মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

পয়ত্রিশ.
পলিটেকনিকের ছাত্র থাকা অবস্থায় সোফির সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছিল। ২০০৩ সালের জুন মাসে স্টারলাইট চিলড্রেন ফাউন্ডেশন এর অনুষ্ঠানে আয়োজকরা তাদের সাথে থাকার জন্য আমাকে আহ্বান জানিয়েছিল। আয়োজনটা বেশ বড় ধরনের ছিল। গান বাজনার কাজটা করেছিল টনী বেনেট আর প্রিন্স এন্ড্রæ’র সাথে হাতে হাত ধরে সেখানে এসেছিলো বেলিন্ডা স্টোরনাখ। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব থিয়া এন্ড্রুস আর কুইবেক টিভি আর রেডিও’র এক চমৎকার সুন্দর উপস্থাপিকার সাথে সেই অনুষ্ঠানে আমার উপস্থাপনার ভার পড়েছিল। আমার মনে হলো, পরের জনকে আমি কোথাও আগে দেখেছি। তার নাম ছিলো সোফি গ্রেগরী। তার দিকে চোখ পড়ার পর থেকেই তাকে নিয়ে আমার ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমি নিজেকেই বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, কেনো আমার এত বেশি মনে হচ্ছে, আমি তাকে চিনি।

অবশেষে যখন আমরা একে অপরের সাথে কথা বলা শুরু করলাম, তখন সোফি আমার নিজের কাছে জানতে চাওয়া প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। সে আর মিশেল একই স্কুলে পড়তো আর সেই সময়ই তার সাথে বেশ কয়েক বার আমার দেখা হয়েছে। তার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ছিলো প্রায় চার বছর। কিশোর বয়সে ঐ পার্থক্য’টাকে সাধারণত অনেক বেশী মনে হয়। আমি এখনো তার সেই সময়ের মুখটা মনে করতে পারি। মনে হতো সে আমার চেয়ে অনেক বেশি ছোট, কিন্তু এখন আর আমাদের বয়সের সেই পার্থক্যটা চোখে পড়ে না।

সোফি আমার ছোট ভাই মিশেল’কে সেই থার্ড গ্রেড থেকে চিনতো, যখন তারা মন্ট্রিয়লে মন্ত-জেসাস-ম্যারী স্কুলে পড়াশুনা করতো, এবং তাদের আবার দেখা সাক্ষাৎ হয় ব্রেবফ এ যেখানে মিশেলের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে সোফির বন্ধুত্ব হয়। সোফির কাছে মিশেল ছিল কোমল হৃদয়ের এক বিপ্লবী যে সব সময় ব্যাপকতা আর বাইরের জগত পছন্দ করতো এবং যে কখনোই সংকীর্ণ কোনো দলাদলির মধ্যে থাকতো না। আমার যেটা মনে হতো, ব্রেবফ ছিল এমন একটা জায়গা যেখানে সংকীর্ণতা আর তোষামোদির এক ধরনের উপস্থিতি ছিল, কিন্তু সেই সময়ই মিশেলের এমন একটা সুনাম ছিল যে, সে সব সময় এ ধরনের নেতিবাচক অবস্থার একেবারে উর্ধ্বে থাকতো।

তখন আমাদের সবাইকে ছেড়ে মিশেলের চলে যাওয়ার পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর যে আবেগীয় প্রভাব আমার ওপরে পড়েছিল সেটা তখনও সামান্যটুকু মলিন হয়নি। আমি এখনও তার জন্য অপেক্ষা করে থাকি যদি সে ফিরে আসে, কারণ আমরা তার মৃতদেহ পাই নি। আমরা শুধু জানি তুষার ধসে সেই লেকের গভীরে সে তলিয়ে গেছে। কিন্তু আমি যখন সোফি’র সাথে মিশেলের অনেক সুন্দর সুন্দর বা কখনও কখনও কিছু কিছু হাস্যকর স্মৃতি নিয়ে কথা বলতাম, তখন মিশেল’কে হারানোর পর আমার হৃদয়ের গভীরে যে জমাট বাঁধা ব্যাথা ভার হয়ে চেপে বসেছিল, সেটা কিছুটা হালকা হতে শুরু করে।

টনি বনেট এর পরিবেশনার সময় উচ্ছৃংখল কিছু দর্শককে সামলানো ছাড়া সেই সন্ধ্যায় সোফি আর আমি চমৎকার সুন্দর সময় কাটিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, একেবারে নিশ্চুপে আর কোনো কিছু না বলেই একেবারে নীরবে আমরা দু’জন দু’জনার হয়ে গেছিলাম। সেই রাতে অনেক কথা, অনেক গল্প আর অনেক হৈ চৈ হয়েছিল, তবে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আমি উপলব্ধি করেছিলাম, সোফি একজন অসাধারণ মেয়ে।

