সাজ্জাদ আলী : কাঁচের দেয়ালের কিনারা ঘেঁষে বসেছি আমরা। মুখোমুখি দুখানা চেয়ারে। শান্তা কথা বলছে কম, হাসছে বেশি। মুচকি হাসি না, একেবারে গাল ভরে হাসে সে। অন্তত অর্ধেক কথার জবাব সে হাসির দোলনেই দেয়। সে ভাষা বুঝে নিতে হয়। বছর তিনেকের টেক্সট লেখালেখির পরিচয়, ফোনালাপও হয়েছে দু চারবার। তবে আজই প্রথম দেখা। ড্যাবডেবে চোখ তার। অনেকক্ষণ পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতে পারে। চওড়া কপালে টিপ পরেনি, খালিখালি লাগছে। শ্যামল বরন মুখখানা। গলা এবং বøাউজের বাইরে যতটা দেখা যায় তা অধিক শ্যামলা। কাপড় সরালে রং যে আরো উজ্জল বেরুবে তাতে আর সন্দেহ কী! কথাবার্তায় সে এতটাই সাবলিল যেন কতকালের চেনাজানা। অতুল প্রসাদ সেনের সেই গানটির মতো, “বহু দিন হতে যেন জানাশোনা, দেখাটুকু ছিলো বাকি…”

লাচ্ছির গেলাস প্রায় শেষ। আরো এক গেলাস বলবে কি না, এই কফি শপের কেক খুব ভাল, আখের রস খাবো কি না, ইত্যাদি সব আপ্যায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে শান্তা। রেস্তোরাঁটি ১১ তলার ওপরে। নিচে তাকালে সীমান্ত স্কয়ার শপিং কমপ্লেক্সে ঢোকা-বেরোনোর পথ চোখে পড়ে। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা এটি। শেষ যে বার এসেছিলাম তখন খুব সম্ভবত কমপ্লেক্সটির নাম ছিলো রাইফেলস স্কয়ার। রাস্তায় গিজগিজ করছে মানুষ। যেন মানুষের ওপর মানুষ লেপটে আছে। রিক্সা, সিএনজি, বাস, হকার, প্রাইভেট গাড়ি, পথচারী, যার যেমন খুশি ছুটছে। অসহায় ট্রাফিক পুলিশের বাঁশির ফু কেউ মানছে না। অতটা উঁচুতে বসে বিশৃংখলাগুলো যে ভাবে দেখছি, পাখিরা আকাশে উড়তে উড়তে আমাদের ঠিক সেভাবেই দেখে। গুগুল ম্যাপের ভাষায় যাকে বলে বার্ডস আই ভিউ।

শান্তার মুখখানা ভারি মায়াবী, চোখ ফেরানো দায়। ওকেই দেখছি মন ভরে। কিন্তু ওপর থেকে আমার পাখির চোখ জোড়া বারে বারে নিচে একটা বাচ্চা ছেলের ওপর গিয়ে পড়ছে। কমপ্লেক্সে ঢোকার প্রশস্ত ড্রাইভওয়েতে সে ছুটোছুটি করছে। ৫/৬ বছর বয়স হবে, ফুটফুটে ছেলেটি। কালো রংয়ের হুডি গায়ে, পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, পায়ে স্যান্ডেল। দুহাতে নানা রঙের অনেকগুলো ফুলানো বেলুন। বাবা-মা কিনে দিয়েছে নিশ্চয়ই। ছেলেটি দৌঁড়ে এক পথচারী থেকে আরেকজনের কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। কখনো বা রিক্সায় ওঠা নামা যাত্রীদের কাছে। আবার দেখি সে চলন্ত কোনো গাড়ির সাথে খানিকটা দৌঁড়ায়। ওরা কেউ অবশ্য তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।

অনেক উঁচু থেকে দেখছি বলে ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না। মনে হয় যেন ছেলেটি ছুটোছুটি করে লোকদের মনোযোগ পেতে চাইছে। কিন্তু কারো সাথে কথা বলছে বলে মনে হলো না। তবে কি সে হারিয়ে গেছে? উদ্ভ্রান্ত হয়ে তার মাকে খুঁজছে কি? না, তা কী করে হবে? সে তো কাঁদছে না! হারানো ছেলের কোনো লক্ষণই নেই তার মধ্যে। বেশ খানিকক্ষণ ধরে বাচ্চাটির গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। শান্তা বলল, কী দেখতেছো নিচে? চেনা কেউ নাকি?

