মণিজিঞ্জির সান্যাল : চৈত্র এবং বৈশাখ এই দুটো মাস অদ্ভুত দোলা দেয় প্রকৃতির প্রাঙ্গনে, মানুষের হৃদয়েও। বিশেষ করে চৈত্রের শেষ বেলায়। একজন আর একজনকে বিদায় জানাতে একের পর এক গান গেয়ে যায় প্রকৃতির বুকে। কোকিলও তখন কুহুকুহু ডাক ছেড়ে যেন একটু বিশ্রামের অপেক্ষায়! কিম্বা প্রকৃতিও যেন ধরা গলায় বলে ওঠে “না যেয়ো না, যেয়ো না তুমি…” এই বলে বসন্তকে যেন সে আরও একটু সময় থেকে যেতে বলে। এ এক অদ্ভুত সময় চৈত্র শেষের বেলা। সেই উপলক্ষে বৈশাখও যেন কিছুটা সময় দিতে চায় চৈত্রকে। শেষের শেষ মুহূর্তে আরও একটু সেজে নিতে সেও ব্যস্ত। বাঙালিও তার নিজস্ব ছন্দে চৈত্রকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে বৈশাখের জন্য বরণ ডালা সাজাতে প্রস্তুত। নিজেকে সাজিয়ে তোলে আরো আরও বেশি করে। পয়লা বৈশাখ প্রতিটি বাঙালির তাই প্রিয় এক উৎসব, ভালোলাগার উৎসব, ভালোবাসার উৎসব।

আজকের সাধারণ বাঙালি জীবনে যে কয়েকটি দিন সারা বছরের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, গøানিকে ভুলিয়ে দিয়ে মনের মধ্যে নতুন আনন্দের উচ্ছ্বাস জাগিয়ে তোলে, সেই দিনগুলির মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা নববর্ষের সূচনাকাল। বাংলা নববর্ষ সুদীর্ঘকাল ধরে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বর্ষ বরণের অনাবিল আনন্দে উদ্ভাসিত বাঙালির জীবন পুরনো বছরের সকল দুঃখ ও গøানির কথা ভুলে নতুন করে বাঁচার আশায় বুক বাঁধতে থাকে।

এই প্রসঙ্গেই কবি লিখেছেন—
“নিশি অবসান,ওই পুরাতন
বর্ষ হলো গত
আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন
করিলাম নত
বন্ধু হও শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বছরের সাথে
পুরাতন অপরাধ যতো।”

বাংলা সালের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বহুকাল আগে থেকেই সৌর বছরের প্রথম দিন বাংলা, আসাম, কেরালা, মনিপুর, নেপাল ইত্যাদি বিভিন্ন ভারতীয় প্রদেশে মূলত ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে নববর্ষ পালিত হতো। অন্যদিকে আবার বহু ঐতিহাসিক মনে করেন যে বাংলা বর্ষপঞ্জিকার পরিমার্জন এর মাধ্যমে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থাকে একটি সুষ্ঠু রূপ দেওয়ার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর সৌর পঞ্জিকা এবং হিজরি সনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন। কিন্তু বহু ঐতিহাসিক আবার এইসব কথাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে দিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে হিন্দু ঐতিহ্যের বিক্রমী দিনপঞ্জীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন।

একথা সত্য যে প্রত্নতাত্তি¡ক খননের ফলে আকবরের শাসনকালের বহু আগেও বাংলা বর্ষপঞ্জিকা এবং নববর্ষ উদযাপনের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। সেজন্য আকবরকে বাংলা বর্ষপঞ্জির উদ্ভাবক বলে ধরে নেওয়া যুক্তিসম্মত হবে না। আধুনিক গবেষণার ফলে মনে করা হয় গুপ্তযুগীয় বঙ্গসম্রাট শশাঙ্কের শাসনকালেই বঙ্গাব্দের সূচনা হয়।
বাংলা নববর্ষের কথা বলতেই সবার প্রথমে যে দিনটির কথা আমাদের মনে আসে তা হল পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ। এই দিনটি বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। এই দিনে দেশ ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ তো বটেই তার সাথে ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যের কিছু অংশেও বাংলা নববর্ষ মহা ধুমধাম সহকারে পালিত হয়।

সাধারণভাবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল বাংলাদেশে নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। তবে কখনো তা একদিন পিছিয়ে এবছরের মতো ১৫ই এপ্রিল দিনটিতে পালিত হয়। বাঙালি এই সময়ে মেতে ওঠে নানা প্রকার উৎসবে। হালখাতা, বিভিন্ন শোভাযাত্রা, নানা ধরনের মেলা। এভাবেই নানা উৎসবের মধ্যে দিয়ে দিনটিকে উদযাপন করা হয়, একে অপরকে শুভ নববর্ষ অভিবাদন জানিয়ে। সকলের মঙ্গল কামনা এবং প্রার্থনায় শুরু হয় বাঙলা নতুন বছর।

নববর্ষ এই বিশেষ দিনটি বাঙালির জীবনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটিতে বাঙালি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক সে তার জাতীয় ঐতিহ্য উদযাপনে মেতে ওঠে। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরের বাঙ্গালীদের মধ্যে কিছু বিশেষ প্রথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন এই দিনে বাঙালি পুরুষেরা সাধারণত পাঞ্জাবি ও ধুতি এবং মহিলারা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়িতে সেজে ওঠে।

তাছাড়া এই দিনে বাঙালির ঘরে ঘরে নানা পদের রান্নাবান্না হয়। পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলাদেশ এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে মহা আনন্দ সহকারে উদযাপন করে। চারদিকে পরম আনন্দের পরিবেশে বিভিন্ন মেলা ও উৎসব বাঙালি জাতির মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তাছাড়া সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালি জাতির কাছে এই দিনটি নিজেদের সংস্কৃতি চর্চার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। বাংলা লোকায়ত সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে বাংলার বিভিন্ন উৎসব। সেই সকল উৎসবের মধ্যে বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত বৈশাখী মেলা অন্যতম একটি।

বিভিন্ন গ্রাম থেকে শিল্পীরা তাদের আঞ্চলিক শিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য এই মেলায় নিয়ে আসেন। বাংলার গ্রামীণ পটচিত্র, তথা বিভিন্ন লোকগান, লোকনৃত্য ইত্যাদি এই মেলাতে স্বকীয় মর্যাদা লাভ করে। নববর্ষের আনন্দ উদযাপনের মাধ্যমে বাংলার হারিয়ে যেতে বসা আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে মর্যাদা দান এবং পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস এই মেলার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করা যায়।

আমরা নববর্ষ মানেই বুঝি হালখাতা। তবে জানেন কি নববর্ষের সঙ্গে হালখাতার কোনও সম্পর্কই ছিল না। পরে এই হালখাতা নববর্ষের সঙ্গে যোগ হয়েছে। মনের মধ্যে প্রশ্ন আসতেই পারে কিরকম সেটা? ব্যাখ্যা করে বললে, এর ইতিহাস একেবারে আদিমযুগের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষ যখন লাঙলের ব্যবহার শিখল। তখন তারা এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল। এবং তখন চাষ করা দ্রব্যের বিনিময় প্রথা শুরু হল। এই হালের দ্রব্য বিনিময়ের হিসেবের জন্য একটি খাতায় নিজেদের মতো করে তারা লিখে রাখতে শুরু করল। সেই সময়কার ভাষায়। এবং সেই খাতারই নাম ছিল ‘হালখাতা।’ হাল শব্দটি সংস্কৃত এবং ফারসি, দু’টি থেকেই এসেছে বলে দাবি করা হয়। সংস্কৃত হলে তার মানে লাঙল। আর ফারসি হলে হাল-এর মানে নতুন। তাই এই দু’টি শব্দই হালখাতার ক্ষেত্রে যথাযোগ্য।

