ভজন সরকার : বইমেলা এলেই মনে হয় প্রশ্নটি। বইমেলা মানে কী? বইয়ের মেলা? মেলা (বহু) বই? কিংবা মেলা (খোলা) বই? না সব কিছুই?

এক দঙ্গল প্রকাশক নতুন পুরানো সহস্র বইয়ের পসরা সাজিয়ে রাখেন। সহস্র লেখক কয়েক সহস্র বই লিখেন। অন্তত বাংলাদেশের একুশে বইমেলার গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে প্রতিবছরে বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন সহস্রের অধিক; লেখকের সংখ্যা দেড় সহস্রাধিক তো হবেই। ১৮ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে ১৮ শ’ লেখক কি খুব বেশি? মোটেই নয়।

প্রশ্নটি পরিমাণের নয়, প্রশ্নটি পরিমাপের বা গুনগত মানের। তিন সহস্র বইয়ের মধ্যে কতগুলো বইয়ের গুনগত মান উন্নত? অনেকেই অতীব সংশয়বাদী হয়ে এ প্রশ্নটি করেন। আমিও এক সময় করতাম কিন্তু এখন আর অতো জোরালো ভাবে করি না। কারণ, পাঠক প্রচন্ড ভীড়েও ভাল বইটি বেছে নেবেনই।

কিন্তু তারপরও কথা কিছু থেকেই যায়; আর তা হলো বইতো বিনোদন কিংবা অবসরের সংগী নয় শুধু; বই একটি জাতির উত্তরপ্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য বিনির্মাণ করে। আর সে জন্য প্রয়োজন ভাল বই, সুস্থ ও উন্নত মানুষ গড়ার সহায়ক বই। সহস্রের ডামাডোলে সে রকম বই প্রকাশ ও বিপণন হচ্ছে তো?

প্রতিবার যে কথাটি বলি, এবারের বইমেলার সময়েও সেটাই বলি; প্রকাশিত বইয়ের গুনগত মান বইয়ের সংখ্যার আধিক্যকে ¤øান করে দিক। বইমেলা ছড়িয়ে পড়ুক দেশের প্রতিটি এলাকায়।

একুশে বইমেলায় বিদেশের বই বিশেষকরে ওপার বাংলার লেখকদের বইও থাকুক। বইয়ের আবার সীমান্ত আছে নাকি? চিন্তাকে তো আর কাঁটাতারে বিভক্ত করা যায় না; উচিতও নয়!
বাংলাদেশের অনেক লেখক ও প্রকাশক কলকাতা বইমেলায় নিজেদের বই নিয়ে যান; অনেকে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমেই গর্বে বুক ফুলিয়ে স্ট্যাটাস দেন; অনেকে রবীন্দ্র ভারতীর বারান্দা বসে বই নিয়ে আলোচনা করেও উল্লসিত হয়ে পড়েন। অথচ সেই লেখক ও প্রকাশকই একুশে বইমেলায় ওপার বাংলার লেখকদের বই রাখার বিরোধীতা করেন। এই দ্বিচারিতা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। তাই দাবী জানাচ্ছি, আগামী বছরের একুশে বইমেলায় ওপার বাংলার লেখক ও প্রকাশকদের বইও থাকুক।

ঢাকার বইমেলা মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হয়। আর একুশের চেতনা দেশ থেকে আন্তর্জাতিক অংগন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে ইদানিং। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবেও জাতিসংঘের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। তাই ‘একুশের’ বইমেলাকেও সীমান্তের বাতাবরণে বন্ধ করে রাখা কেন?

আর একটি কথা না বললেই নয়। প্রতি বছরই দুঃখের সাথে লক্ষ করা যায়, প্রকাশনা সংস্থা এবং বইয়ের উপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। একটি বই তা যতই বাজেভাবে লেখা হোক না কেন, তার বিচারের ভার কোনো সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠানের নয়; এমনকি রাষ্ট্রেরও নয়। বই হোক মুক্ত মন এবং মুক্ত মত প্রকাশের মাধ্যম। গতবার যেমন হয়েছে, এর আগেরবার যেমন হয়েছে এবারেও কিছু প্রকাশনা সংস্থাকে একুশে বইমেলায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে কয়েকটি বইকে।

বইমেলা শুরুর আগেই এক ধরণের বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে। পুলিশ এবং আইনসংস্থার ভয় দেখিয়ে বলা হয়েছে যে, প্রতিটি প্রকাশনার উপর কড়া নজরদারী রাখা হবে। এই ধরণের চিন্তাচেতনাই তো মধ্যযুগীয়। বাংলা একাডেমি কিংবা সরকারী বাহিনি কেউই নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকারকে ক্ষুন্ন করতে উদ্যত হোতে পারে না। আশা করি ভবিষ্যতে কোনো বই-ই নিষিদ্ধ হবে না। বই এবং মত প্রকাশের অধিকারকে হরণ করার অধিকার কারও নেই।

একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, একুশ মানেই মাথা নত না করা। একুশ মানেই মুক্তমত, মুক্তচিন্তা এবং মুক্তশিক্ষা নিজের মাতৃভাষায় প্রকাশ ও অর্জন করার অধিকার। তাই একুশের বইমেলাও হোক উন্মুক্ত। একুশের বইমেলা দেশ ও ভাষার গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বইমেলায় পরিণত হোক।

তোমার জন্য শুধু তোমারই জন্য
জীবন যায় না থেমে কিংবা
একদিন থেমেই তো যাবে এ জীবন।
তোমার জন্য শুধু তোমারই জন্য
আমি এখনও স্বপ্নদেখি কিংবা
স্বপ্ন দেখি এখনো তোমারই মতন।
তোমার জন্য শুধু তোমারই জন্য
বৃত্তভাঙ্গা ছন্দ কিংবা
ছন্দবদ্ধ আজ সারাটি জীবন।
তোমার জন্য শুধু তোমারই জন্য
যে জীবন হয়নি এখনো দেখা
সেখানেই যেন আমাদের যাপিত জীবন।
মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা…….

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)