হিমাদ্রী রয়: কালের আদেশ বর্ষকাল হলো শেষ। জীবন বাড়িয়ে আয়ু কমিয়ে আবার এলো অপার সম্ভাবনার তিন শত পয়ষট্টি দিন। গেছে যে দিন শুধুই কি বেঁচে থাকার ঋণ? কিছুই কি পারিনি দিতে এমন নয় যে দেখিন হিসেব কষে কিন্তু সময় তো আর থাকে না নিজের হাতে।
আমিও তোমার মতই একজন যে ভাবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, আসবে আগামীকাল বদলে যাবে হাল সুমনের স্মৃতির গীটার এখন, উড়ায় সুরের ধুলো যখন তখন, হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কন্ঠ ছাড়ো জুড়ে তোমায় আমায় দেখা হবে অন্য গানের ভোরে।
ইচ্ছের ফানুস উড়িয়ে বিশ বছর আগের একদিন বেরিয়ে ছিলাম ঘর থেকে এক ভোরে। পেছনে মা ছিলেন সকল অশুভ কাটাতে কনুই আঙুলে কামড় কেটে বলেছিলেন ‘ডাকে পাখি না ছাড়ে বাসা এই হলো উষা’ যাত্রা শুভ। শুভই তো স্বপ্নের দেশ বিষয় বাসনা অর্জনের এখনও শেষ নেই। বছর এসেছে বছর গিয়েছে অনন্তের পথে, মা গিয়েছে যে পথে। এই ভোর আর আসে না, শুধু আমি কেন আমার মত অনেকের জীবনে। তোমার মত একই দুঃখ ভোগ নিয়ে আমিও বাঁচি শুধু বছরগুলো যোগ হয় বয়সকালে শুধুই বিয়োগ। অভ্যেস বদল হয় আর বদঅভ্যেসগুলো হয় বুড়ো। এভাবেই বছর বছর হারায় তবে থাকে অধিক কিছু, পুরনো কথা, সুখস্মৃতি, বিষব্যাথা বছরের না থাকা জুড়ে। অনেক বিয়োগ, কিছু বোধ, কিঞ্চিত সহানুভূতি আর প্রাণ ভরে বাঁচার আকুতি দিয়ে যায় বর্ষবিদায়।
গতকাল বছরের শেষ সূর্যাস্তের মধ্যদিয়ে প্রবেশের ছাড়পত্র হাতে পেলো ২০২২। গেলো তিন বছর মারণব্যাধি আমাদের এক সুতোয় বেঁধেছে আমরা আর আমাদের বেঁচে থাকা এক সূচের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে। এই ভিড়ের মধ্যে একা চলা নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা। তবু এখনো জানিনে যা কিছু ভালো নিজের ভিতর করে আছে আলো শুধু ধরতে গেলে আর মেলে না কিসের যেন একটা অক্ষমতা।
তবু ভালো মন্দের দন্দ ভুলে দেখেছি জীবনে খাতা খুলে, আমার জায়গায় আমি পরিপূর্ণ তোমার জায়গায় তুমি। আসছে নতুন দিন, প্রতিদিন একই পাপক্ষয় জানে জানুক অন্তর্জামী। দৃষ্টিভঙ্গির বদল হলে দৃশ্য পাল্টে যায়। আমার জায়গায় তোমাকে আর তোমার জায়গায় আমাকে তুলনায় বসিয়ে দেখলেই ক্ষোভ, যন্ত্রণা, ইর্ষা প্রতিদিন।
ছোট ছোট দেওয়ার মধ্য বড় বড় দোয়া লুকিয়ে থাকে। গতকালের স্কারবরো টাউন সেন্টারে সপিং শেষে ফুড কোর্টে খাবার শেষে ময়লা ফেলার সময় বৌকে দেখলাম এক প্রবীণা পরিচ্ছন্ন কর্মির সাথে কথা বলছে, জানতে চাইলাম পূর্বপরিচিত কিনা না? এভাবেই হাই হ্যালোতে পরিচয় বলে এক সময় সে সপিং ব্যাগ থেকে একজোড়া হাতমোজা আর লোশন তুলে দিল প্রবীণার হাতে “এগুলো তোমার জন্য আমার ক্রিসমাস ও নতুন বছরের গিফট”।
প্রবীণা বিব্রত হলেও জশের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে ইতস্তত করে উপহার নিলেন। চোখেমুখে অকৃত্রিম হাসি একটি গোলাপের উপর ভোরের সূর্যের কিরণ যেমন শিশিরকে হাসায় ঠিক তেমন। প্রবীণার আশীর্বাদ চেয়ে বিদায় নিলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে বৌকে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা কিভাবে উদযাপন করছি একত্রিশের রাত। তার উত্তর অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় “পৃথিবীতে এত বাতাস তবু কারো ফুসফুস এতটুকু হাওয়ার জন্য কাতরাচ্ছে, চেনা অচেনা এত মৃত্যু ভেসে উঠে চোখের ভিতর তবু এখনো ঈশ্বর শ্বাস দিয়ে জাগিয়ে রেখেছেন আরো একটি নতুন দিন দেখবো বলে, এত ক্ষুধা তবু বছরের শেষ দিনের গ্রেইন আমার ভাগে তিনি দিয়ে রেখেছেন, এত ছুটে চলার মাঝে বিনা হাসিতে বছর হারিয়ে যায় আজ শেষ দিনেও ঐ প্রবীণার মুখে সেই নির্মল হাসিটি আমাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন, এই আমার Joy so Honey enjoy your thirty first.” না বড়দিন কিংবা বছরের শেষ দিন আমাদের বসা হয়নি কোন আড়ম্বর পেতে।
নিজেকে জাগানো সহজ নয় নিজেকে দিয়েই বুঝতে হয়। একসাথে বাঁচি, কোভিডের ভয়ে লুকিয়ে এক সাথে হাঁচি, দুজনেরই বাস এক ছাদেতে তবু নিজেরে পারিনি জাগাতে।
নতুন বছর আসুক আরো হাসি নিয়ে হাসাতে, নতুন বছর আসুক বেশি বেশি ভালবাসাতে কান্নাহাসির আড়ালে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো রবীন্দ্রনাথ কখনো কন্যা কখনো জননী আর কখনো জায়া হয়ে জাগিয়ে রেখো।
“তোমায় গান শোনাবো তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো
ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাকো”।
লেখক, আবৃত্তিকার।