বিদ্যুৎ সরকার : সেই চোখ
চৌদ্দ.
দূর থেকেই ওর উপস্থিতি আমি লক্ষ্য করেছি। কিছুটা কাছে যেতেই চোখা-চোখি হোয়ে গেল। ইচ্ছে করেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম ও চোখের সীমানা থেকে। ক্ষণিকের দেখা। কী দারুণ শুভ-দৃষ্টি! মনে হয় যেন অনন্তকাল নিষ্পলক চেয়ে থাকি উদাসী হোয়ে। কত চোখেইতো চোখ রেখেছি কই এমন হীম শীতল চোখ আগে কখনো দেখিনি! আরো কাছে গিয়ে ওর চোখে চোখ রাখতেই একটু যেন বিচলিত হলো কী ভেবে। এটা ভয় না কি লজ্জা? আমার তো মন মানে না। ইচ্ছে হলো আরো কাছে গিয়ে ওকে ছুঁয়ে দিই আলতো করে ওর চোখের কাজল কালো পাপড়িগুলোও। আহা! কী নির্মল সুখ আমি অনুভব করছি। কী অনাবিল প্রশান্তি আমার অন্তর জুড়ে – সবটাই আমার সুপ্ত ভাবনা আর গুপ্ত ইচ্ছা। চোখ কেমন করে এতো সুন্দর হতে পারে! তাই বলে এতটা সুন্দর, যার কোন তুলনা হয় না।
সেই কবে রূপকথা গল্পের বইয়ে আঁকা শকুন্তলার চোখের ছবি আর, বড় হয়ে ‘ক্লিওপেট্রা’ সিনেমার সেই হৃদয় হরা রাণী ক্লিওপেট্রার চোখ। আমি আজও ভুলে যাইনি ভুল করেও একটি বার। কিন্তু এ চোখ যেন বনলতা সেনের সেই চোখকেও হার মানায়। মনে হয় হাজার বছর এ দু’চোখে চোখ রেখে দিই, নির্দ্বিধায় প্রেমিক হোয়ে গেয়ে উঠি – “আহা হা সেই চোখ কত প্রেরণার সেই চোখ যেখানে সেখানে যায় শুধু হারিয়ে।” এক জোড়া চোখের জন্য এতো ভালোবাসা, এতো উন্মাদনা আমার! আগে কখনোত এমনটা অনুভব করিনি। তবে কেন আজ এতোটা উত্তাল হলাম অবুঝের মতোন! শুধু একটি বার সে চোখ দুটি ছুঁয়ে দেবো আমি, মাত্র একটি বার স্পর্শ করবো। প্রয়োজনে বাকি জীবনে সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার এখানেই ইতি টেনে দিতে পারি। ওর ঠোটদুটো তাও বা কম কিসের? মসৃণ, উজ্জ্বল সুদূরের পিয়াসী। কাছে গেলে সে কি দূরে চলে যাবে? কতটা অবজ্ঞা, অপছন্দ করলে এমনটা করতে বাধ্য হবে সে। আমার অসহিষ্ণুতাই কী তার সমস্ত অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
তার দৃষ্টিতে কি অনেকটাই তুচ্ছ হয়ে যাবো না আমি? না থাক, ওকে ওর মতোই থাকতে দাও। না হয় আমার একটি চাওয়া না পাওয়া হয়ে থাকবে। তবুওতো তাকে দূর হতে ভালোবেসে যেতে পারবো আজীবন। সে কি এখনও ওখানটায় থাকে, যেখানে ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল? তাওতো প্রায় তিন বছর আগের কথা। অনেক কিছু দেখতে গিয়ে ওকে আবিষ্কার। যেন ‘চাঁদ দেখতে হিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’র মতন ব্যাপারটা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে এমনটাই হয় বোধ হয়। তাই বলে এতোটা – মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি? তাও আবার অঝর ধারায় মনের জানালা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঝুল বারান্দায়। সবকিছু ছাপিয়ে ওর দু’টো চোখ আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। মনে পড়ে অনেকটা কাছে যেতেই উঠে বসলো, চলে যাবার উপক্রম হতেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম ওকে আস্বস্ত করতে। এক পা’ও বাড়াইনি। ফিরে আসার সময় শেষবারের মতো ওর চোখে চোখ রাখলাম। মনে হলো যেন আমার সমস্ত শান্তি ওর দু’’চোখেই লুকিয়ে আছে। শুধু কষ্ট করেই খুঁজে নিতে হবে আমাকে।
গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল এটাক্ হওয়ার সময় অনেক কিছুর মতো তারওতো স্থানচ্যুত হওয়ার কথা। সে লংকাকান্ডে প্রাণহানীর মতোন ঘটনাও ঘটেছিল, মারদাঙ্গা, গোলাগুলি। এমন ভীতিকর পরিস্থিতিতে তার ওখানটায় থাকার কথা নয়। তা’হলে বুঝি আমার আর দেখা হবে না সে দু’টি চোখ কোন কালেও? সেবার ওয়াশিংটন ডি সি’তে বেড়াতে গিয়ে হোয়াইট হাউস ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দর্শনীয় স্থাপনাসমূহ দেখতে দেখতে এক সময় ক্যাপিটল হিল বিল্ডিংয়ের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। যে ছোট রাস্তাটি সরাসরি হলে গিয়ে শেষ হোয়েছে তার শুরুতেই একটি ছোট্ট ফটক। কারুকাজ করা সেই সুরম্য ফটকের মধ্যেই ওকে খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। আমার আবির্ভাব ওকে যতনা বিচলিত করে ছিল তার চেয়ে আমার স্থির দৃষ্টি তাকে করে তুলেছিল খুবই অস্থির। নিজ হাতে সযত্নে নির্মিত বাসায় উদাসী একটি খয়েড়ি রঙের শালিক বসেছিল ডিম ফোটাবার প্রত্যাশায়। এরই মায়াবী চোখের মায়াজালে আমি বন্দী হয়েছিলাম সেদিন।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা