আবুল খায়ের : তাহের সাহেব ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। ভালোবেসেই বিয়ে করেছেন। স্ত্রী পেশায় একজন ডাক্তার। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখী পরিবার। থাকেন জেলা শহরে। নিজেরা গ্রামে বড় হয়েছেন বটে, চাকুরি ও পেশাগত কারণে শহরেই বসবাস করছেন। এক ছেলে এক মেয়ে’কে নিয়ে সুখী সংসার। ছেলেটা প্রথম সন্তান হওয়ার সুবাধে বাবা-মায়ের অতি আদরের সন্তান। তবে দু’বছরের মাথায় মেয়ে কণা’ দুনিয়াতে আসার কারণে কিছুটা হলেও আদরে ভাটা পড়ে। সব আদর একমাত্র মেয়ের ওপরে গিয়ে পড়ে। বাবারা মেয়েদের একটু হলেও বেশি আদর করেন। এটা অবশ্য মধ্য/উচ্চবিত্ত পরিবারে দেখা যায়। সাধারণ অথবা নি¤œবিত্তে তার উল্টোটাই দেখা যায়। মায়েরাও ছেলেদের পছন্দ করেন আবার বাবারাও ছেলেদের পছন্দ করেন। দু’দিক দিয়ে ছেলের পাল্লা ভারী আদরের দিক থেকে। আর মেয়েরা দু’দিক থেকেই সমানভাবে পিছিয়ে থাকতেই দেখা যায়। এটা শুধু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা নয়। সারা দুনিয়াব্যাপী অনেক দেশেই দেখা যায়। তাহের সাহেবের পরিবারের প্রথম সন্তান সাইফুল্যাহ। খুব মেধাবীও বটে। বাবা-মায়ের অনিচ্ছা সত্তে¡ও সাইফুল্যাহ ডাক্তারি পড়া শেষ করে বিদেশে না গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্পব্যক্ত করে।
পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান কণা। বেশ ভালো ছাত্রী না হলেও একেবারে খারাপও না। তবে খুবই আবেগপ্রবণ। বাপের আদর পেয়েই নাকি সে এমন হয়েছে! একথা প্রায়শই শুনতে হয়েছে তাহের সাহেব’কে। শত চেষ্টা করেও তার ফলাফল আশানুরূপ ভালো করা যায়নি কখনও। এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েও কোন সরকারি মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পায়নি। অগত্যা একটি প্রাইভেট ডেন্টাল কলেজে ভর্তি কপালে জুটলো। অবশ্য বাপের ইচ্ছা ছিল যেকোন একটা বিষয় নিয়ে হলেও বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তে। মায়ের ইচ্ছা একমাত্র মেয়েকে ডাক্তারি পড়তেই হবে। মায়ের যুক্তি-মেডিক্যালে পড়লে একদিকে নিজের অবস্থানটা সুদৃঢ় হবে। অন্যদিকে একটা ভালো পাত্র পেয়ে যাওয়া সহজ হবে। পড়ালেখার বড় উদ্দেশ্য ভালো পাত্র ভাগিয়ে নেয়া! বেশ! সুন্দর যুক্তি। কী চমৎকার চিন্তা। ভাবছে তাহের সাহেব। অতি আদরের মেয়ের ভবিষ্যৎ ভালো হোক, এটা কোনো বাবা কী না চাইতে পারে? অবশেষে মায়ের ইচ্ছারই জয় হলো।
আমি আগেই বলেছিলাম-মেয়েকে ডেন্টালে পড়াব না, তাছাড়া মেয়ে একাই থাকবে ছাত্রীনিবাসে। বাবা-মা ছেড়ে অনেক দূরে অবস্থান করতে হবে। এইদিকে দেশের যা অবস্থা! কখন কী হয়! প্রতিদিনই কোন না কোন মেয়ে ঘটিত দুর্ঘটনা পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই দেখতে পাওয়া যায়। এমনিতেই মেয়েটা খুবই আবেগপ্রবণ। এসব অনেকবার বলেছিলাম। কিন্তু তোমরা মা-মেয়ে আমার কথা কর্ণপাত করনি। টিস্যু পেপারে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন-তাহের সাহেব। কেঁদে কী হবে। যা হওয়ার তাই হবে। বাপে দোষে মা’কে আর মা’ দোষে ভাগ্যকে।