কয়েকদিন পরই সে আমাকে ইমেইল করলো। সে লিখেছিল, সেই অনুষ্ঠান আর রাতের কথা যেটা ছিল তার জীবনে এক অন্যরকম সময়। আর আমার সাথে ওমনভাবে দেখা হওয়া তার ভিতর অন্যরকম এক আনন্দ এনে দিয়েছে এবং সে সব সময় আমার সর্বাংগীন মঙ্গল কামনা করে। তার কাছ থেকে ওমন কথা শুনে আমি আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম, আমি হয়তো মনে মনে চাচ্ছিলামও যে তার কাছ থেকে এমন কিছু যেন শুনতে পাই। কিন্তু এদিক দিয়ে আমি এমন ভীরু ছিলাম যে, দূরু দূরু বুকেও আমি তার মেইল এর উত্তর দিতে পারি নি। আমি তখনই বুঝে গেছিলাম, তার সাথে আমি যে সময়টা কাটিয়েছিলাম আর তার সাথে আমার যে কথা আর সখ্যতা হয়েছিল, তা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। সেই সাথে আমার কাছে সে সাধারণ কোনো মেয়েও নয়, এবং আমি তখন এটাও বুঝে গিয়েছিলাম, তার সাথে আমি যদি শুধু কফি পানের জন্যও একটা আড্ডা দিই তবে সেটার যে রেশ আমার জীবনে পড়বে, সেটা আমাকে সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে।

আমি তখন নিজের সাথেই বুঝাপড়া করছিলাম যে, সে যদি সত্যিই আমার কপালের লেখনীতে থাকে তবে এখানে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। এমন চিন্তা মাথায় নিয়েই তখন আমি আমার দিনগুলি কাটাচ্ছিলাম। ওর কয়েক মাস পরে, আগস্টের শেষের দিকে আমি বুলভার্ড সেন্ট-লরেন্ট দিয়ে একাএকি হাঁটছিলাম, হঠাৎ অপর দিক থেকে একটা চেনা কন্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকাতেই শুনলাম, ‘স্যালুট জাস্টিন।’

আমার কন্ঠস্বর থেকে শুধু অস্ফুটভাবে কিছুটা বিস্ময়ের সাথে তার নামটা উচ্চারিত হয়েছিল, তারপর তার দিকে ঘুরে কিছুটা দৌড়েই তার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। সে তখন তার বুকের কাছে তার দুই হাতটা একে অপরের সাথে লাগিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার সামনে গিয়ে আমার মুখ দিয়ে প্রথমেই যে কথাটা বের হয়েছিল, তা হচ্ছে, ‘আমি সত্যি দুঃখিত, আমি এখনো তোমার মেইল এর কোনো উত্তর দিতে পারিনি।’

আমার কথা শুনে সে কিছুটা ভ্রæ কুঁচকিয়েছিল, সে বুঝতে পারছিল যে আমি তাকে যে অবজ্ঞা করেছি, সেটা আমি তখন পুষাতে চাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি তখনই কিছুটা না ভেবেই বলে বসলাম, ‘আমি তোমার মেইলের উত্তর খুব দ্রুতই দিবো, তার আগে বলো, আমি কি তোমাকে ডিনারে নিয়ে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারি।’

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর প্রেমিকা-স্ত্রী সোফি গ্রেগরী ট্রুডো

আমার প্রস্তাবের উত্তরে সে শুধু আমাকে বলেছিলো, ‘আগে আমার মেইলের উত্তরে কিছু লাইন লিখে পাঠাও, তারপর দেখবো আমরা ডিনারে যেতে পারি কি না।’ আমার মুখের ওপর ওমনভাবে কথা বলে সে তখনই গট গট করে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গিয়েছিল।
তারপর কয়েক সপ্তাহ আমরা ফোনে আর ইমেইলে কথা আর গল্প চালিয়ে গিয়েছিলাম, আর আমি একেবারে নাছোড়বান্দার মত তাকে ডিনারে নিয়ে যাবার জন্য লেগেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সোফি ডিনারে যেতে রাজি হয়েছিল, তবে সে আমাকে একটা শর্ত দিয়েছিল, আমাদের ডিনারের জায়গাটা এমন এক জায়গাই হবে যেটা হবে আমাদের জীবনে একেবারে নতুন এক জায়গা। তার সেই শর্ত শুনে আর বাইরে একটা সুন্দর জায়গা খোঁজার জন্য আমি শাসা’কে ফোন করলাম। আমার মন মত একটা জায়গার ঠিকানা জানার জন্য আমি শাসা’র কাছে পরামর্শ চাইলাম। কারণ এমন নতুন আর সুন্দর সুন্দর জায়গার খোঁজ আমার চেয়ে তার কাছেই বেশী থাকতো, আর সে এ ধরনের জায়গায় যেতে ভালোও বাসতো। আমার অনুরোধে সে আমাকে ডুলুথ’এর ‘খাইবার পাস’ এর আফগান খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। সোফিকে ঐ জায়গাটার প্রস্তাব করার পর সে সেটা খুবই পছন্দ করেছিল। অতঃপর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তার পরের সপ্তাহেই আমরা ডিনারে যাবো আর আমি তাকে তার এপার্টমেন্টের সামনে থেকে তুলে নিবো। আমি তার ঠিকানা চাইলে সে আমাকে তার এপার্টমেন্ট এ যাবার ঠিকানাটা লিখে দিয়েছিল ঠিক এইভাবে – ‘পিয়েরে এলিয়ট ট্রæডো রোজ গার্ডেনের একেবারে সামনে’। (চলবে)
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো