একটি প্রসার লাভ করেনি। ফলে ১৯২৩ সালে ওয়াল্ট ডিজনি তাঁর বড় ভাই রয় ডিজনি এবং ইউব ওয়ার্কাস নতুন স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা করলেন হলিউডের পথে। হলিউড তখন কেবল জমতে শুরু করেছে এবং নিউইর্য়ক থেকে চলচ্চিত্র কেন্দ্র্র এবং চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন স্টুডিও ইতোমধ্যে হলিউডে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। এতদিন ডিজনি ও ওয়ার্কাস শুধু বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাবতেন এবং এর মাধ্যমে জীবিকা উপার্জনের চিন্তা করছিলেন। তারা হঠাৎ জীবিকার ঝুঁকি নিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পের এক ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে অবশ্যই এই উদ্দীপনা এবং সব কাজে মূল ব্যক্তি হিসেবে বরাবরই প্রধানতম ভূমিকা পালন করেন ওয়াল্ট ডিজনি নিজেই।
হলিউডে আসার পরের বছরই অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র শুরু করার জন্য ডিজনি কাজে নামেন। পৃথিবীর চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে অপার বিস্ময়ে মনে হতে থাকে, চলচ্চিত্র তাদের এ কোন জগতে নিয়ে যাচ্ছে? প্রাণহীন আঁকানো প্রাণীদেরও চলচ্চিত্র প্রাণ দিচ্ছে! ডিজনির পরিকল্পনা এবং প্রযোজনার প্রথম অ্যানিমেটেড ছবি হচ্ছে অ্যালিস ইন কার্টুনল্যান্ড। এই নামে বেশ কয়েকটি ছবি করা হয়েছিল। বিষয়টা ছিল একটা সিরিজের মত। ছবিগুলোর দৈর্ঘ্য ছিল এক রীলের মত অর্থাৎ প্রায় দশ মিনিটের। একজন অভিনেত্রীর অভিনয়ের সঙ্গে হাতে আঁকা জীবজন্তুর কার্টুন চিত্রের সমন্বয়ে এই ছবিগুলি তৈরি করা হয়েছিল। ডিজনি যে সাফল্যের প্রত্যাশা করেছিলেন, সেটা ব্যর্থ হয়। ফলে এক প্রকার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখনো তিনি মিকি মাউসকে তাঁর ছবিতে আনেননি। উল্লেখ্য, ছোটবেলায় ইঁদুর ছাড়াও যে প্রাণীটার প্রতি ডিজনি দুর্বল ছিলেন, সেটা হল খরখোশ। “অ্যালিস ইন কার্টুনল্যান্ড” এর অসফলতার পর তিনি নিরাশ হয়ে আরো বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে থাকেন যাতে তাঁর তৈরি ভিন্ন ধরনের ছবিগুলি দর্শকপ্রিয়তা পায়। বলা যেতে পারে, রাতের পর রাত অসীম ধৈর্য আর কঠোর অধ্যাবসায় চালিয়েছেন তিনি। সেই সময় তাঁর পাশে সব সময়ই পরম জনের মত ছিলেন বন্ধু তাঁর ইউব ওয়ার্কাস।
১৯২৮ সালে ওয়াল্ট ডিজনি তৈরি করলেন “অসওয়াল্ড, দি লাকি র্যাবিট”। ছবিটা একটু সাফল্যের মুখ দেখলো। তখনই ওয়াল্ট বন্ধু ওয়ার্কস এর সাথে মিকি মাউস তৈরির পরিকল্পনা করলেন। ওয়ার্কাস যেহেতু ছবি আঁকাতেই ব্যস্ত থাকতেন, ফলে তিনি মিকি মাউস এর ছবি আঁকতে শুরু করলেন আর একে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া এবং দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সমস্ত কাজই করতে লাগলেন ডিজনি নিজেই। ডিজনির দতায় কার্টুন ছবিগুলো সত্যিকারের চলচ্চিত্রে রূপ নেয়। সেই সময় চলচ্চিত্র নির্বাক থেকে সবাক এর যুগে প্রবেশ করছে। ডিজনি নিপুন দতায় অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রে শব্দ, সঙ্গীত ও সংলাপ প্রয়োগ করে বসলেন। খুব ভালো ফল পাওয়া গেল। দর্শক কার্টুন ছবিগুলো দেখে আনন্দ্রে ফেটে পড়ল। দর্শক বিষয়টি আরো সুন্দ্ররভাবে গ্রহণ করল যখন দেখল প্রতিটি কার্টুন ছবিতেই এক একটি গল্প আছে। যেগুলো দেখে মনে হয় আমাদের আশেপাশেই ঘটছে। “অসওয়াল্ড, দি লাকি র্যাবিট”-এর সাফল্যের বছরই ডিজনি প্রথম মিকি মাউসের চরিত্র নিয়ে তৈরি করলেন “পেন ক্রেজি, গ্যালোপিন গাউচো” এবং “স্টীমবোট উইলি” নামের তিনটি ছবি। অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে ছবিগুলি। এর মধ্যে শেষেরটি ছিল অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের প্রথম সবাক ছবি। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছবিটি নিউইয়র্কে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রের এই নতুন ধারাকে জনপ্রিয় করার জন্য অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওয়াল্ট ডিজনির জনপ্রিয়তা আমেরিকার সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে যখন অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তার বিজয় রথের যাত্রা শুরু করেছে, তখন স্বভাবই সাধারণ দর্শকদের মাথায় ঢুকছিল না একটি চলচ্চিত্রে ইঁদুর, খরখোশ বা এমনসব প্রাণী কিভাবে অভিনয় করে বা কোন যাদুবলে পরিচালক তাদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে নেন। উল্লেখ্য, সাধারণ ছবিতে অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয় ও তাদের গতিবিধির ছবি ক্যামেরায় তোলা হয়। পর্দায় যখন এই ছবিগুলির প্রক্ষেপন হয়, তখন সেকেন্ডে চব্বিশটি করে ফ্রেম বা স্থিরচিত্র পর পর প্রপ্তি হয়ে একটি গতিশীলতার মায়া সৃষ্টি করে। ক্যামেরায় কখনো চলৎ বা মুভিং ছবি উঠে না। প্রকৃতপক্ষে, এক এক সেকেন্ডে চব্বিশটি করে স্থিরচিত্রের সমন্বয়েই চলমান ছায়াছবি সৃষ্টি হয়ে থাকে। অ্যানিমেটেড ফিল্মেও এসব কার্টুন চরিত্রের জন্য সেকেন্ডে চব্বিশটি করে স্থির চিত্র বা ফ্রেমের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু যেহেতু কার্টুনগুলো কোন জীবন্ত প্রাণী নয় এবং নিজেদের আপনা আপনি চলার কোন মতা নেই। সে জন্য পরিচালক যে গতিতে বা যেভাবে চরিত্রগুলির গতিবিধি চিত্রিত করতে চান, ঠিক সেইভাবে এক সেকেন্ডে চব্বিশটি ছবি আঁকিয়ে ক্যামেরার সাহায্যে এক একটি করে ফ্রেমের ছবি তুলতে হয় সে জন্য দশ মিনিটের কার্টুন ছবি তুলতে হলে প্রয়োজন পড়ে চৌদ্দ হাজার চারশত ছবির। আর দেড় ঘন্টা দৈর্ঘ্যরে একটি পূর্ণাঙ্গ অ্যানিমেটেড ছবির জন্য প্রয়োজন হয়ে থাকে মোট এক লক্ষ উনত্রিশ হাজার ছয়শোটি ছবির। একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র বানাতে হলে পরিচালককে কাহিনীর সাথে সঙ্গতি রেখে এতগুলো ছবি শিল্পীদের দ্বারা আলাদা আলাদাভাবে আঁকিয়ে নিতে হয়। নিঃসন্দ্রেহে অপরিসীম ধৈর্য ও নিষ্ঠা না থাকলে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র বানানো কখনো সম্ভব নয়।
ওয়াল্ট ডিজনির মিকি মাউসের ছবিগুলো দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা পাবার সাথে সাথে নতুন উদ্যমে তিনি শুরু করে দিলেন আরো কিছু ছবি তৈরির কাজ। স্বপ্ন দেখতে লাগলেন তাঁর মিকি মাউস চরিত্রকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। ১৯২৯ সালে সিলি সিম্ফনি নামে তিনি তৈরি করলেন আরেকটি সিরিজ। এই সিরিজের প্রথম ছবির নাম দি “স্কেলিটন ড্যান্স”। পরবর্তী দশ বছরে এই সিরিজের প্রায় সত্তরটি স্বল্প দৈর্ঘ্যরে ছবি তোলা হয়। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১৯৩৩ সালে তৈরি “থ্রি লিটল পিগস” ছবিটি। লোক সাহিত্যের উপাদানের উপর ভিত্তি করে করে তোলা ছবিগুলোর জন্য ডিজনি জনপ্রিয়তার সাথে সাথে প্রচুর অর্থ আয় করতে থাকেন। ১৯৩৩ সালেই তিনি “ফাওয়ার্স এন্ড ট্রিজ” নামে একটি অতি জনপ্রিয় ছবি করেন। ছবিটি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র জগতের প্রথম রঙিন ছবি। (চলবে)