ভজন সরকার : সেদিন শতাব্দী এক্সপ্রেসে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা ফিরছিলাম। ফারাক্কার ওপর দিয়ে এলাম। মনের এক কোণে জলবন্টনের বৈষম্যটা গেঁথে ছিল। শুকনো পদ্মার খাড়িটা ভেসে উঠলো চোখে। খুবই ছোটবেলায় পদ্মায় স্টিমার ছিল। সে স্টিমার থেকে বাতি বেরুতো, দেখাতো আলোকিত কতো আলোর নিশানা। সে স্টিমার নেই। নেই পশ্চিম আকাশের সে দিগন্ত আলো-করা ঝিলিক-মারা রোশনাইও। খুব ছোটবেলার সে স্মৃতি শৈশবেই হারিয়ে গিয়েছিল বুকে বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস রেখে। এবার ফারাক্কা পাড় হতে হতে বুকের দীর্ঘশ্বাসটুকু আবার যেন ফিরে এলো নতুন করে।

কতদিন পদ্মা দেখি না। দেখি না নদীভাঙ্গা জলের ঢেউ। উজানে বসে ভাটির দীর্ঘশ্বাসে বুকটা যেন ভারী হয়ে এলো। কেন? জানি না। জানলেও বোঝাতে কি পারি কাউকেও? শুধু কষ্টটুকুই যা বাড়ে। নদীভাংগা মাটির চাঁইয়ের মতো ঝুপ ঝুপ ভেংগে পড়ে সীমান্ত পারাপারের বেদনা। আহা… কান্নারও আছে কতো রকমের অব্যক্ততা!

বোলপুরে এসে থামলো শতাব্দী এক্সপ্রেস। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে পড়লাম “শান্তিনিকেতন”। হঠাৎ করেই যেন বর্তমান নিমিষে পেরিয়ে গেল শত বছরের বাধা। শুভ্রকেশে কে যেন দাঁড়িয়ে। কেউ তো নেই। চোখের সামনে কেউ-ই তো নেই।
ভাবলাম, শুধু চোখ দু’টোই কি দেখায় মানুষকে? মনকে বুঝালাম, যাকে দেখার জন্য এত ঔৎসুক্য তিনি তো চোখের বস্তু নন; মনের ভিতরে যে সবুজ কুঠুরি তাঁর অবস্থান তো সেখানেই। তবে কেন এ বাইরের অণ্বেষণ? পর্দা টেনে দিলাম জানালার। ভাটিতে বসে উজানের জন্য বুকে এ কেমন দীর্ঘশ্বাস? এবার কষ্ট নয়, যেনো কত প্রশান্তি- অনেক অনেক যুগের ওপার হতে বহে আসা শীতল হাওয়ায় যেন এক স্নিগ্ধ অবগাহন। আহা—সুখেরও আছে কতো কতো রকমের অব্যক্ততা! অব্যক্ত কতো কতো ভালোবাসা আছে প্রতিদিন না-দেখা অথচ প্রতিক্ষণ বুকে রাখা সে মানুষটির জন্যও। সে মানুষটি রবীন্দ্রনাথ।

আমার মতো করে “আমার রবীন্দ্রনাথ”। আপনার মতো করে “আপনার রবীন্দ্রনাথ”। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মতো ক’রে বললে,
“কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায়-তোলা জল- প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।”
আমাদের রবীন্দ্রনাথ যেন “কেতকী” আর “লাবন্য” উভয়ের প্রতি “অমিত রয়”-এর ভালোবাসা। কখনো আমরা তুলে নিই, ব্যবহার করি নিজেদের প্রয়োজন মতো আবার কখনো সাঁতার দিই ভালবাসার স্নিগ্ধ অবগাহনে।

শতাব্দী এক্সপ্রেসের বন্ধ জানালা দিয়ে দেখলাম “রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন” দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল। কিন্তু মনের ভিতরে তখনো রবীন্দ্রদিঘি, যেখানে আমাদের অনন্ত ডুব সাঁতার। মনের ভিতরে তখন একটি গানের কথা “রূপ-সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপÑ রতন আশা করি”। রবীন্দ্রনাথ এ গানটি লিখেছিলেন ১২ পৌষ ১৩১৬ বংগাব্দে, শান্তিনিকেতনে বসেই।

ট্রেনটি শান্তিনিকেতন ছাড়িয়ে কলকাতার দিকে চলছে। “রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন” তখনও মনে। ফারাক্কা দেখে জল বৈষ্যমের যে তিক্ততায় মন ভারী হয়ে ওঠে; “আমাদের রবীন্দ্রনাথ” এবং “রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন” দেখে তা হয়ত স্তিমিত হয়ে আসে। কিন্তু কোথাও তো মনের গভীরে বেজে উঠেই “এপার বাংলা” এবং “ওপার বাংলা”। গলা ভরা বুলি শান্তি-স¤প্রীতি ছাপিয়ে হিংসে আর দোষারপের রাজনীতি এবং ধর্মীয় বিভাজনও কি খুব কম? আমাদের একমাত্র “অবিভক্ত রবীন্দ্রনাথ”-এর সাধ্যি কতটুকু যে, সে বিভাজনের কফিনে ঠুকে দেবেন শেষ পেরেক?

রবীন্দ্রনাথের “গোরা” উপন্যাসটি যতবার পড়ি নতুন করে চিন্তার খোরাক পাই।
গোরা যখন বলেন, “আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খৃস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।”
উপন্যাসের পরিশিষ্টে গোরা যখন আনন্দময়ীকে বলেন, “মা, তুমিই আমার মা। যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসে ছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই- শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ।”

তখন মনে হয় গোরার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ নিজেও এ রকম একটি ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র ছ’বছর পরে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমানের মিলিত যে ভারতবর্ষ দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁর স্বপ্ন-ভংগের চিতাভস্ম তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু অনাহার-দারিদ্র্য ও হিন্দু-মুসলমানের বিভেদের পদধ্বনি তিনি জীবিত থাকতেই দেখে গেছেন। তাঁর শেষ প্রবন্ধ “সভ্যতার সঙ্কট”-এ সে হতাশার কথা বলেও গেছেন।

পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁর “জেলখানার ডায়েরি”-তে সে কথাই লিখেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে, “এ বোধহয় ভালই হ’ল যে রবীন্দ্রনাথ মারা গেলেন; ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্ব জুড়ে যে ভয়াবহ ঘটনাগুলি নেমে আসার অপেক্ষায়, তাঁকে তা আর দেখে যেতে হল না। তিনি যা দেখে গেলেন তা-ই যথেষ্ঠ। অপরিমেয় বিষাদ ও মনোবেদনা তিনি ভোগ করে গেলেন।”

১৯৪৭ দেখতে হয়নি রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথকে দেখে যেতে হয়নি ১৯৭১-এর মৃত্যু-উপত্যকা এ বাংলাদেশকেও। দেখতে হয়নি তাঁরই বর্ণিত “মানুষ না হওয়া বাঙালি”-দের মধ্যে কিছু সংখ্যক পিশাচের বর্বরোচিত মানবতাবিরোধী অপরাধের নৃশংসতা।
রবীন্দ্রনাথকে দেখে যেতে হয়নি ধর্মীয় সংখ্যালঘুর নামে বাংলাদেশ-ভারতসহ নানাপ্রান্তের ঘটে যাওয়া নির্মমতাও!
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)