প্রাচীণ হালখাতার অনুকরণে সম্রাট আকবর জমিদারদের বকেয়া রাজস্ব আদায়ের অনুষ্ঠান ‘পুণ্যাহ’ চালু করেছিলেন। তাই অনেকেই মনে করেন সম্রাট আকবর পয়লা বৈশাখ চালু করেছিলেন। কিন্তু তা নয়। তিনি ওই দিন রাজস্ব আদায় করতেন। এই এক নিয়ম মেনে বাংলার নবাব মুর্শীদকুলী খান ‘পুণ্যাহ’ পালন করতেন। সে সময় বহু জমিদাররা আসতেন খাজনা দিতে। নবাবি আমলে প্রাচীন হালখাতাকে ‘পুণ্যাহ’ নাম দেওয়া হয়। পরবর্তী কালে তা আবার ‘হালখাতা’তেই পরিবর্তীত হয়। সে অর্থে দেখতে গেলে হালখাতা রাজস্ব আদায়ের নাম ছিল, নববর্ষের দিনে যা পালন করা হত।

আমরা এখন যে ১লা বৈশাখকে নববর্ষ বা বছরের শুরু হিসেবে ধরি, এই রীতি কিন্তু শুরু হয় ৩১৯ সালে। সেই সময় থেকেই পাঁজি গণনা শুরু হয়। এর আগে বছরের গণনা শুরু হত হিম বা শরৎ কাল থেকে। ঋতু হিসেবে বছর গণনা করেতেও দেখা যায়। তবে পঞ্জিকা গণনার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালির পয়লা বৈশাখের শুরু না হলেও উৎসব পালনের শুরু। আর হালখাতা পয়লা বৈশাখের আর এক নাম। বর্তমান কালে এই দিন দোকানে দোকানে পুজো হয়। নতুন খাতা খোলা হয়। সামান্য কিছু দিয়েও খাতা খোলার রীতি এখনও রয়েছে। বেশ কিছু বছর ধরেই পয়লা বৈশাখ মানেই হালখাতা। নতুন বছরের শুরু। তবে ইতিহাস বলে ‘হালখাতা’ পয়লা বৈশাখের সঙ্গে জড়িয়েছে অনেক পড়ে। এর সঙ্গে সবচেয়ে প্রথম পরিচয় ঘটে বিনিময় প্রথার যুগের মানুষের। সে সময় পয়লা বৈশাখের কোনও চল ছিল না।

যাইহোক ফিরে আসা যাক আজকের সময়ে, আজকের পয়লা বৈশাখে, আজকের বাংলা নতুন বছর বা নববর্ষে। যে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আলোচনায় বাঙালির হালখাতা পালনের কথাও উল্লেখ করা বিশেষভাবে বাঞ্ছনীয়। নববর্ষের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালির উন্মাদনা বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবটির তাৎপর্য হলো বর্ষবরণ-এর শুরুতে ব্যবসায?িক হিসাবগত খাতার হাল-হকিকত যাচাই করে নেওয়া। তবে এই উৎসবটি সকল ব্যবসায়ী মহলেই পরম রসনার সঙ্গে পালন করা হয়। সকল আমন্ত্রিত ক্রেতাকে করানো হয় মিষ্টিমুখ। ক্রেতারাও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর কাছে নিজেদের ধার বাকি মিটিয়ে পরস্পর এক শুভ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গেও অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। যদিও গ্রাম বাংলার চরিত্র মূলত দুই বাংলাতেই একরকম, তবে উৎসবগুলির চরিত্র কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলাদা হয়ে থাকে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয় চড়কের মেলা, লোকগানের আসর, বাউল মেলা ইত্যাদি। আবার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান কলকাতাসহ অন্যান্য শহরেও নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসব। তাছাড়া নববর্ষ উপলক্ষে পহেলা বা পয়লা বৈশাখের আগে থেকেই বাজারে চলতে থাকে চৈত্র সেল।

সাধারণ বাঙালিদের পাশাপাশি উভয় বাংলা সংলগ্ন বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যেও বাংলা নববর্ষ পালনের প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত রয়েছে। নববর্ষের সূচনালগ্নে এই সকল আদিবাসীরা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উদযাপন করে থাকে। প্রান্তিক অঞ্চলের এই সকল নৃগোষ্ঠী গুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ছোটনাগপুর, পুরুলিয়া, মালদা এবং মুর্শিদাবাদ এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি গুলির নববর্ষ উদযাপনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