আরে ওই যে বাচ্চাটাকে দেখছো শান্তা? দেখ বেলুন হাতে দারোয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে। অনেকক্ষণ ধরে ছেলেটা একা ওখানে। সম্ভবত ওর মাকে হারিয়ে ফেলেছে।
আমার দিকে চেয়ে আবার সেই মনকাড়া হাসিটা হাসলো শান্তা। তারপর বলল, বহু বছর বিদেশে থেকে দেশের দৃশ্যপট এখন আর আন্দাজ করতে পারো না তুমি।
মানে কী? কী বলতে চাও, বললাম আমি।
বলতে চাই যে ওই ছেলেটা বেলুন বিক্রি করছে।
আরে না। তা হবে কেন? চেয়ে দেখ ওর ফেরিওয়ালা টাইপ বেশভ‚ষা না। ভাল করে ওকে লক্ষ করো, দেখতে একেবারে ভদ্র ঘরের ছেলে। পোষাক আশাক দেখ, মোটেই হকার টাইপ না।

বন্ধু আজকাল শিক্ষিতরাও সন্তানদের দিয়ে পার্টটাইম রোজগার করায়। তুমি তো দেশের কোনো খবরই জান না। মা-বাবা ছেলেটাকে ওখানে বেলুন হাতে নামিয়ে দিয়েছে। ২/৪ ঘন্টা পরে আবার এসে ওকে তুলে নিয়ে যাবে। এই সময়ে বাচ্চাটা যা কিছু বিক্রিবাট্টা করবে মা-বাবার সেটাই লাভ।
এ সব কথায় ভারি বিরক্ত হলাম। বললাম, কি যাচ্ছেতাই বলছ শান্তা! অমন ফুটফুটে বাচ্চা হকার হতে যাবে কেন?
শান্তা বলল, কে হকার হবে না হবে তা আমি ঠিক করি নাকি? উঠে পড়ো তো, এখানে বসে এ নিয়ে তোমার সাথে তর্কে জিতবো না। নাটকপাড়া পৌঁছুতে অনেক সময় লাগবে, পথে ট্রাফিক জ্যাম আছে। বেরুনোর সময় ওই ছেলেটার থেকে তোমাকে বেলুন কিনে দেবোনে।
মনটা খুব খারাপ হয়েছে। এমন রৌদ্রঝরা বিকেলে অমন বয়সের একটা শিশুর তো ঘুড়ি উড়াবার কথা। খেলার মাঠে দৌঁড়ে বেড়াবার কথা। কিংবা বাবার ঘাড়ে চড়ে বেলুন ফুলাবার কথা। জগত সংসারের সব শিশুই তো প্রকৃতির সন্তান। তাহলে কেউ বেলুন বেচবে, আর কেউ তা ফুলাবে, এমন কেন হবে? আমার মনের অবস্থাটা শান্তা আঁচ করতে পেরেছে। লিফ্ট ভর্তি একগাঁদা মানুষের মধ্যেই সে আমার কাঁধে শান্তনার হাত রাখলো। হাঁটতে হাঁটতে আমাকে নিয়ে একেবারে ছেলেটির সামনে এনে দাঁড় করালো।

পরিপাটি জামা স্যান্ডেল পরনে তার। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, মায়াভরা দুটি চোখ। সে চোখ কিছুতেই বেলুন বেচার সাথে যায় না! ছেলেটি ঘাড় বাঁকা করে আমার দিকে চেয়ে একছড়া বেলুন এগিয়ে ধরলো। কি ব্রাইট একটা ছেলে রে বাবা! মন চায় ওকে কোলে তুলে নেই। ওর গাল টিপে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, নাম কি তোমার বাবা? কথা বলল না ছেলেটি, শুধু তাকিয়ে রইল। শান্তা পর পর দুবার জিজ্ঞাসা করলো, অ্যাই তোর বেলুনের দাম কত রে? শিশুটি শান্তার কথার জবাব দিলো না। এমনকি তার দিকে ফিরেও চাইলো না। সে আমার দিকে চেয়ে আছে। এবারে আমি জানতে চাইলাম, ব্যটা তুমি কি বেলুন বিক্রি করো?
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো শিশুটি।

আমি হাঁটুগেঁড়ে বসে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, তোমার বেলুনের দাম কতো?
আমার চোখে চোখ রেখে সে ছোট্ট করে বলে, কুড়ি!
শান্তা ছেলেটির গোটাগোটা আঙ্গুলের ফাঁকে একটা কুড়ি টাকার নোট গুঁজে দিয়ে আমার হাত ধরে টেনে রিক্সায় নিয়ে বসালো। চালক রওনা শুরুর তোড়জোড় করতেই শিশুটি দৌঁড়ে এসে রিক্সার পাদানি বরাবর আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বিষ টাকার সেই নোটটি ফিরিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বাড়িয়ে ধরলো।

আমি ঝুঁকে নিচু হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে? টাকা নেবে না?
মুখে কিছু বলল না সে। এবারে বেলুনছড়া এগিয়ে ধরলো আমার দিকে।
আমি বললাম, বেলুন দিয়ে আমি কি করবো বাবা? আমার বেলুন লাগবে না।
মুখে কোনো কথা নেই। ছেলেটি আবার সেই নোটটি বাড়িয়ে ধরলো আমার দিকে। ঠিক বুঝে উঠছি না সে কি চায়। শান্তার দিকে চাইলাম। শান্তা বলল, বেলুন না নিলে ও টাকা নেবে না। শিশুটির আরো কাছে ঝুঁকে বললাম, ওরে বাপ রে, তাই নাকি বাবা? তাহলে তুমি ওই লাল-হলুদ রঙের বেলুন ছড়াটা আমাকে দাও।
এক গাল হাসি ঝরিয়ে বেলুনছড়া আমায় দিয়ে সে আবার দৌঁড়ে ফিরে গেল মানুষদের ভিড়ে।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)