রমজান মাস। সবাই ইফতারী তৈরীতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাগরিবের আজান হবে। এমনি এক সময়ে ধপাস একটি আওয়াজ শোনা গেল। উৎসুক অনেকে বাসার বাহিরে এসে দেখল যা দেখল, তা রীতিমতো ভয়ংকর। দৃষ্টিসীমার মধ্যে পাশের বাড়ির কোণে নিচে একটি মেয়ে পড়ে আছে। দু’টি ফ্ল্যাটের মাঝামাঝি ময়লা ও নোংরা আবর্জনায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। উপস্থিত অনেকেই চিনতে পেরেছে, ‘এই-তো আমাদের ডাঃ আপা’। কণা’র এক বছরের জুনিয়র ‘শুচি’ বল্ল। এরই মধ্যে ইন্টার্নীরত ও রুমমেট কয়েকজন হাজির। ওরা বলাবলি করা শুরু করল। মেয়েটা আসলে যে কী? আর ভালো হলো না। ইতিমধ্যে মায়ের মোবাইল আসলো সহপাঠী একজনের মোবাইলে। জানতে চাইলো, কণার কি হয়েছে? কেমন আছে সে? বুঝতে অসুবিধে হলো না, মায়ের সাথে হয়ত কথা কাটাকাটি হয়েছে। কাঁকন নামের একটি মেয়ে (পাশের ফ্ল্যাটের) কণার মোবাইল নিয়ে আসলো। মোবাইলে শেষ কলটি ছিল কণার মায়ের। তার মানে চার তলা থেকে লাফ দেয়ার আগে মায়ের সাথে কথা হচ্ছিল এবং এক পর্যায়ে মায়ের সাথে রাগ করেই মেয়েটা ছাদ থেকে লাফ দেয়, জীবনকে শেষ করে দিতে। এটা এখন পরিস্কার।
যেহেতু মেডিকেল স্টুডেন্ট, তাই সরকারি মেডিকেলে প্রয়োজনীয় টেস্ট, চিকিৎসা ভালোই চলছে। বড় ভাই সাইফুল্যাহ এসে হাজির রাতেই। ক্লাশমেট সুমাইয়ার বাবা কথা প্রসঙ্গে বলছে-দেখ মেয়েরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারে না। মনে করো-‘সাইফুল্যাহ যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হতো তবে, ইচ্ছে করলেই আসতে পারতো না’। কারণ তাকে চাকুরিতে বসকে ম্যানেজ করা, শ্বশুরবাড়ি লোকদের এবং নিজের বাড়ির লোকদের’সহ সবাইকে ম্যানেজ করেই আসতে হতো। আর সাইফুল্যাহ ছেলে হওয়ার কারণে অতিদ্রæত বোনের চিকিৎসার জন্য ছুটে আসতে পেরেছে। তাইতো বলা হয় ছেলে-ছেলেই আর মেয়ে-মেয়েই। মেয়েদের জীবনে প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই। কণার মা-বাবা সকালে এসে পৌঁছুল হাসপাতালে।
অবস্থা এখনও বিপদ মুক্ত নয়। ভালো চিকিৎসার জন্য দু’দিন পরই কণাকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হলো। একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা চলতে থাকে। পনের-বিশ দিন চিকিৎসার পর কিছুটা বিপদ মুক্ত হলেও সে স্বাভাবিক জীবন আর ফিরে পাবে না। স্মৃতিশক্তি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগের সব কিছু সে ঠিক মতো মনে করতে পারছে না। তবে মা’ তাকে বকা দিচ্ছিল, সেটা কেবল মনে আছে। মায়ের কাছে যেটা জানা গেল, সেটা কতো যে ভয়াবহ। কণা একটি বখাটে গাঁজাখোর’কে বিয়ে করে ফেলেছে। কণার মা’ বিষয়টি জেনে গেছেন। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ মায়ের সাথে মোবাইলে তর্ক-বির্তক চলছিল কণা’র। সেদিনও তাই হচ্ছিল। মা এক পর্যায়ে বলতে বাধ্য হলেন যে ‘তোর মতো মেয়ে আমার আর দরকার নেই’। আবেগপ্রবণ মেয়ে কণা’ তার মায়ের এহেন কথা শুনে আর স্থির থাকতে পারল না। ছাদের ওপর থেকে লাফ দেয়। দু’পাশের বিল্ডিংয়ের সাথে এপাশ ওপাশ করে নিচে পড়ল। হাতের মোবাইলটি তখন পাশের ফ্ল্যাটের ছাদে গিয়ে পড়ে। মাথার আঘাত মারাত্মক ছিল না বলে বেঁচে গেল। তবে পাঁজরের কয়েকটা হাড় ভেঙ্গে গেছে। যা কখনও ভালো হবার নয়।
হাসপাতালে সেদিনকার কথা বলতে বলতে মা’য়ের কান্না দেখে কণা কিছুটা বুঝতে পেরেছে। মা’ তাকে এখনও ভালোবাসে। আসলে কাজটি সে ঠিক করেনি। এখন বুঝেও আর কী লাভ? একটা অচেনা বখাটে-আওয়ারা ছেলেকে বিয়ে করে মারাত্মক ভুল করেছে। এত বিপজ্জনক অবস্থার কথা শুনেও ছেলেটি একবারও দেখতে আসেনি। মোবাইলও করেনি। এরা আসলে সাংঘাতিক খারাপ, ছোটলোক। আর ছোটলোকতো ছোটলোকই থাকবে, ভালো হবে না। মায়ের আহাজারিতে যেন পুরো হাসপাতাল ভারী হয়ে ওঠে। বাবা তাকে সান্ত¡না দেয়। বড় ভাই চোখের জল মুছে আর সান্ত¡না দেয় মা’কে। কিন্তু কে কাকে বুঝাবে? কিছু দিন আগেও কতো সুন্দর একটা জগৎ ছিল কল্পনায়। আজ সবই অতীত।
একটি ভুল মানুষের জীবনের উন্নয়নের গতিকে নষ্ট করে দিতে পারে। ভোগান্তিতে ফেলতে পারে আরো অনেকগুলো মানুষকে। জীবন এমনি।।